×

মুক্তচিন্তা

তোফাজ্জল হোসেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:৫৪ পিএম

তোফাজ্জল হোসেন

তোফাজ্জল হোসেন ১৯৩৫ সালের ৯ অক্টোবর কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার তালেশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে সম্মানসহ এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে ইত্তেফাকের সহসম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। ১৯৬৭ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। বিসিএস তথ্য সার্ভিসের সিনিয়র সদস্য হিসেবে তথ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে ও তথ্য অধিদপ্তরে অতিরিক্ত প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি একাধারে একজন কবি, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, সংগঠক এবং গ্রন্থকার ছিলেন। তিনি বিশ্বব্যাংক ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট, বিআইডিএস এবং বাংলা একাডেমির একজন ফেলো এবং দৈনিক ভোরের কাগজের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় একুশে পদক লাভ করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ কর্মী। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করলে তিনি তৎপর হয়ে ওঠেন এবং বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় যুবকর্মী হিসেবে রাত জেগে পোস্টার লেখা, দেয়ালে পোস্টার লাগানো, নেতাকর্মীদের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান ছিল তার প্রধান কাজ।

একুশের হত্যাকাণ্ডের পর রেডিও শিল্পীদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে তিনি অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘আমি প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। কুমিল্লা জেলা স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হই। পরে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ভর্তি হই।

১৯৫২ সালে আমি জগন্নাথ কলেজে আইএ ক্লাসের ছাত্র। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে আমার জড়িত হওয়ার পেছনে কতগুলো কারণ ছিল। আমি তখন থাকতাম কমলাপুরে। তখনকার কমলাপুরের পরিবেশ ছিল গ্রামের মতো। তখন সেখানে আসতেন ভাষা আন্দোলনের অনেক কর্মী ও নেতারা। তারা সারাদিন সংগ্রাম আন্দোলন করে রাতে আমাদের বাসায় থাকতেন। তাদের সঙ্গে আমার গড়ে ওঠে সখ্য। আমি সবার খাবারের ব্যবস্থা করতাম। ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে এখানে আলোচনা করা হতো।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আন্দোলন বেগবান হয়। খাজা নাজিমুদ্দীনের উর্দুর পক্ষে বক্তৃতার পরপরই ছাত্ররা প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ২১ তারিখ সারাদেশে হরতাল ঘোষণা করা হয়। সরকার ২০ তারিখ শেষ বিকেলে ১৪৪ ধারা জারি করে। এ ঘটনা আমাদের উত্তেজনাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ২১ তারিখ গোলাগুলি হলো। চার পাঁচজন ছাত্র শহীদ হলেন। এ এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। ছাত্রহত্যার পর রেডিও শিল্পীরা ধর্মঘট করেছিল। রেডিওতে ধর্মঘট করার ব্যাপারটি ছিল ঐতিহাসিক এবং অকল্পনীয়।

এ সময় এটি ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান। আমি শিল্পীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করি। রেডিও শিল্পীদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল। আমাদের বাসার কাছেই ছিল রেডিও পাকিস্তানের শিল্পীগোষ্ঠীর মেস। সেখানে আমার অবাধ যাতায়াত ছিল। লতিফ ভাই, সোহরাব ভাই, বেদার ভাইসহ আমার অনেক পরিচিতশিল্পীরা এখানে থাকতেন, পরবর্তীকালে একুশের সঙ্গীতসমূহ তখন থেকেই সম্প্রসারিত ও বিকশিত হয়েছিল। আমি মুকুল ফৌজ করতাম।

৩২নং পুরনো পল্টনে এর অফিস ছিল। সেখান থেকে মুকুল নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। আমি পত্রিকাটি সম্পাদনা করতাম। এখানে কাজ করতে পেরে একুশের সব ঘটনা অবগত ও উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছিল। ২২ তারিখে বিকেল থেকে মিছিল হয়েছিল। সে মিছিলে আমি হাসান ভাই, আমীর আলী অংশ নিই। আমীর ভলাট গলায় স্লোগান দিচ্ছিল। আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মোকাররম হোসেনের স্ত্রী যিনি পরে অধ্যাপনা করেছেন। আমাদের পুলিশ লাঠিচার্জ করেছিল। হাসান ভাই ও আমি কার্জন হলের দেয়াল টপকিয়ে চলে আসি।

আমার মনে পড়ে নীলক্ষেতে সেনাবাহিনীর রিক্রুটমেন্টের ক্যাম্পের সামনে একটি শিশুর গায়ে গুলি লেগেছিল। শিশুটি রাস্তায় পড়ে ছটফট করছিল। আমি তখন ঘটনাস্থলের বিপরীত দিকে আজিমপুর কোয়ার্টারের একটি বৈদ্যুতিক অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি। পরে শিশুটিকে হাফপ্যান্ট পরা এক পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে যায়। শিশুটির আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

আমীর আলী ও আমি একসঙ্গে সাইকেল করে ঘুরে বেড়াতাম। ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিকশিত হয়। আমরা দুজন একই সাইকেল একজন চালালে আরেকজন ডাণ্ডায় বসতাম। এভাবে আমরা অনেক সময় কাটিয়েছি। এই সময় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছি। সাংস্কৃতিকসেবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি।’ এই মহান ভাষাসংগ্রামী তোফাজ্জল হেসেন ২০১৫ সালের ৫ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App