×

বিশেষ সংখ্যা

তবে এবার যে যেতে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:৫৩ পিএম

আজকাল মনে হয় জীবন এতো ছোট কেন, জীবন যদি দীর্ঘ হতো, হয়তো হতে পারতাম জজ -ব্যারিস্টার, কিন্তু আজকে যখন নিজের বাড়ির কোনো একটি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, তখন দেখি আমার মাথার চুলগুলো শরৎকালের শিউলি ফুলের মতো সাদা অথবা বলা যেতে পারে নদীর পাড়ের কাঁশফুলের মতোই উড়ছে বাতাসে। আর তখনি মনে হয় চুল পাকিলে কাঁদি কেন। মনে হয় রবি ঠাকুরের গানের একটি কঠিন সত্য চরণ “এবার আমারতো যেতে হবে।” যেতে যে হবেই। সেটি নিশ্চিত। আরো নিশ্চিত যাবার আগে কিছুদিন হয়তো চোখে দেখবো, ফুটবল মাঠের একটি হলুদ কার্ড। শেষ দিন অবশ্য এক রেফারি হাতের লাল কার্ড দেখিয়ে বলবে, “তবে এবার যে যেতে হবে।” [রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্বের গানের একটি চরণ।]

নিরানন্দে অনেকেই থাকতে পছন্দ করেন। হয়তো থাকবার বিবিধ ঘটনা জেগে আছে তাদের জীবনে। “জীবন ক্যানে এতো ছোট?” তারা শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘কবি’তে বলেছিলেন জীবন কেন এতো ছোট! তিনি ঐ উপন্যাসেই জানিয়েছিলেন “চুল পাকিলে ক্যান্দো ক্যানে।”

ঐ দুটি প্রশ্নের উত্তর আজ অবধি কেউ দিতে পেরেছেন কিনা অন্তত আমার জানা নাই। তবে উক্তিগুলোর নিগূঢ় আভাস আজ হয়তো কিছুটা বুঝতে পারি, প্রতিটি মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বভাব, সব সময়ই ছিল এবং এখনো আছে।

মাঝে মাঝে গ্রামে যাই, ফিরে পেতে চাই জীবন ক্যানে এতো ছোটর উত্তর। সকাল-দুপুর গড়িয়ে এক পা, দুপা করে বিকেল হলেই মনে পড়ে কৈশোরের খেলায় দিনগুলোর কথা। একটি ফুটবল, একটি ফুটবলের ব্ল্যাজার, ফুটবলের বাতাস দেবার পাম্প। সবকিছু মিলিয়ে দাম ছিল, ৩ থেকে ৪ টাকা।

সেই ৩ থেকে ৪ টাকার ভেতরে যিনি ১ টাকা দেবে, তার অধীনেই থাকবে ফুটবলসহ সবকিছু। সেই ১ টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বাড়ির পূর্বের দিকের বাঁশঝাড় থেকে একটি বড় বাঁশ বিক্রি করে দিলাম, পিতার অনুপস্থিতিতেই। পিতা সেবার ঢাকায় এসেছিলেন, সেই ১৯৫৯ সালে।

বিশাল বাঁশ বিক্রি করে পেলাম ২ টাকা, সেই টাকা থেকে ১ টাকা চাঁদা দিয়ে আমরা সাত-আট জন পাবনা শহরে গিয়ে সুধীর স্পোর্টস থেকে অনেক দরদাম করে একটি ফুটবল কিনলাম। যেটি এসেছিল তৎকালের পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে।

দাম দিতে হলো, সড়ে ৩ টাকা- যেহেতু আমি দিয়েছিলেম ১ টাকা, আমার অন্য খেলোয়াড় বন্ধুরা সকলেই দিয়েছিল বাদবাকি আড়াই টাকা। তবে শর্ত ছিল, ফুটবল, পাম্প সবকিছু আমাদের বাড়িতেই থাকবে। আমার অধীনে। খেলোয়াড় ২২ জন, হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের।

আরিফপুরের মুনসুর হাজির প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার মাঠটি ছিল বিশাল। সেই মাঠেই ২২ জন মিলে চলতো খেলা, সব ঋতুতেই, ব্রজনাথ অসম্ভব ভালো খেলতো সেন্টার ফরোয়ার্ডে, দোহার পাড়ার সুলতান ছিল গোলকিপার। একবার সুলতানের সঙ্গে আমার মারামারি হয়েছিল পাবনা গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউশনের মাঠে।

সুলতান চিনেবাদাম, চুরমুর খাস্তা কেড়ে নিয়েছিল আমার কাছ থেকে, সে কয়েকটি চিনেবাদাম চেয়েও যখন পায়নি, তখনি মারামারির সূত্রপাত। মারামারিতে আমি জিতে গেলেও হেরে গেলাম, দোগাছি বনাম দোহারপাড়া ফুটবল ক্লাবের ফাইনাল খেলায়।

দোগাছির হরিপদ বারবার চেষ্টা করেছিল, আমাদের খেলোয়াড় ব্রজনাথকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে এবং বার তিনেক ফাউল করার দায়ে তাকে রেফারি পাবনা সদর পোস্টাপিসের পিয়ন জয়নাল আবেদীন চাচা সতর্ক করা সত্ত্বেও হরিপদ রেফারির হুইসেলকে অগ্রাহ্য করেই চলেছিল কেননা, আমাদের কৈশোরের সেই ফুটবল খেলার দিনে না ছিল জার্সি, বুট, এমনকি হলুদ কার্ড-লাল কার্ড।

আজকাল হলুদ এবং লাল কার্ডের দৌরাত্ম্য বেশি বলেই মনে হয় প্রতিটি খেলাতেই, বিশেষত রাজনীতির খেলায়। আবার এমনও হয়, বিপক্ষ দলের সঙ্গে আঁতাত করে নিজ দলকে হারিয়ে দেয়া। সেই আঁতাতই করেছিল আমাদের দোহারপাড়া ক্লাবের গোলরক্ষক সুলতান। সুলতানকে আমি স্কুলের মাঠে চিনেবাদাম দেইনি বলে সে আমার ওপর আগেই রেগেছিল।

তারই প্রতিশোধ নিয়েছিল ইচ্ছাকৃতভাবে দুই গোল খেয়ে। আমাদের দোহারপাড়া ক্লাব হেরে গেল দুই শূন্য গোলে। রেফারি জয়নাল চাচা রাগারাগি করলেন আমার উপরে, তার সেই রাগ গিয়ে পড়লো আরিফপুরের আমীর হামজা এবং মোক্তারের ওপর- তারা কেন ঠিকমতো পাস আমাকে দেয়নি। খেলা শেষ হতে না হতেই দেখি সুলতান নেই।

পালিয়ে সে নাকি তার বড় বোনের বাড়ি দিলালপুরে চলে গিয়েছে। আমাদের ক্লাবের গোপাল ঘোষ কাঁদো কাঁদো গলায় জানালো- সুলতান নাকি দোগাছি ক্লাবের মোটা শ্যামলের কাছ থেকে আগাম চার আনা নিয়ে বলেছিল- তোদের দোগাছি ক্লাবকে জিতিয়ে দেবো, দুই গোলে- ঐ শালা রোকন (আমার ডাকনাম) সেদিন আমাকে স্কুলে চিনেবাদাম না দিয়ে একাই খেলো।

আমি চাইতেই শুরু করলো মারামারি আমার সাথে- এবার দ্যাখ শালা, দুটি গোল খাইয়ে দিলাম, ইচ্ছে করলে ধরতে পারতেম। গোল খেয়ে ফুটবল মাঠেই দাউদ হায়দারকে বললাম, এখন থেকে ঐ ফুটবল, পাম্প, সব তোর।

বাবলু, রাজা, রতন, টিটু, হামিদ থাকবে আমাদের দোহারপাড়া ফুটবল ক্লাবে আর সুলতান শালাকে যদি একবার ধরতে পারি... এমন সময় রেফারি জয়নাল আবেদীন চাচা তাকে জানালেন, তোদের জন্য আজ চেষ্টা করেছিলেম তোরা জিতলে পাবি রুপার কাপ, একটি মেডেল এবং মুনসুর হাজি সাহেব নিজ হাতে দিতে চেয়েছিলেন, বড় একটি শিল্ডসহ তোদের প্রত্যেককে একটি করে রুপার চাঁদির এক টাকা।

ঐ সুলতান তো ইচ্ছাকৃতভাবে দুই গোলে হারিয়ে দিলো, তোদের ক্লাবকে এখন থেকে আর গোলকিপার ওকে না রেখে খোকনকে অথবা হামিদকে গোলকিপার রাখতে হবে।

আমাদের গ্রামে ফেরার আগেই মনে মনে ঠিক করলাম এখন থেকে আর ফুটবল না খেলে পাবনা শহরের লাহড়ীপাড়ায় একটি গ্রামের স্কুল খুলেছে পাবনার জেলা প্রশাসক বা ডিসি সাহেব। আমাদের দোহারপাড়ার বাড়িতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগেই সম্ভবত ৩০ দশকেই আমাদের পিতা শেখ মোহাম্মদ হাকিম উদ্দিন, আমার বড় দুই বোনের জন্য হারমনিয়াম, ডুগি, তবলা কলকাতা থেকে কিনে এনেছিলেন পিতার ইচ্ছে ছিল মেয়েরা বড় হলে ইন্দুবালা-কানন বালার মতো গান শিখবে।

আমাদের ছোট কাকা শেখ মোহাম্মদ আবুল কাশেম। তিনি ১৯৪১ সালে তানপুরাসহ কিনেছিলেন একটি কলেরগান। সঙ্গে কিছু প্রভুভক্ত কুকুরের রেকর্ড। ছোট কাকা ছিলেন নাটকের লোক। আমাদের পিতা ছিলেন পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানের ভক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরেই শুরু হয়েছিল সুভাষ বসুর নেতৃত্বে ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলন।

সেই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন সূর্যসেনসহ অগণিত স্বাধীনতাকামী মানুষ। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায় নিরপরাধ লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। এবং একই সঙ্গে ইংরেজদের কূটকৌশলে দুর্ভিক্ষেও মারা গিয়েছিল অনাহারে-অর্ধহারে, অসুখে হাজার হাজার মানুষ।

সেই দুর্ভিক্ষ চলাকালীন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ পণ্ডিত হৃদয়নাথ কুঞ্জুরু ২১ নভেম্বর ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চল সফর করে অত্যন্ত বিচলিত হন। তিনি ভারতের বড়লাট লর্ড ওয়াভেল সাহেবের সাথে দেখা করে বাংলার দুঃখ দুদর্শার কথা জানান।

লর্ড ওয়াভেল হৃদয় নাথের বক্তব্য শোনার পরে বিলাতে টেলিগ্রামে জানান, “বঙ্গদেশের দুর্ভিক্ষের ন্যায় এত বড় দুর্দশা ব্রিটিশ রাজত্বে খুব কমই ঘটিয়াছে। ইহাতে দেশে-বিদেশে ব্রিটিশের অখ্যাতি রটিবে। অবিলম্বে খাদ্যদ্রব্য এ দেশে না পাঠাইলে দুর্ভিক্ষ আরও গুরুতর আকার ধারণ করিবে।” [প্রফেসর আর সি মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ৪র্থ খণ্ড।]

লর্ড ওয়াভেল পরবর্তী সময়ে বড়লাট হয়ে এসেছিলেন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি কলকাতায় রেশন প্রথা চালু করেছিলেন, দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল প্রায় ১৪ থেকে ১৫ লক্ষ মানুষ। এতো মৃত্যু, এতো যন্ত্রণা সহ্য করেও ব্রিটিশদের এ দেশ থেকে বিদায় দিয়ে এই দেশটাকে শাসন করতে চেয়েছিলেন, স্বাধীনতাকামীরা।

কিন্তু সেটি সহজে হতে দেয়নি, বাংলার রাজনীতিবিদেরা যারই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৬-এ হিন্দু-মুসলমানদের ভেতরে খুনোখুনি, সবশেষে ১৯৪৭ সালে দেশটিকে কয়েক টুকরো করলেন তৎকালের শাসকেরা। হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতরের সংঘাতের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পেলাম।

১৯৬৪ সালে ঢাকায়, তবে তার আগে ভারতের বিহারে জব্বলপুরে এবং আহমেদাবাদে ১৯৬২ সালে দুই সম্প্রদায়ের ভেতরে যে দাঙ্গা হয়েছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ১৯৬৪ সালে সেকালের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জনাব মোনায়েম খানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নেমে এসেছিল এক দুর্যোগ।

পুরাতন ঢাকার অনেকেই নিহত হয়েছিল বিহারিদের হাতে। যে সকল বিহারি এবং পশ্চিমবাদীয় রিফিউজিরা এসে উঠেছিল মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ঈশ্বরদী, পার্বতীপুর, চট্টগ্রামসহ অন্য জেলায় মূলত সেই সকল রিফিউজিদের ভেতরে বিহারি সম্প্রদায়ের কসাই, এরাই ছিল ১৯৬৪ সালে হিন্দু সম্প্রদায়কে উচ্ছেদের অগ্রভাগে। অগ্রদূত ছিলেন স্বয়ং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর।

যেহেতু ভারত থেকে আগত হাজার হাজার রিফিউজিদের স্থায়ী করণের লক্ষ্যে। হিন্দু উচ্ছেদের প্রধান কারণ। সবকিছুই যেন আজও চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বিশেষত পাবনা শহরের দিলালপুর মহল্লার বলাইদাকে নৃসংসভাবে হত্যা করেছিল। ইউনুস, বিহারির দল। এ ছাড়াও বাণী সিনেমা হলের পেছনের তিনতলা বাড়ির মালিক একজন বিশিষ্ট উকিলসহ শালগাড়িয়া, লাহিড়িপাড়ায়ও সংঘটিত হয়েছিল সেই দাঙ্গা।

আর সেই লাহড়িপাড়াতেই ৬০ দশকের গোড়ার দিকে স্থাপিত হয়েছিল ‘ইফা’ এবং ‘আপওয়া’ (ইনস্টিটিউট অফ ফাইন আর্টস। অল পাকিস্তান উমেন এসোসিয়েশন) ইচ্ছে জাগলো ইফায় গান শিখিবো- বাড়ির জাগীর মাস্টার আবু মুসার অতি উৎসাহে যথারীতি ৩ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েই প্রথম দিনেই দেখলাম সুদর্শন, ভীষণ লম্বা, সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা একজন ভদ্রলোককে- ইফার দায়িত্বে ছিলেন নূরপুরের একজন মোটা ভদ্রলোক, নাম আবদুর রশিদ।

তিনি জেলা প্রশাসনের কর্মচারী ছিলেন, ধুতি পরা সেই ভদ্রলোককে নিজের চেয়ার ছেড়ে দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করলেন, তার চেয়ারে বসবার। ধুতি পরিহিত চেয়ারে না বসে সরাসরি চলে এলেন আমাদের কাছে- পাশের রুমে তখন আমরা গান শিখলছিলাম।

ভদ্রলোককে দেখে আমাদের গানের শিক্ষক, আগন্তুকের পায়ে হাত দিয়ে এবং প্রণাম শেষে জানালেন, বারীনদা কেমন আছেন। পরে আমাদের বাড়ির জাগীর মাস্টার উনার কাছ থেকে জেনেছিলাম, সেই আগন্তুকের নাম ছিল বারীন মজুমদার।

শৈলেশ কাকা (শৈলেশ সান্যাল) নারায়ণ কাকা (নারায়ণ বশাক) এরা তবলা শেখাতেন, মাঝে মাঝে বিশেষত ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্মদিন উপলক্ষে শালগাড়িয়ার রূপবাণী শিকদার, গোপালপুরের অনিমা দাস, শিউলি বিশ্বাস এরা আধুনিক রবীন্দ্র-নজরুল গীতি গেয়ে শোনাতেন- পাকিস্তানের জন্মদিনে।

সেবার প্রচণ্ড শীতের রাতে আমাদের দোহারপাড়ায় ফিরছিলাম, ইফাতে ভুপেনদার শেখানো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে। গ্রামে ফিরতে ফিরতে মনে হলো বিশাল বট পাকুড়ের ডাল যেন এখনি জড়িয়ে ধরবে আমাকে। বাঁশ বাগানের ভেতর থেকে ভেসে এলো রাত জাগা পাখিদের কোলাহল- যেন এই পৃথিবীর শুধু একটি রাত্রির সৌন্দর্য, গ্রামের বাড়িঘরের এক ধরনের নিস্তব্ধতা, রাস্তার পাশেই দাঁড়ানো তেঁতুল গাছের মগ ডাল থেকে ভেসে এলো পেঁচার ডাক।

সেই নির্জনতার ভেতরে আমার মতো অনেকেই। এর আগে হয়তো এই পথ দিয়ে চলতে চলতে কিংবা সুজানগর-নগরবাড়ি এলাকার লোকজন যখন এই পথ দিয়ে এই নিশুতি শীতের রাতে ভাওয়াইয়া গান গাইতে গাইতে চলে যেতো তাদের নিজ গন্তব্যে তখন হয়তোবা কোনোদিন মনে পড়েনি, এই যাত্রার শেষ কোথায়, সেই নির্জনতার আস্বাদ তারাও নিতে ভুলে যাননি।

কারণ আমার পিতাকে প্রায়শই বলতে শুনতাম সুখ আনন্দের উপকরণ আকাশ/বাতাস/আমাদের বাড়ির উঠোনের ধূলিকণা ও চারপাশের মানুষজনের মনের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে আনন্দ, তাকে আমাদের সকলকেই খুঁজে নিতে হবে। দুঃখকে যতোটা পরিহার করা যায় ততোই মানবজীবনের মঙ্গল।

আমার স্বল্প শিক্ষিতা মা- মায়ের লেখাপড়া ছিল সেকালের ক্লাস থ্রি-ফোর পর্যন্ত। তার পরেও তাকে ঢাকার মালিবাগের ১৪/২ বাড়িতে দেখেছি রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি/যোগাযোগ/এবং শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়তে। সেটি ছিল ৬০ দশকের ঘটনা। কিন্তু আমার স্বল্প শিক্ষিতা মা, পিতার স্বগত কথা হয়তো তার কাছে বাণী হয়ে যেত।

পরবর্তীতে আমার পড়ালেখার জীবনে পিতার মৃত্যুর পরে মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম। আর আজ রাতে এই নির্জন পথে হাঁটতে হাঁটতে আকাশের দিকে চাইতেই দেখলাম, কিছুটা অস্বচ্ছ। আমার সেই নির্জনতাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে এই শীতের সাদা সাদা হিম কুয়াশা। এরই মাঝে শুনতে পেলাম ঝাঁকে ঝাাঁকে শেয়ালের ডাক।

পাবনা সদর গোরস্তানের ভেতর থেকে ভয়ে দ্রুত পা চালিয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে এগুতেই দেখি আমাদের ফজলি আম বাগানের নিচে বাতি জ্বালিয়ে মুদি দোকানের মালিক ওয়াজউদ্দিন আর একজন লোকের সঙ্গে গল্প করছেন। যার সঙ্গে কথা বলছেন তিনি আমাদের বর্গাচাষি তাজউদ্দিন প্রামাণিক।

শেয়ালের ডাকের যে ভয় পেয়েছিলেম সেই ভয় কেটে গেলো- ঐ নিশুতি রাতে নির্জন পথে একটি ছেলেকে দেখতে পেয়ে ঐ দুজনার কে যেন জানতে চাইলেন, এতো রাতে কে যায়। যেহেতু আমার সমস্ত শরীরে শীতের মোটা কাপড়, মাফলার, কান ঢাকা। সেই জন্যই ওরা আমাকে চিনতে পারেনি।

আমি আমার নাম রোকন বলতেই তাজু চাচা জানতে চাইলেন এই শীতের গভীর রাতে কোথা থেকে এলে? সত্য কথাই বললাম, ইফাতে গান শিখে বাণী সিনেমা হলের সামনে গিয়ে দেখি- ঐ বাণী সিনেমা হলে সুচিত্রা-উত্তমের সবার উপরে সিনেমা চলছে। আমি সেকেন্ড শোর সাড়ে আট আনার একটি টিকেট কিনে সিনেমা দেখে বাড়িতে আসার সময় দুই একজনকে সাথে পেয়েছিলাম।

আমাদের মিশন হাউজ মহল্লার গোমেজ কাকাকে, তিনি তার এক বন্ধুকে বারবার বলছিল ছবি বিশ্বাসের আমাকে ওয়াজেদ চাচা থামিয়ে দিয়ে বললেন, ঐ টকি আমি আর তাজু পরশু দিন সেকেন্ড শোতে দেখে এসেছি- সেই ছবি বিশ্বাসের ফিরিয়ে দাও আমার ১২টি বছর, ঐ কয়টি কথা শোনার জন্য এর আগে আমি আর তোর ছোট চাচা আবু ভাই [শেখ মোহাম্মদ আবুল কাশেমের ডাকনাম] দেখে এসেছি। খুবই ভালো টকি- তা বাবা গান শেখো আর ছবি দ্যাখো, লেখাপড়া ঠিকমতো করা চাই। হওয়া চাই জজ ব্যারিস্টার।

আজকাল মনে হয় জীবন এতো ছোট কেন, জীবন যদি দীর্ঘ হতো, হয়তো হতে পারতাম জজ -ব্যারিস্টার, কিন্তু আজকে যখন নিজের বাড়ির কোনো একটি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, তখন দেখি আমার মাথার চুলগুলো শরৎকালের শিউলি ফুলের মতো সাদা অথবা বলা যেতে পারে নদীর পাড়ের কাঁশফুলের মতোই উড়ছে বাতাসে। আর তখনি মনে হয় চুল পাকিলে কাঁদি কেন। মনে হয় রবি ঠাকুরের গানের একটি কঠিন সত্য চরণ “এবার আমারতো যেতে হবে।”

যেতে যে হবেই। সেটি নিশ্চিত। আরো নিশ্চিত যাবার আগে কিছুদিন হয়তো চোখে দেখবো, ফুটবল মাঠের একটি হলুদ কার্ড। শেষ দিন অবশ্য এক রেফারি হাতের লাল কার্ড দেখিয়ে বলবে, “তবে এবার যে যেতে হবে।” [রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্বের গানের একটি চরণ।]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App