×

বিশেষ সংখ্যা

গ্রন্থমেলা আন্দোলনের পুরোধা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৫:৩০ পিএম

শুধু গ্রাম বাংলা নয়, শহর জীবনও তাঁর কাহিনীতে প্রাণময় হয়ে উঠেছে বিচিত্র পটভূমিকায়। ইতিহাস নির্ভর সামাজিক উপন্যাস ‘অনেক সূর্যের আশা’ এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপাদানে রচিত তাঁর একটি বৃহৎ উপন্যাস ‘বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ’। নগরীর সুরম্য অট্টালিকার পাশে অগণিত বস্তিবাসী মানুষের জীবন ও জীবিকার এক চমকপ্রদ আলেখ্য তাঁর রচিত সর্বশেষ উপন্যাস ‘কদম আলিদের বাড়ী’। এই উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় বহুল প্রচারিত একটি সাপ্তাহিকীতে। খেটে খাওয়া নিরাশ্রয়ী মানুষের এক অনুপম চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর এই নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটিতে। সরদার মূলত কথাশিল্পী হলেও সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গন তাঁর পদচারণায় মুখরিত হয়েছে। কবিতা, ছড়া এবং কিশোর সাহিত্যে তাঁর অবদান অনুল্লেখ্য নয়। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা তাঁর ‘উল্টো রাজার দেশ’ এবং ‘অবাক অভিযান’ বই দুটি রচিত হয়েছে রূপকথার কাহিনীকে উপজীব্য করে।

পাবনা শহরের অদূরবর্তী কামারহাটি গ্রাম। গ্রামের পাশেই স্রোতস্বিনী পদ্মা। সরদার জয়েনউদ্দীনের জন্ম ১৯১৮ সালে, এই অখ্যাত গ্রামে, এক নিতান্ত সাধারণ পরিবারে। প্রথাগত উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হলেও জীবিকার তাগিদে পারিপার্শ্বিক জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তিনি যে অসামান্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা নিঃসন্দেহে বর্ণাঢ্য বলা যেতে পারে। সৈনিক জীবন থেকে ঠিকাদারি ব্যবসা, বীমা কোম্পানি ছেড়ে সংবাদপত্রে যোগদান তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে করেছে যেমন ঘটনাবহুল, তেমনি বৈচিত্র্যময়।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তিকালে বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের একটি অন্যতম প্রদেশ- যার রাজধানী ছিল ঢাকা। তৎকালীন সেই অনতিবৃহৎ ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে বিদ্যোৎসাহী তরুণদের মধ্যে সৃষ্টি হলো সৃজনশীল কর্মতৎপরতা। নতুন আশা ও উৎসাহে উদ্বেলিত সরদার জয়েনউদ্দীনসহ অন্যান্য সাহিত্য ও শিল্পানুরাগী কর্মীরা ঢাকায় এসে দেখলেন বেঁচে থাকার তেমন কোনো অবলম্বন নেই।

জীবিকার তাগিদে তাঁরা সচেষ্ট হলেন বিভিন্ন পেশায়। সেনাবাহিনী থেকে অবসরকালীন প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে জয়েনউদ্দীন শুরু করলেন শিশু শিক্ষার উপকরণ শ্লেটের ব্যবসা। তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে তাঁর ব্যবসা মার খেল। শুরু করলেন ঠিকাদারি, ক্যান্টনমেন্টে মালামাল সরবরাহের কাজ। ব্যবসায়িক চাতুর্য ও কূটকৌশলের অভাবে সে ব্যবসায়ও তিনি ব্যর্থ হন। যোগ দিলেন সংবাদপত্রে। প্রথমে তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার, পরবর্তীকালে একে একে দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক ইত্তেহাদ, বাংলা একাডেমি এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে।

জীবিকা অর্জনের পাশাপাশি সরদার স্বীয় জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন বিচিত্র প্রেক্ষাপটে, কখনো আনন্দে, কখনো বেদনায়, কখনো অপমান উপেক্ষায়, আবার কখনো সম্মানের বরমাল্যে। গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি, তাই গ্রামের মানুষকে নিয়ে রচিত তাঁর গল্প-উপন্যাস পাঠক হৃদয়কে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করে।

এ কারণেই পঞ্চাশ দশকে রচিত গ্রামীণ ক্যানভাসে চিত্রিত তাঁর গল্পগুচ্ছ বিপুলভাবে পাঠকনন্দিত। চেনা চরিত্র এবং চেনা কাহিনীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তাঁর অসাধারণ গল্প সম্ভার। অতি সাধারণ, অতি তুচ্ছ, অতি ক্ষুদ্র অবহেলিত গ্রামের জনমানুষ তাঁর অধিকাংশ গল্পের কুশীলব। তিনি যাদের অন্তরঙ্গ আলোকে দেখেছেন, যাদের নিবিড়ভাবে চিনেছেন, কথাশিল্পে সেসব চরিত্র নিয়ে তাঁর কায়কারবার।

গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-আকাক্সক্ষা সুনিপুণভাবে বিধৃত হয়েছে তাঁর লেখনীতে। তাঁর রচিত গল্পগ্রন্থ ‘নয়ন ঢুলী’, ‘বীরকণ্ঠির বিয়ে’, ‘খরস্রোত’ ইত্যাদি গ্রামীণ জনজীবনের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। ‘নীল রং রক্ত’ উপন্যাসটিতে সুনিপুণভাবে বিধৃত হয়েছে পাবনার নীলচাষি ও দেশীয় অত্যাচারী ভূস্বামীদের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের কাহিনী। ইতিহাস নির্ভর এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন বলা যেতে পারে।

শুধু গ্রাম বাংলা নয়, শহর জীবনও তাঁর কাহিনীতে প্রাণময় হয়ে উঠেছে বিচিত্র্য পটভূমিকায়। ইতিহাস নির্ভর সামাজিক উপন্যাস ‘অনেক সূর্যের আশা’ এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপাদানে রচিত তাঁর একটি বৃহৎ উপন্যাস ‘বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ’। নগরীর সুরম্য অট্টালিকার পাশে অগণিত বস্তিবাসী মানুষের জীবন ও জীবিকার এক চমকপ্রদ আলেখ্য তাঁর রচিত সর্বশেষ উপন্যাস ‘কদম আলিদের বাড়ী’।

এই উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় বহুল প্রচারিত একটি সাপ্তাহিকীতে। খেটে খাওয়া নিরাশ্রয়ী মানুষের এক অনুপম চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর এই নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটিতে। সরদার মূলত কথাশিল্পী হলেও সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গন তাঁর পদচারণায় মুখরিত হয়েছে। কবিতা, ছড়া এবং কিশোর সাহিত্যে তাঁর অবদান অনুল্লেখ্য নয়। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা তাঁর ‘উল্টো রাজার দেশ’ এবং ‘অবাক অভিযান’ বই দুটি রচিত হয়েছে রূপকথার কাহিনীকে উপজীব্য করে।

‘টুকুর ভূগোল পাঠ’ এবং ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’ দুটি বই-ই শ্রেষ্ঠ কিশোর সাহিত্য হিসাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’ কিশোর উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট আমাদের দেশবাসীর মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ। লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার অলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে মূর্ত হয়ে উঠেছে একাত্তরের সেই রক্তরাঙ্গা দিনগুলো। সরদার জয়েনউদ্দীনের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ষোলোটি। এ ছাড়াও তাঁর প্রভূত ছড়া ও কবিতা, এমনকি ছোট গল্প বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নানা পত্রপত্রিকায়।

সাহিত্যকৃতি ছাড়াও ইতিহাসে প্রয়াত সরদার জয়েনউদ্দীনের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের গ্রন্থমেলা আন্দোলনের প্রবর্তক, পথ প্রদর্শক ও প্রধান সংগঠক হিসেবে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান একটি নিবন্ধে (একুশে বইমেলার গোড়ার কথা, প্রথম আলো, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭) বাংলাদেশের গ্রন্থমেলা প্রসঙ্গে যে বিবরণ দিয়েছেন, তা যেমন চমকপ্রদ তেমনি কৌতূহলোদ্দীপক।

গত শতাব্দীর ষাট দশকের প্রথম দিকে সরদার জয়েনউদ্দীন বাংলা একাডেমি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োজিত ছিলেন। তখন বাংলা একাডেমিতে প্রচুর বিদেশি বই সংগৃহীত হয়েছিল। এর মধ্যে একটি বই যার নাম ‘ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড অব বুকস’ পড়তে গিয়ে দুটি শব্দ সরদার জয়েনউদ্দীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শব্দ দুটি হলো- ‘বুক’ এবং ‘ফেয়ার’ অর্থাৎ ‘গ্রন্থ’ এবং ‘মেলা’। এত কিছুর মেলা হয়, বইয়েরও যে মেলা হতে পারে, এ বইটি পড়েই তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন।

ইতোমধ্যে ইউনিসেফের শিশু গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করার পর তাঁর ইচ্ছে হলো বিষয়গুলো নিয়ে তিনি একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করবেন। এরপর মনে করলেন প্রদর্শনী নয়, এর চেয়ে বরং একটি শিশু গ্রন্থমেলার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিশু-কিশোর, ছাত্রছাত্রীদের বই পড়ায় অনুুপ্রাণিত করতে হবে।

তাঁর এই সদিচ্ছাকে বাস্তবে রূপায়িত করার লক্ষ্যে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির নিচতলা) তিনি একটি শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। যতদূর জানা যায় ১৯৬৪ সালে অনুষ্ঠিত এটিই বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা।

বইয়ের অসীম শক্তি যা মানুষের মেধা ও মননকে বিকশিত করে। সরদার জয়েনউদ্দীন যথার্থ উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশের মানুষ যত বই পড়বে দেশ ও জাতি তত উন্নত হবে। ১৯৭০ সালে তিনি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, সুধীজন পাঠাগার, নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহায়তায় নারায়ণগঞ্জে একটি বইমেলার আয়োজন করেন।

এই বইমেলায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম প্রমুখ। প্রচুর দর্শক সমাগম ও ক্রয়-বিক্রয়ে মেলা সাফল্যমণ্ডিত হয়। এই মেলায় একটি গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে রাখা হয়েছিল- ‘আমি বই পড়ি না’। জনসাধারণের কাছে কৌতুকী বা হাস্যকর মনে হলেও বিষয়টি যথার্থ ইঙ্গিতবাহী।

সরদার জয়েনউদ্দীন ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তানে রিসার্চ অফিসার হিসাবে যোগদানের পর সহকারী পরিচালক পদে থাকাকালীন বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এই প্রতিষ্ঠানের নতুন নামকরণ করা হয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই হলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। মূলত জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে সরদার জয়েনউদ্দীনের কর্মজীবনের গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা।

১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সরদার জয়েনউদ্দীন যখন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক তখন ইউনেস্কো এই বছরকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই উপলক্ষে একই বছর ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ইউনেস্কোর সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা এবং সরদার জয়েনউদ্দীনের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় অনুষ্ঠিত হয় সপ্তাহব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলা।

এই মেলায় ব্যবহৃত বিজ্ঞাপনটি ছিল ‘সবার জন্য বই’। স্বল্প পরিসরে মেলায় বইয়ের বিক্রেতা ও প্রকাশক হিসেবে অংশগ্রহণ করে মুক্তধারা প্রকাশনী, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স ও বর্ণ মিছিল। পরবর্তীকালে যুক্ত হয় নওরোজ কিতাবিস্তান, খান এ্যান্ড ব্রাদার্স, চট্টগ্রামের বইঘরসহ বাংলা বাজার ভিত্তিক বিভিন্ন পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহ।

এভাবেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা। যা ক্রমান্বয়ে আজ বৃহত্তর পরিসরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। কয়েকশ বই বিক্রেতা ও প্রকাশনা সংস্থার অংশগ্রহণে লেখক, প্রকাশক, পাঠক ও দেশ-বিদেশ থেকে আগত সাহিত্যানুরাগীদের মহামিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কর্মকাণ্ডে এক নবতর প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। দেশ বিদেশে গ্রন্থমেলা আয়োজনের মাধ্যমে সরদার জয়েনউদ্দীন বাংলা ভাষা ও স্বদেশের গ্রন্থাবলিকে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছাকাছি নিয়ে আসার এক অনন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। সমগ্র বাংলাদেশে বই পড়ার অভ্যাসকে লোকপ্রিয় করার লক্ষ্যে প্রায় এককভাবে গড়ে তোলেন গ্রন্থমেলা আন্দোলন।

চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর প্রভৃতি শহরে তাঁর সক্রিয় সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় গ্রন্থমেলা। মেলার সাফল্য লেখক, প্রকাশক ও পাঠক মহলে এক অভূতপূর্ব প্রেরণার সৃষ্টি করে। ভেবে আনন্দিত হই, প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী বইমেলা পৃথিবীর আর কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে আমাদের মাতৃভাষার জন্য যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁরা কেবল বাঙালির আবেগ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক নন, তাঁদের অবদান আজ বিশ্বের সকল ভাষাভাষী মানুষের গৌরবদীপ্ত ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে।

১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে, যা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকে গৌরবান্বিত করেছে। জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্ত ও স্বীকৃতি বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারসহ সব শহীদের আত্মাহুতিকে বিশ্বের সব ভাষার মানুষের কাছে স্মরণীয় ও মহিমান্বিত করেছে।

বিশ্বে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান চর্চা ও গ্রন্থের পরিচিতি সম্প্রসারণের জন্য সরদার জয়েনউদ্দীন জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে বিশ্ব গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নেও তাঁর যাওয়া প্রায় ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ১৯৭৮ সালে অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ ওএসডি হিসেবে তাঁকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।

টেক্সটবুক বোর্ডে রাতারাতি এই বদলির কারণ তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জেনে যেতে পারেননি। কালের ধুলায় সরদার জয়েনউদ্দীনের নামটি আজ বিবর্ণ, বলতে গেলে বিস্মৃতপ্রায়। ইতিহাসের সত্য পাঠের প্রয়োজনে নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রন্থমেলা আন্দোলনে তাঁর অতুলনীয় অবদানের কথা তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

আমৃত্যু সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত, গ্রন্থমেলা আন্দোলনের নিরলস কর্মী সরদার ১৯৮৬ সালের ২২ ডিসেম্বর এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ কৃতিত্ব এবং সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি লাভ করেছেন বিভিন্ন পুরস্কার-আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, উত্তরা ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার। কিন্তু তাঁর কর্মবহুল জীবনে যে সর্বোত্তম পুরস্কারটি তিনি অর্জন করেন, সেটি হলো গ্রন্থপ্রেমী বিদগ্ধ পাঠক মহলের সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App