×

বিশেষ সংখ্যা

ঐতিহ্য ও আধুনিকতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:৩৫ পিএম

ঐতিহ্য ও আধুনিকতা

মৃৎশিল্পের গবেষণায় নতুন দৃষ্টিতে এবং এনথোগ্রাফিক ফিল্ডওয়ার্কভিত্তিক কাজ আমাদের দেশে আমরা করিনি- করেছেন বাংলাদেশ-প্রেমিক মার্কিন লোকশিল্প গবেষক অধ্যাপক হেনরি গ্লাসি। অথচ বাঙালি জীবনে মৃৎশিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অধিষ্ঠিত। কৃষিজীবী বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনে মাটির বাসন-কোসন, হাঁড়ি-পাতিল-কলসি-মালসা, মাইট-মটকি-কোলা-খোরা-রাইঙ্গ-পিদিমদানি আরও কত বিচিত্র উপাদান দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হতো এবং এখনও হয়। অতএব আমাদের জাতিতাত্ত্বিক বাস্তব জীবনযাত্রার সঙ্গে মৃৎশিল্পের সম্পর্ক যেমনি প্রাচীন তেমনি খুব ঘনিষ্ঠও বটে। আমাদের বিশাল গ্রামবাংলায় এর চাহিদাও প্রচুর। মৃৎশিল্পের এই বিপুল চাহিদার সঙ্গে উপযোগিতার যোগ রয়েছে।

বাঙালি কবি, শিল্পী, সঙ্গীতপ্রিয়, আড্ডাবাজ, আবেগপ্রবণ, হুজুগ-প্রিয়, রাজনীতি পাগল এবং বুদ্ধিমান হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া গোখলের সেই কথিত ঐতিহাসিক উক্তি, What Bengal thinks to-day, rest of India thinks tomorrow. (Gopal Krishna Gokhlae) বাঙালি জাতিকে তার চিন্তার সম্মুখগামিতার ক্ষেত্রেও বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। এ সবই হলো বাঙালির উজ্জ্বল উত্তরাধিকারের পরিচয়বাহী চিহ্নসমূহ। ইতিহাসে বাঙালির নিন্দার দিকটাও কম ভারি না, তবে সে প্রসঙ্গ আমাদের এ লেখার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়।

দুই.

We have to turn our attention first of all to the artist himself.- Franz Boas আমরা বাঙালির ‘লোকশিল্প’ বিষয়ে বর্তমান রচনাটির বয়ন, অন্তর্বয়নের সূত্রে এর সংজ্ঞা-সূত্র, অর্থ-জিজ্ঞাসা, নান্দনিকতা ও ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা এবং মানবিক ও সাংস্কৃতিক বাঙ্ময়তার প্রবহমানতাকে স্পর্শ করে যেতে চাই। বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের বিষয়কে নানা জটিল তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত অনুপুুঙ্খতায় বহুমাত্রিকভাবে বুঝবার চেষ্টা করা হয়।

আমরা সে রকম বিশদ তর্ক-তদন্ত কণ্টকিত পথেও পদচারণা প্রত্যাশী নই। বরং ঐতিহ্য অন্বেষায় সমাজ পরিবর্তনের অভিঘাতে লোকশিল্পের রূপান্তর প্রক্রিয়ার ধরনকে সামনে আনার চেষ্টাকেই সঙ্গত বিবেচনা করছি।

ফলে আমাদের আলোচনায় সিনক্রনিক (Synchronic) পদ্ধতি গুরুত্ব পাবে, তবে সাম্প্রতিক লোকজীবনের (Folklife) ভাষ্যকারদের মতো সিনক্রনিক বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে আমাদের বয়ান শুধু ‘স্মল সেটিং’ (small setting) অর্থাৎ লোকশিল্পের কারখানা যন্ত্রপাতি, উপাদান-উপকরণ ও উৎপাদনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এবং লোক ও কারুশিল্পীদের জীবন ও তাদের শিল্পের সম্পর্কে নির্ভর হবে না।

আমরা ‘বিগ সেটিং’ (Big Setting) অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট শিল্পের পরিবেশ পরিপ্রেক্ষিত পারিপার্শ্বিকতা কীভাবে এর বিকাশে অপরিহার্য হয়ে ওঠে তার ওপরও আলোকপাত করার প্রয়াস পাব। এই ধরনটিকে প্রসঙ্গসূত্র-নির্ভর (Contextual study) গবেষণা বলা হয়। এতে context বা আরও স্পষ্ট করে বললে সংশ্লিষ্ট পটভূমির (relevant context) আলোকে লোকশিল্পের বিশ্লেষণ করা হয়।

সিনক্রনিক গবেষণায় micro study প্রাধান্য পায়। তবে লোক শিল্পকলার বিশেষ অর্থ (Meaning), ক্রিয়াকরণ (function), তাৎপর্য এবং যে সামাজিক রুচি ও নান্দনিক মূল্যবোধের ফলে এ শিল্পকলার ঐতিহ্য সংলগ্নতা বিশেষ গোষ্ঠী বা সমাজের (community) কাছে মূল্যবান সে সমাজের চিন্তা-চেতনা আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্ববীক্ষা (world view) নিরপেক্ষভাবে প্রকৃত ব্যাখ্যাবিচার (interpretation) বস্তুনিষ্ঠ ও প্রকৃত বাস্তবতায় (empirical reality) উদঘাটিত হয় না।

গবেষকের জন্য এ ক্ষেত্রে শুধু একপাক্ষিক ফিল্ডওয়ার্কই যথেষ্ট নয়। তার তথ্যদাতা সক্রিয় ঐতিহ্যবাহী (active tradition bearer) এবং গবেষক নিষ্ক্রিয় ঐতিহ্য-প্রেমিক (passive tradition bearer)। দুজনের অব্যাহত সংলাপের মাধ্যমেই বিশেষ কোনো লোকশিল্পের সামগ্রিকতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। লোকশিল্পের চর্চা লোকশিল্পীর জীবনচর্চাও বটে। মার্কিন নৃবিজ্ঞানী বোয়াস এ কথা বহু আগে বললেও ১৯৬০-এর দশকের আগে পশ্চিমী বিশ্বের, বিশেষ করে মার্কিন দেশের ফোকলোর তথা লোকশিল্প চর্চায় এ প্রয়াস সফল হয়নি।

তিন. ফোকলোরের একটি ভাগকে বলা হয় বস্তুগত লোকসংস্কৃতি বা Material Culture. সাংস্কৃতিক উপাদানকে এখন Artifact হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। লোকশিল্প (Folkart) এই Artifact-এর অন্তর্গত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট লোকশিল্প গবেষক ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা বারবারা এ ব্যাবকক (Barbara a Babcock) বলেছেন, The word (arte + factum) literally means something made by skill or craft and may refer to any artifDcial product. In common usage artifact denoted an object manufactured or modified by human hands. (Folklore, Cultural Performances and Poplular EntertainmentsÑEd. Richard Bauman. P. 204. Oxford University Press (1992).

সভ্যতার প্রাচীনতার কারণে আমাদের দেশে লোকশিল্প বিচারের ধরনটি ইতিহাসের পটে স্থাপিত (diachronic)। এ ধরনের বিশ্লেষণ প্রকৃত প্রস্তাবে জটিল এবং গভীরতর বলে আমরা সহজ পন্থা হিসেবে বিবরণমূলকতার ওপরই নির্ভর করি। এ পদ্ধতির চর্চায় জাতীয়তাবাদী ও রোমান্টিক চেতনার কালের আবেগ ও প্রাক্তনের স্মৃতি (Nostalgia) যুক্ত হয়ে লোকশিল্পের একটা মেসেজ দেয় বটে তবে তা নিতান্তই ঐতিহ্যগর্ব ও স্টেরিওটাইপ (stereotype)-জাত।

এ ধারার গবেষণায় বিশেষ শিল্পকলার রূপান্তর, বিন্যাসগত ভিন্নতা বা ক্রিয়াগত (Functional) পরিবর্তনের চিত্র উন্মোচনের সুযোগ থাকে না। কিন্তু সমাজ এমনকি ঐতিহ্যগত সমাজেরও পরিবর্তন হয়। এ প্রক্রিয়ায় লোকশিল্পকলাও পরিবর্তিত হয়।

আসলে লোকশিল্পকলার নতুন সামাজিক রুচি ও মূল্যবোধের পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। এ জন্যই মার্কিন ফোকলোর বিজ্ঞানী প্রফেসর ব্যারে টোয়েলকেন বলেছেন, ‘ফোকলোর’ স্থবির নয়, জঙ্গম (dynamic); শুধু স্থবিরতা (Stability) নয় পরিবর্তনও এতে লক্ষ্যযোগ্য। এর নানা উদাহরণ আমরা এ লেখায় তুলে ধরব।

গুরুসদয় দত্ত ও অজিত মুখার্জি আমাদের লোকশিল্পের উদ্ভব খুব প্রাচীনকালে বলে মনে করেন। মহেঞ্জোদারো বা মেসোপটেমিয়ার শিল্পকলার সঙ্গে এর সম্পর্কের কথাও বলা হয়। এ বিষয়ে গবেষণা করে সূত্র উদ্ধার খুব সহজ কাজ নয়। তাই প্রত্যক্ষ বিষয় হিসেবে আমাদের লোকশিল্পের উদ্ভবকে পাহাড়পুর-মহাস্থানগড়ের সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত করেই আমরা বিবেচনা করেছি।

কারণ ওই সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পোড়ামটির লোকজজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কিছু কাজ পাওয়া গেছে। শুধু অষ্টম-নবম শতকের বা তার আগের কাজই নয়, ময়নামতি লালমাইয়ে প্রাপ্ত পরবর্তী সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার স্মারক অনন্য শিল্পগুণ সমৃদ্ধ লোকশিল্পকলা বিশেষ করে পোড়ামাটির কাজ বা টেরাকোটা পাওয়া গেছে।

এ ধরনের শিল্পকলার চরমোৎকর্ষের পরিচয় আছে দিনাজপুরের কান্তজি মন্দিরের অপূর্বে নান্দনিকতায় ভাস্বর টেরাকোটা প্লাগের বিন্যাসে। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে কান্তজি মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার সাহায্যে পৌরাণিক যুগ থেকে মধ্যযুগ প্রাক আধুনিক যুগ পর্যন্ত নানা কাহিনী, উপাখ্যান এবং ইতিহাস তুলে ধরা আছে।

টেরাকোটার কাজ বাংলাদেশে কেন এত ব্যবহৃত হয়েছে এবং এ কলারীতিটি এখনও ভিন্ন তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনাময় কেন টিকে আছে তার কারণ বোঝা কঠিন নয়। নির্মাণ ও বস্তুগত উপাদান সৃষ্টিতে ভূপ্রাকৃতিক কারণে বাঙালি শিল্পী ও নির্মাতার প্রধান মাধ্যম হয় ইট ও পোড়ামাটি।

অতএব শত সহস্র বছর টেরাকোটা আমাদের ঐতিহ্যিক বস্তুগত শিল্পকলা ও লোক-ভাস্কর্য হিসেবে টিকে থেকেছে এবং নতুন রূপ ও নতুন চিন্তা চেতনারও প্রকাশ মাধ্যম হয়েছে। মন্দির ও প্রাসাদ অলঙ্করণের ওই লোকজ শিল্প মাধ্যমটি ধর্মীয় আবহের খোলস ছেড়ে ব্যবহৃত হয়েছে ইতিহাসের উপাদান হিসেবেও।

কান্তজি মন্দিরই তার উদাহরণ এই ধারায় একালেও বাংলা একাডেমির বটতলার বেদির তিন দিকের দেওয়ালে আছে এর ব্যবহার। এর উদ্দেশ্য বাঙালির হাজার বছরের ভাষার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাজার বছরের লোকায়ত শিল্পকলার সংযোগে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সুদৃঢ় ভিত্তি নির্মাণের মাধ্যমে আধুনিকতার নবব্যঞ্জনা সৃষ্টি।

অন্যদিকে আবহমান ঐতিহ্যের ব্যবহার করে বেদির সৌন্দর্যে একটা স্বকীয় ও নতুন মাত্রা যোগ করা। বাংলা একাডেমি আরও তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই টেরাকোটা বা পোড়ামাটির কাজের ব্যবহার করেছে একাডেমি সেমিনার কক্ষের দেয়ালে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের একটি বাস্তব মূর্তিকল্প ধরে রাখা হয়েছে পোড়ামাটির কাজে।

এতে ঐতিহ্যের আধারে একালের গণসংগ্রামের চেতনা প্রতিফলিত। টেলিভিশন ভবনসহ কিছু কিছু ভবন ও বাড়িতেও পোড়ামাটির কাজের নতুন ব্যবহার দেখা যাচ্ছে ইদানীং। অতএব, লোকশিল্পকলা, অনড় কোনো ঐতিহ্য শুধু নয়- ধারাবাহিকতায় অন্বিত (Continuity) এক নতুন তাৎপর্য প্রকাশক শিল্প মাধ্যমও হয়ে উঠতে পারে- হয়ে উঠতে পারে বিপ্লবী প্রেরণার উৎস- নতুন সৌন্দর্য সৃষ্টির উপাদান।

চার.

Pottery works in the world. Displaying the complexity of the human condition it brigns the old and the new. The personal and the social the mundane and transcendent into presence and connection.-Henry Glassie.

মৃৎশিল্পের গবেষণায় নতুন দৃষ্টিতে এবং এনথোগ্রাফিক ফিল্ডওয়ার্কভিত্তিক কাজ আমাদের দেশে আমরা করিনি- করেছেন বাংলাদেশ-প্রেমিক মার্কিন লোকশিল্প গবেষক অধ্যাপক হেনরি গ্লাসি। অথচ বাঙালি জীবনে মৃৎশিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অধিষ্ঠিত।

কৃষিজীবী বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনে মাটির বাসন-কোসন, হাঁড়ি-পাতিল-কলসি-মালসা, মাইট-মটকি-কোলা-খোরা-রাইঙ্গ-পিদিমদানি আরও কত বিচিত্র উপাদান দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হতো এবং এখনও হয়। অতএব আমাদের জাতিতাত্ত্বিক বাস্তব জীবনযাত্রার সঙ্গে মৃৎশিল্পের সম্পর্ক যেমনি প্রাচীন তেমনি খুব ঘনিষ্ঠও বটে।

আমাদের বিশাল গ্রামবাংলায় এর চাহিদাও প্রচুর। মৃৎশিল্পের এই বিপুল চাহিদার সঙ্গে উপযোগিতার যোগ রয়েছে। সে বিবেচনায় মৃৎশিল্পের একটি বৃহৎ অংশকে আমরা উপযোগিতাবাদী দ্রব্য (Utilitarian Object) বলতে পারি। প্রাচীনকাল থেকে এ ধরনের মৃৎশিল্প আমাদের জীবনযাত্রার সহায়ক বস্তু হিসেবে গৃহীত হয়ে আসছে।

কিন্তু মানুষ তো শুধু প্রয়োজন মিটিয়েই সন্তুষ্ট হতে পারে না। সঙ্গতি থাকলে তার কিছু শখ ও আনন্দও পূরণ হওয়া চাই। এই বোধ ও চাহিদা থেকেই মৃৎশিল্পের কোনো কোনো উপাদানে হৃদয়ের কিছু রং ও হাতের শিল্পিত কারুকাজ মিশিয়ে নিয়েছে বাঙালি। এর কোনোটায় পড়েছে ধর্মীয় চেতনার ছোপ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিতান্তই মনের মাধুরী মাখানো রেখা ও রং।

পূজায় দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ বা লক্ষ্মীর সরাকে যদি প্রথম শ্রেণিতে ফেলি তা হলে শখের হাঁড়িকে ফেলতে পারি দ্বিতীয় ভাগে। এই দুই উপাদানই বাঙালির চিত্রিত লোকশিল্পের উজ্জ্বল নিদর্শন। মূর্তি নির্মাণ হতো সারাদেশে এবং লক্ষ্মীর সরা ঢাকা ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যেত।

এখনও কোনো কোনো এলাকায় তৈরি হয়। শখের হাঁড়ি তৈরি হতো প্রধানত রাজশাহী অঞ্চলে। জামালপুরসহ অন্য কটি অঞ্চলে শখের হাঁড়ি তৈরি হয়, তবে তার মান তত উন্নত নয়। নকশার আঁকজোঁকে নেই শিল্পিত ও নিপুণ মুন্সিয়ানা।

সামাজিক অগ্রগতি, হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগ ও সস্তায় বিকল্প উপাদান পাওয়া যায় বলে লোকশিল্পের ভুবনে নানা ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। মৃৎশিল্প এক সময়ে প্রধানত ছিল প্রয়োজনের উপকরণ (Utilitirian Object), এবং গ্রামবাংলায় এর ব্যবহার ছিল বিকল্প রহিত।

এখন প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্র এ জায়গা দখল করেছে। এর কারণ এরম দাম খুব বেশি নয়- এগুলো ভঙ্গুর নয় এবং নগদ পয়সা না হলেও পুরনো কাপড়, ধানচাল বা অন্য কোনো জিনিসের বিনিময়েও এসব কেনা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখন মেলামাইনের তৈজসপত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এই পরিবর্তনের ধারায় মৃৎশিল্প কিন্তু বিলুপ্ত হয়নি, এর ধারাটি ক্ষীণ হলেও বিকল্প একটি উৎসমুখ।

তবে প্রয়োজনীয়তার চেয়ে নান্দনিকতা নতুন গুরুত্ব লাভ করেছে। শহর-মফস্বলের উৎসব অনুষ্ঠানে চিত্রিত সরা, ছাইদানি, কলমদান, ফুলদানি, নতুন সামাজিক রুচির উপাদান জুগিয়ে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংযোগ ঘটিয়েছে। নাগরিক ও শৌখিন এই ভোক্তার দিকে লক্ষ রেখে মৃৎশিল্পীরা যেমন কল্পনাসমৃদ্ধ নতুন পণ্য নির্মাণ করছেন তেমনি তার বেচাকেনার কেন্দ্রও গড়ে তুলেছেন শহরের অভিজাত

মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এলাকা এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত পাবলিক প্লেস সাংস্কৃতিক বা শিক্ষাকেন্দ্র সংলগ্ন অঞ্চলে। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, আণবিক শক্তি কেন্দ্র, মিরপুর সড়কের ধানমন্ডি এলাকায় মৃৎশিল্পের এই নতুন পসরা নিয়ে বসেছেন শিল্পী বা ব্যাপারীরা। লোকশিল্পকলার এ রূপান্তরের প্রবল শক্তি ও জাতীয় আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার ঝোঁক ও ক্ষমতাকেই তুলে ধরে।

তবে মাঠ পর্যায়ে দেখা যায় এ পেশাজীবী সম্প্রদায় তাদের পেশা নিয়ে খুব একটা সুখ বা স্বস্তিতে নেই। কুশলী বয়স্ক শিল্পীরা (Master artist) নবউদ্ভাবনার মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্যপ্রীতি ও পেশাকে টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রুচি অনুযায়ী কাজ করলেন।

ঐতিহ্যপ্রেমিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নতুন রুচির চাহিদা মেটাতে যেয়ে তাদের পুরনো ধারার কাজ বিশেষ করে মূর্তিকলা নির্মাণে যে গভীরতর অন্বেষার সুযোগ ছিল তা কমে আসছে। পেশার সম্ভাবনা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ আস্থায় ফাটল ধরায় নতুন প্রজন্মকে ভিন্ন পেশায় ঠেলে দিচ্ছেন।

হাঁড়িকুড়ির যে বিপুল বাজার ছিল শিল্পিত পণ্যের বাজার তত বিরাট নয়। বেশি পুঁজি, পৃষ্ঠপোষণা ও মধ্যস্বত্ব লোপ করে এদের জন্য কোনো সংগঠিত উদ্যোগ নেওয়া হলে মৃৎশিল্প নতুনভাবে হয়তো বিন্যস্ত হতে পারে। শহর ঢাকার রায়ের বাজার এবং সাভার ও ধামরাইয়ের কিছু অঞ্চল যেমন কাকরান কাগজিপাড়া, শিমুলিয়া প্রভৃতি গ্রামে এ পেশা সঙ্কুচিত অবস্থায় বিদ্যমান।

দেশের অন্য অঞ্চলের চিত্র ভিন্ন নয়। ক্ষুদ্রঋণ ও আনুষঙ্গিক সুবিধা পেলে শিল্পের নতুন অবস্থা ও অবস্থানকে তারা সুবিন্যস্ত করতে পারেন।

মৃৎমিল্পের সঙ্গেই পুতুলের কথা আসে। আর পুতুল যে কোনো জাতির জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও বোধহয় কথাটা বলেছেন বলে মনে পড়ে। তাঁর বক্তব্যের সার কথা ছিল একটা জাতিকে বুঝতে হলে সে জাতির পুতুল অধ্যয়ন দিক-নির্দেশক হতে পারে। আমাদের পুতুলও খুব প্রাচীন।

শিল্পবোদ্ধা এবং সমাজ ও নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা পুতুল প্রাক-আর্যযুগের আদিবাসী মানুষের হাতে তৈরি। গুরুসদয় দত্ত মনে করেন কোনো কোনো পুতুলের সঙ্গে আনুমানিক ৪৫০০ খ্রি.পূ. মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার পুতুলের মিল রয়েছে। পুতুল তৈরির পেছনে জাদু বিশ্বাস, ইচ্ছাপূরণ ও শত্রু নিধনের সম্পর্ক আছে। জাদু বিশ্বাসের একটা ধারায় দেখা যাচ্ছে ফসল ধ্বংসকারী জন্তুকে হত্যা করার অভিনয় করছে মানুষ।

বিশ্বাস, এতে শত্রুর বিনষ্টি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এ বিশ্বাস বর্তমান কালেও ভিন্ন প্রতীকী মর্যাদায় চালু রয়েছে রাজনীতির মতো একটি আধুনিক ক্ষেত্রে। আমরা ১৯৭১-এ ইয়াহিয়ার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছি। গণআদালতের বিচার উপলক্ষে দাহ করা হয়েছে রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমের কুশপুত্তলিকা। কোন কালের সে প্রাচীন বিশ্বাসের অর্থ-বিস্তৃতি ও তার সঙ্গে নতুন অর্থ বা ব্যঞ্জনা যুক্ত হয়েছে। লোকশিল্পকলার এ এক তাৎপর্যপূর্ণ অবদান।

সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পট পুতুলের বাঙলা’ বইয়ে বলেছেন, ‘বাঙলার মাটির পুতুলকে লক্ষণ, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি দিক দিয়ে বিচার করে মোটামুটি দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। প্রতীকধর্মী বা সিম্বলিক, আর বাস্তবধর্মী বা ন্যাচারালিস্টিক। প্রত্নবস্তুর মধ্যে পাওয়া পুতুলগুলো প্রায় সবই প্রতীকধর্মী। এই পুতুলে কোনো ছাঁচ লাগে না। হাতে টেপা পুতুল হিসেবে এর পরিচিতি।

বাংলাদেশের ফরিদপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, মাদারীপুর, জামালপুর, রাজবাড়ির রামদিয়া ও ময়মনসিংহ শহর সংলগ্ন বলাশপুরে পুতুল তৈরি হয়। ইচ্ছা পূরণের জন্যও মাটির পুতুল উপযোগী উপকরণ। সাভারে ঘোড়াপীরের মাজারে মানতের ঘোড়ার পুতুলের স্তূপ লক্ষণীয়।

মাটির পুতুল ছাড়া কাঠের চিত্রিত মনোলোভ পুতুল তৈরি হতো সোনারগাঁওয়ে। মাটির পুতুলে হিউম্যান ফিগারের প্রাধান্য, মানুষের পরেই আসে ঘোড়া, অন্য জীবজন্তুও তৈরি হয়। সোনারগাঁওয়ের কাঠের পুতুলে হাতি-ঘোড়াই শুধু আঁকা হয়। এ পুতুল ছিল অতি বিখ্যাত।

বিসিক কাপড়ের পুতুলের ব্যাপক প্রচলনকে নান্দনিক শোভনতায় নতুন রূপ দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করেছে। এককালে যা ছিল শিশুতোষ খেলনা এখন তা গৃহসজ্জার চমৎকার উপকরণ। জাতীয় জাদুঘরে সাকিনা খাতুনের পুতুলের মাধ্যমে নজরুলের বাল্য ও যৌবনকালের চিত্রণ অনিন্দ্যসুন্দর।

পটচিত্রও বাঙালির লৌকিক শিল্পকলার এক চমৎকার নিদর্শন। প্রাচীন এই শিল্পকলা, এক সময়ে বিপুল আলোড়ন তুলেছিল সারা বঙ্গদেশে। শুধু বঙ্গদেশ কেন ভারত, চীন, তিব্বত এই বিশাল ভূভাগে পটচিত্রের প্রচলন ছিল বলে জানা যাচ্ছে। আমাদের উপজাতীয় সমাজ, বৌদ্ধ আর জৈন সম্প্রদায় সবার মধ্যেই পটচিত্রের ব্যবহার ছিল। শিল্পগুরু নন্দলাল বসু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চীন সফরে যেয়ে বাংলার পটচিত্রের মতোই বৌদ্ধ চিত্র দেখতে পান।

পটচিত্র অনার্যদের উদ্ভাবনা। এই শিল্প প্রাচীন এবং বহু ধর্মের ভেতরে অন্তঃপ্রবিষ্ট। বাংলার বৌদ্ধ-হিন্দুর পটচিত্রের প্রাচীনতার কথা বলেছি। হষবর্ধন, চন্দ্রগুপ্তর রাজত্বকালে পটচিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। আরও বহু আগে থেকে এ পটচিত্রের শুরু। কার্পাস বস্ত্রে ছবি এঁকে গল্পের বা আখ্যানের আকারে তা পড়ে শোনানো হতো। কখনও কখনও বাড়ি বাড়ি গিয়ে কখনও গ্রামের সাধারণ লোক জমায়েতের স্থলে, কখনও বা হাটে।

লম্বা, গুটানো কাপড়ে হাতে আঁকা ছবিই পট। এতে থাকত দেবদেবীর কাহিনী, পৌরাণিক আখ্যান, ধর্ম ও নীতি প্রচারমূলক চিত্র। পটচিত্র লোকের ধর্ম পিপাসা যেমন মিটাত তেমনি লোকশিক্ষারও উপায় হয়ে উঠেছিল। পটচিত্রকলায় ধর্ম ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রভাব যেমন পড়েছিল তেমনি শেষ দিকে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রখর সমাজ সমালোচনা। বাংলার মুসলমানেরাও এ চিত্রকলার বাইরে থাকতে পারেনি।

গাজীর পট তার প্রমাণ। আসলে বাংলার মুসলমানেরা বহু ক্ষেত্রেই হিন্দুদের অনুষ্ঠান পর্বের প্যারালাল তৈরি করেছে। গাজীর পটের উদাহরণ। পটচিত্রকলা এক সময়ে শহর দখল করেছিল তার প্রমাণ ঢাকা শহরের পাটুয়াটুলি সড়ক। আর ইংরেজ আমলে কলকাতার কালীঘাটের পট তো বাস্তবতার অসামান্য দক্ষতা ও সামাজিক অনাচারের সমালোচনায় বিশ্বখ্যাতি পেয়েছিল।

বাঙালির চিত্রকলায়ও এর প্রভাব পড়েছে। স্ক্রলচিত্র নির্মাণের ধারাও পটচিত্রের প্রভাবজাত। জয়নুলের ‘মনপুরা’ শীর্ষক বিশাল স্ক্রল চিত্রটি পটচিত্রের আঙ্গিকে করা। সম্প্রতি বাংলাদেশের শিল্পী রুহুল আমিন কাজল ডেনমার্কে দীর্ঘতম পথচিত্র এঁকে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এ চিত্রের ধরনও তো পটচিত্রের মতোই দীর্ঘ, তবে তার মৌলিক পার্থক্য হলো পটচিত্র গুটানো আর ওই চিত্র প্রসারিত।

একটায় থাকে চিত্রের সঙ্গে কথা ও গান অন্যটায় বাঙ্ময় নকশা (Expressive designs)। কাজল ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘরে এই চিত্র আঁকেন। দেয়াল চিত্রের রীতি ও বিন্যাসও পটচিত্রের মতো। এ চিত্রের নব আবির্ভাব ঘটিয়েছে শহর ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা তাদের শিক্ষালয়ের বাইরের দেয়ালে।

এ চিত্রকলায় এসেছে নতুন আঙ্গিকে ও প্রতীকধর্মী বিদ্রুপ ও ঐতিহ্য অন্বেষার তাগিদে সংগঠিত বাংলা নববর্ষের লোকজধর্মী মিছিল ও সং-এর নাগরিক উত্থানে। মুখোশ, বিশাল হাতি, বাঘ, সাপ লোকগল্পের শিল্পরূপ সব মিলিয়ে বাঙালির নববর্ষের দিনে লোকশিল্পের বিশাল ভোজেরও যেন এক হৃদয়গ্রাহী আয়োজন।

নকশিকাঁথা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে। এরও নানা আধুনিক ও তাৎপর্যময় ব্যবহার আছে। বঙ্গবন্ধুও শিল্পাচার্য ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য আমাদের সংবিধানে এর ব্যবহার করেছেন। বিস্তারে যাবার সুযোগ নেই। এর নবায়ন নতুন নাগরিক রুচির চাহিদা মিটাচ্ছে।

তবে পুরনো নকশিকাঁথার সিম্বল, মোটিফ ও গভীরতর ভাব-ব্যঞ্জনা নতুন কাঁথা শিল্পে তেমন করে নেই। এর ব্যবহারে শৌখিনতাটুকু বেড়েছে, ঝরে পড়েছে sacredness।

প্রাচীন নকশি কাঁথায় পুরাণের পৃথিবীর বহু অনুষঙ্গ আছে, ধ্বংস ও সৃষ্টিচক্রে বিশ্বজগতের চলমানতার প্রতীকী চিত্র ও রূপকল্প সূর্য, পদ্ম, জীবনবৃক্ষ ইত্যাদি পুরনো, ব্যবহৃত জিনিসের মাধ্যমে নবসৃষ্টির প্রেরণা আছে, পারিবারিক বন্ধনকে সংযুক্ত করে রাখার অভীপ্সা আছে- দূরের যাত্রী আত্মীয়কে স্মৃতিময়তায় ধরে রাখার বাসনা আছে- এবং সর্বোপরি দেবদেবীর প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের কাছে মঙ্গল ও কল্যাণের কামনা আছে।

বাঙালির দর্শন, অধ্যাত্মসাধনা, জাদুবিশ্বাস, ইচ্ছা পূরণের সাধনাও বিশ্ববীক্ষার নানা উপাদানে কাঁথা অনন্য বহু অর্থ, প্রতীক ও গূঢ় অর্থ ব্যঞ্জনা ঋদ্ধ এ গভীরতর লোকশিল্পটি নিরক্ষর গ্রামীণ মহিলাদের এক বিস্ময়কর শিল্প কুশলতার ফসল।

বাংলার লোকশিল্পের এক শক্তিশালী বিষয় আলপনা চিত্র। নকশিকাঁথার মতোই এ শিল্পটি আমাদের কৃষিজীবী সমাজের মেয়েলি হাতের সৃষ্টি। আচার-অনুষ্ঠান ও ব্রতের সঙ্গে এ লোক কলারীতিটির গভীর সংযোগ। মূলত জাদু বিশ্বাস ও ইচ্ছা পূরণের এ শিল্পটিকে এখন একটি সুখদ সেক্যুলার রূপ দেওয়া হয়েছে।

এ লোকশিল্প রীতিটির নাগরিক উজ্জীবন ঘটেছে সাম্প্রতিককালে। বিয়ের আসর-বাসর তো বটেই, মহান একুশের আগের দিন রাতে শহীদ মিনার ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে বিপুল আলপনা চিত্র করা হয় তা শহীদ দিবসকে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ারই এক চমৎকার নিদর্শন। আসলে ঐতিহ্য যে নতুন ঐতিহ্য নির্মাণ করে এ তারও এক উদাহরণ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App