×

বিশেষ সংখ্যা

সহনশীলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৪:০০ পিএম

সহনশীলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না
সাংবাদিকদের ভুলত্রু টি নেই, এ কথা বলতে চাই না। তাই বলে দায়িত্বশীল হবো না, এটাও কাক্সিক্ষত নয়। মনে রাখতে হবে একজন সাংবাদিক সারাদিন এবং মধ্যরাত পর্যন্ত মাঠে-ময়দানে, অফিস-আদালতে, রাজনৈতিক দলগুলোর পেছনেই কেবল দৌড়ান তাই নয়, তাদের নানান সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, সম্মেলন কিংবা কনভেনশনে দৌড়াতে হয় রিপোর্টার হিসেবে। একটা নয় দুটো নয় হরেক রকম ঘটনাবলীর পেছনে ছুটতে হয়। অনেক সময় দম ফেলারও সময় পান না। কিন্তু যতো জায়গাতেই যেতে হোক না কেন, যতো বিটই কভার করার দায়িত্ব থাক না কেন, তাকে সতর্ক থাকতে হয় সংগৃহীত সংবাদ সম্পর্কে, খুঁজতে হয় সূত্র এবং তার সত্যনিষ্ঠতা যাচাই করেই রিপোর্ট লিখতে হয়। একজন রিপোর্টার বা ফটোগ্রাফার কিংবা ক্যামেরাম্যানকে যতো দ্রুততার সঙ্গেই ছুটতে হোক না কেন, রিপোর্টিংয়ের বিষয় তথ্যাদির যথার্থতা সংগ্রহ করেই রিপোর্ট লিখতে হবে এবং ছবি তুলতে হবে। একজন রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার বা ক্যামেরাম্যান ফাঁকি কিংবা মিথ্যাচার অথবা যে কোনো সংবাদ বিষয়ে যা খুশি তাই লিখবেন, এটা ঠিক নয়। এই পর্যায়গুলো পেরুনো যে কোনো সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব, এ ক্ষেত্রে কোনো গাফিলতি থাকলে আজ না হলে কাল তো ধরা পড়বেই। কারণ আজকাল সংবাদপত্র এতো বেরিয়েছে যে প্রতিযোগিতা নিজেদের মধ্যেও। তাই প্রত্যেকেই সজাগ থাকেন নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে এবং বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার একটা প্রবণতা আবশ্যিকভাবেই সকলেই মনে কাজ করে। খুঁটিনাটি বিষয়ে তথ্য কিংবা সংবাদ সংগ্রহে ফাঁকি দেয়ার জো নেই। তবু সাংবাদিকরা যে কোনো এসাইনমেন্ট কভার করতে গেলে একত্রে ছুটেন, বা ঘটনাস্থলে একত্রিত হন এবং নিজেদের মধ্যে সংগৃহীত বিষয় যাচাই করেও নেন। আবার অনেক সময় রাজনৈতিক বা জনগণ সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ অনেক বেফাঁস মন্তব্য করেন কিংবা তথ্যাদি যাচাই না করেই রাজনৈতিক বক্তৃতাবাজি করেন সাধারণ মানুষ বা শ্রোতাদের শোনানোর এবং নিজের অথবা দলের দিকে টানার জন্য। তারা কথা বলে ফেলেন, কী বললেন, তাও ঠাহর করতে পারেন না। তাই ঐ জাতীয় মন্তব্য, বক্তৃতা, এমনকি সাক্ষাৎকার আলাপচারিতাতে যা বলেন, তাতে যদি গ্রহণযোগ্য যথার্থ বক্তব্যের অভাব থাকে অথবা তারা অন্যায় করে ফেলেন বক্তব্যের মাধ্যমে, তাহলে দেখবেন নেতা-নেত্রী, রাজনৈতিক উচ্চমার্গের ব্যক্তিবর্গও রিপোর্টারের ওপর দোষটা চাপিয়ে দেন। সাংবাদিকের দ্বারা জিজ্ঞাসিত হয়ে অথবা দল থেকে প্রেসরিলিজ পাঠিয়ে বলেন দেন, ‘আমার বক্তব্যটি সঠিকভাবে রিপোর্ট হয়নি’ অথবা বলেন ‘সাংবাদিক সঠিকভাবে আমার বক্তব্য বুঝতে পারেননি।’ অপকর্মের খবর কিংবা ভুল বা অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর বৈরী প্রতিক্রিয়া হলে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অনেকেরই এটা কৌশল। ভুল বা অন্যায় করেছেন, এটা স্বীকার করা হলে অপমানিত হলেন বা তার মর্যাদা খাটো হয়ে গেলো বলে ভাবেন। আবার অন্যায় বা অপ্রত্যাশিত কোনো বক্তব্য দিলে দল বা দলীয় নেতার কাছ থেকেও কথা শুনতে হয়। ‘কেন বলতে গেলেন এসব কথা? এর প্রতিবাদ দিন।’ ফলে জনসংযোগ অফিসারের মাধ্যমে একটা প্রেসরিলিজ পাঠিয়ে সাংবাদিককে অভিযুক্ত করে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু রিপোর্টার যদি সঠিক থাকেন তবে তিনি প্রতিবাদ বক্তব্যের সঙ্গে সেই প্রতিবাদের বিরুদ্ধে তার মতটাও তুলে ধরেন। টেলিভিশন তো রেকর্ড করে তাদের কথা প্রচার করে থাকে, তাদের কাছে ফুটেজ থাকে, সে ক্ষেত্রে কৌশল খাটে না। এমনি ‘ঝুঁকিপূর্ণ রাজনীতি’, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে এই দেশে, কিন্তু অপশাসন, দুঃশাসনের বদৌলতে অথবা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কিংবা আমলাদের কারো কারো কৌশলের কারণে এ ধরনের অভিযোগের সঠিক যাচাইও হচ্ছে না। কিংবা মিথ্যা রিপোর্ট করেছে বলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও সাহস থাকে না ঐসব মন্তব্য বা বক্তৃতা করা মানুষগুলোর। এমনি একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে সাংবাদিকদের দৈনন্দিন চলাফেরা, লেখালেখির কাজ করতে হচ্ছে, তারপরও রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে কোনো প্রকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ নেই। বরঞ্চ বেআইনি ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে লিখতে গেলে যদি মন্ত্রী, এমপি এমনকি ক্ষুদে নেতারাও এফেক্টেড হন, তখন তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। এমনকি প্রাণও যেতে পারে এসব ঘটনায়। কারণ রাজনীতি সম্পৃক্ত ক্ষুদে নেতাকর্মীরাও ক্ষমতার দাপট নিয়ে অথবা বিরোধীদলীয় উপহাস্য চরিত্র নিয়ে অন্যায়-অশোভন কার্যকলাপ চালালেও ‘তারা এটা তাদের অধিকার’ ভাবেন। ফলে ক্ষুব্ধ হন রিপোর্টারদের ওপর এবং সাংবাদিককে হেনস্তা, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করতে দ্বিধা করেন না। ভাবটা হলো তিনি গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব তার অবমাননা সহ্য করার বিষয় নয়, সেক্ষেত্রে একজন সাংবাদিক বা সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের হাত ভেঙে দিলে অথবা যদি মরেও যায়, তাতে তার কিইবা আসে যায়। এসব ক্ষেত্রে সব হেনস্তা অবমাননা সইতে হয় সাংবাদিকদের এবং তাদের মৃত্যু, হত্যা, লাশ হওয়ার খবর ছাপাতে হয় খবরের কাগজে কিংবা টিভির প্রতিবাদী রিপোর্টে। সাংবাদিকের ওপর মামলা হলে দেখা যায় পুলিশ ঐসব দাপুটে নেতা ও দলের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নিতেই চায় না। যদি আদালতে মামলা নিতে কেউ সাহস করেনও, তাহলেও মামলার সুরাহা হয় না। বছরের পর বছর সে মামলা ঝুলতেই থাকে। যশোরের শামসুর রহমান থেকে বগুড়ার দীপঙ্কর চক্রবর্তী, খুলনার হুমায়ুন কবীর বালু কিংবা মানিক সাহার হত্যার বিচার আজো হয়নি। বছরের পর বছর পড়েই আছে। রাষ্ট্রের কোনো তাগিদ নেই। মামলাগুলোর রায় হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি হলে দেশে আজ যার যা খুশি বলার সাহস হতো না। সাংবাদিকদের নিরাপত্তার একটা সুরাহা করতে পারতো সরকারে যারাই থাকুক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিএনপি কি আওয়ামী লীগ সকলেই নিশ্চুপ অবস্থানে। এখানে ওরা কিন্তু এক। কোনো ব্যবস্থা নিলে নিজেদের লোকজনই যে জড়িয়ে যাবে, শাস্তি পাবে! সুতরাং চেপে যাওয়াই ভালো। এইসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি, তার কারণ আরেকটা হলো, সাংবাদিকদের অনৈক্য। সাংবাদিক ইউনিয়ন আছে তবে দ্বিখণ্ডিত। বিভক্ত ইউনিয়নকে কেন ভয় পাবে সরকার। যারা সেই সরকার গঠন করবে, তারা জানে তাদের সমর্থনে একটি গ্রুপ আছে, তো ভয় কি? কেউ আন্দোলন করলে সাংবাদিক সমাজের বিভক্তির কারণে আরেক গ্রুপ রুখে দাঁড়াবে। আমি মনে করি, এই দলীয়করণ সাংবাদিক ইউনিয়ন, সাংবাদিক ঐক্য এবং সাংবাদিক সমাজের সর্বনাশ করেছে। উদাহরণ হলো সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড। এই সাগর-রুনিকে নিয়ে সাংবাদিক ইউনিয়নের দুগ্রুপ এক হয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল, সবাই ভেবেছিলেন এবার বুঝি ফসল ফলবে। না, তাতে মানববন্ধন হলো দিনের পর দিন, বিক্ষোভ হলো গলা উঁচিয়ে বক্তৃতা করলেন দুই গ্রুপের নেতৃবৃন্দ। যদিও জামাতি সাংবাদিক নেতার গলায় জোরটা বেশি ছিল। কিন্তু কোথায় গেলেন সেইসব নেতারা কিংবা সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই গ্রুপ। এক গ্রুপের নেতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক নেতা এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গণমাধ্যম উপদেষ্টা হয়ে যোগ দিলেন, আর অন্য গ্রুপের সোচ্চারকণ্ঠ নেতা এখন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সুরাহা আজো হয়নি। মাছরাঙা টেলিভিশনের কর্মীরা মাঝেমধ্যে মানববন্ধনের নামে রাস্তায় দাঁড়াতেন, তাও বন্ধ হয়ে গেছে... হায়, সাগর-রুনি! আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান শক্তি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী তো বলেই বসলেন, ‘বাসা পাহারা দিতে হবে নাকি’। না, মাননীয়া ঘর পাহারা দিতে হবে না। এসব উদ্দেশ্যমূলক চক্রান্তের হত্যাকাণ্ডগুলোর সুস্থ তদন্ত ও যথার্থ বিচার হতে হবে। রাষ্ট্র তো দেখবে কেন এমন নির্মম নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড হচ্ছে? এর যথাযথ বিচার যদি যথাসময়ে হতো, কালক্ষেপণ না করে গুরুত্ব দিয়ে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করা হতো, তাহলে এই প্রবণতা কমতো। দেশটা তো আমাদের সবার। সাংবাদিকদের একার নয় যেমন, তেমনি সাংবাদিকদের বাদ দিয়েও নয়। অথচ সেইসব সাংবাদিকদের কারণে অকারণে হয়রানি, হেনস্তা, অপমান-অপদস্ত এবং হাত-পা ভেঙে দেয়া কিংবা একেবারে হত্যা করা কি সঠিক ভাবছেন রাষ্ট্র পরিচালকরা? যদি তাই হবে তবে দেশে এতোগুলো খবরের কাগজ এবং টেলিভিশন চ্যানেল থাকতে আবার কেন নতুন নতুন সংবাদপত্র প্রকাশ ও টিভি চ্যানেল চালু করার অনুমতি দিচ্ছেন? এই যে দ্বৈত চরিত্র অথবা দ্বিচারিতা সরকারের, সেটা কেন? দেশে প্রচুর সংবাদপত্র আছে। এক ঢাকা শহর থেকে যতোগুলো দৈনিক আছে, তাতে গিনিজ বুক অব রেকর্ডস-এর নাম ওঠা উচিত। কেউ বোধহয় সে চেষ্টা করেননি বা করতে উৎসাহবোধ করছেন না। জামাত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবি জনগণের। ইতোপূর্বে প্রাক্তন আইনমন্ত্রী জামাতের অস্তিত্ব শেষ বলেছিলেন। বর্তমান আইনমন্ত্রী জানতাম বিচক্ষণ আইনজীবী, তিনি জামাত নিষিদ্ধ করার পথ দেখছেন না। হায়রে দেশ। জিয়াউর রহমান মুজিব হত্যার পর যুদ্ধাপরাধীদের সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে যেমন দিয়েছিলেন তেমনি জামাতকে সক্রিয় করতে গোলাম আযমকে ঢাকা আসার অনুমতি দিয়েছিলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়া তাকে জামাতের আমির বানানোর সুযোগ করে দিলে জামাতের ‘সালামি’ হিসেবে দোস্তি পয়দা হলো। আর দোস্তির বদৌলতে খালেদা জিয়াই একদিন ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক ইউনিয়নকে ভেঙে দুটুকরো করো করে ফেললেন ঐ জামাতি মোহাব্বতের শক্তিতে। পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসনকর্তা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নকে ভাঙতে ‘ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট’ গঠন করলেও টেকাতে পারলেন না। কিন্তু বেগম জিয়া সামরিক শাসক না হয়েও বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজকে বিভক্ত করে সাংবাদিক ইউনিয়ন ভেঙে দিলেন। আজ তাই দলীয়করণের ভোঁতা অস্ত্রে বিভাজিত সাংবাদিক সমাজ কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছেন না বলেই নির্যাতিত নিগৃহীত হচ্ছে সর্বত্র। চাকরিতে যেমন তেমনি পেশার ক্ষেত্রেও। এই খণ্ড সাংবাদিক ইউনিয়ন আজ সর্বত্র তাদের ইউনিটও করতে পারেনি। মালিক জানেন সাংবাদিক না হলে কাগজ বেরুবে না, তবুও তাদের ঐক্যবদ্ধতাকে পাত্তা দিচ্ছে না। সাংবাদিকদের এই ঐক্যহীনতার দুর্বলতার কারণে তাদের নিয়ে যে কেউ যা খুশি বলে পার পেয়ে যাচ্ছেন। অনেকে কাফনের কাপড়ও পাঠিয়ে হুমকি দিয়েছে হত্যার। কী হয়েছে শাস্তি তার? যারা সাংবাদিকদের হেয়প্রতিপন্ন, হত্যা, হয়রানি করেন, করতে চান, তাদের বলতে চাই, সাবধান! সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্টেট। এরা যদি বেঁকে বসে তবে রাষ্ট্রই অচল হয়ে পড়বে। সাংবাদিকরা যদি হাত গুটিয়ে নেন তবে কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিগণ চোখে চোখে সর্ষেফুল দেখবেন। সাংবাদিক গণমাধ্যম কর্মীরা দেশের সেবা করেন, তারা তাই সহনশীল। সহনশীলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App