×

বিশেষ সংখ্যা

সংবাদপত্র, সমাজেরই দর্পণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৫:০৭ পিএম

সংবাদপত্র, সমাজেরই দর্পণ
সংবাদপত্র আদতেই সমাজের দর্পণ। সমাজের সামগ্রিক বিষয়াদি সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রকাশ পায় বলেই সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পণ বলা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রয়াত সাংবাদিক-সম্পাদক আহমেদ হুমায়ূন যথার্থই বলেছিলেন ‘সংবাদপত্রের দায়িত্বই হল চলমান সমাজচিত্রের প্রতিফলন।’ সংবাদপত্রের সমাজ দর্পণ নিয়ে রকমফের-ভেদাভেদ কিংবা বিতর্কও রয়েছে। সমাজ দর্পণে সংবাদপত্রের সংবাদসমূহ গুরুত্বপূর্ণ-অগুরুত্বপূর্ণ, বাছ-বিচারে বিভক্তি যে নেই, তাও কিন্তু নয়। অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কে বড় করে এবং অতি আবশ্যিক বিষয়কে ক্ষুদ্র বা সংকুচিত করে প্রকাশের প্রবণতাও সংবাদপত্রে হরহামেশা আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রকে সমাজের নির্মোহ দর্পণরূপে বির্তক ঊর্ধ্বে অভিহিত করা যায় না। কোনো সংবাদপত্রই কার্যত নিরপেক্ষ নয়। দলীয়-মতাদর্শিকভাবে সংবাদপত্রের ভিন্নতা খুবই স্পষ্ট। অপরদিকে সংবাদকর্মীরাও সমাজের স্বাভাবিক অংশরূপে নিরপেক্ষ নয়। সংজ্ঞা বিচারে নিরপেক্ষতার ভিন্নতা নিশ্চয় রয়েছে। তবে সংবাদপত্র এবং সংবাদকর্মী কেউ যে নিরপেক্ষ নয় এটা স্বীকার করতেই হবে। তবে সত্যনিষ্ঠ, যুক্তি-যৌক্তিকতা এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের ক্ষেত্রে দল ও মতের পক্ষপাতিত্ব সংবাদপত্রের জন্য কখনো শুভফল বয়ে আনেনি এবং আনতে পারে না। এ বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলেই সংবাদপত্র এবং সংবাদকর্মী যতই অনিরপেক্ষ হোক তাতে কিছু আসবে-যাবে না। যদি পেশাগত ভূমিকায় চরম পক্ষপাতের শিকার হয়, তাহলে সংবাদকর্মীর অনিরপেক্ষ ভ‚মিকায় সংবাদপত্র পাঠকের কাছে তার বস্তুনিষ্ঠ-সত্যনিষ্ঠ ও যৌক্তিক দৃষ্টি হারাবে। অর্থাৎ পাঠকপ্রিয়তার পাশাপাশি পাঠকের আস্থা-ভরসা চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হবে। যে কোনো সংবাদপত্রের প্রসার ও বিকাশে প্রধান ভূমিকা পাঠকের। সংবাদপত্রকে নিজগুণে সেটা অর্জন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে পাঠকের আস্থা-বিশ্বাস হারিয়ে সংবাদপত্রের বিস্তার সংকুচিত এবং বিনাশ ঘটে। নীতিজ্ঞান বা Ethics,, দর্শনের সংজ্ঞা সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে সংবাদকর্মীর করণীয় নির্ধারণে ভ‚মিকা রাখে। আচরণ মান নির্ধারক বিজ্ঞানসম্মত আচরণ স্বনির্ধারিত এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। Ethics বা নীতি জ্ঞানের যুক্ততায় স্ব-আরোপিত বিধান এবং স্বকার্যকরণের সম্পর্ক রয়েছে। সেটা অস্বীকার করা যাবে না। সংবাদকর্মীর নৈতিকতা (Ethics of Journalism) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নৈতিকতা এবং সংবাদকর্মীর বস্তুনিষ্ঠতা-সত্যনিষ্ঠতা অতি আবশ্যিক প্রপঞ্চ। দর্শন শাস্ত্রের এই নৈতিকতা নির্ধারণের মাপকাঠি রূপে সংবাদকর্মীর ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, প্রাসঙ্গিকতা-অপ্রাসঙ্গিকতার বিচারবোধ তৈরি করে। এই বিচারবোধের বাধ্যবাধকতার মানদণ্ডে সংবাদকর্মীকে নিরপেক্ষতার পথ পরিক্রমণে অনেকটা বাধ্য করে। সংবাদকর্মী যতই অনিরপেক্ষ হোক না কেন সংবাদ গ্রহণ-বিশ্লেষণে সত্যনিষ্ঠ, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের তাগিদ এড়াতে পারে না। তাকে সত্য-সুন্দরের অভিযাত্রায় শামিল হতেই হয়। সংবাদপত্র নিশ্চিতভাবে সমাজের অতন্দ্র প্রহরী (Watchdog)। এই অতন্দ্র প্রহরীর পাহারায় কিন্তু সর্বদা নিয়োজিত পাঠক। সংবাদপত্রের লক্ষ্য ও কর্তব্য এ ধরনের পাঠক সৃষ্টি করা। যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি-উন্নয়ন এবং সর্বোপরি সংবাদপত্রের জনস্বার্থের ভ‚মিকা পালনে বাধ্য করবে। তাতে দল ও মতের ঊর্ধ্বে সমাজের প্রকৃত দর্পণ রূপে সমাজের সঠিক চিত্র সংবাদপত্রে প্রকাশ করবে। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রের অসঙ্গতি সম্পর্কে পাঠক জানতে ও বুঝতে পেরে সচেতনভাবে অসঙ্গতি নিরসনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ কেবল নয়, আবশ্যিক এবং অনিবার্যও বটে। দেশের সাংবাদিক সমাজ শাসক শ্রেণির প্রধান দুই মেরুর ন্যায় বিভক্ত। পূর্বেই বলেছি সংবাদকর্মীরা বিদ্যমান ব্যবস্থায় নিরপেক্ষ নয়। তবে এই রাজনৈতিক বিভক্তি সাংবাদিক পেশার ক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচারে ইতির পরিবর্তে নেতি রূপেই জাজ্বল্যমান। রাজনৈতিক মতাদর্শিক ভিন্নতা অস্বাভাবিক নয়। অপরাধও নয়। আমাদের রাজনৈতিক দ্বিদলীয় ব্যবস্থার আদলে সাংবাদিক সমাজ দুই পৃথক রাজনৈতিক অবস্থানে পরস্পরের প্রবল প্রতিপক্ষ এবং চরম শত্রুতুল্য। যেটি এই পেশাজীবীদের ঐক্য-সংহতি বিনাশের পথকে প্রশস্ত করেছে। সাংবাদিক সমাজের অনৈক্য-বিভক্তিতে সংবাদপত্রের মালিকপক্ষ সাংবাদিকদের পেশার একচেটিয়া অধিকার-কর্তৃত্ব অর্জন করেছে। পাশাপাশি সাংবাদিকদের স্থায়ী নিয়োগ বাতিল করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফাঁদে আটকে দেয়ার সক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে পেরেছে। স্থায়ী নিয়োগের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত সাংবাদিকরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বাধ্য হচ্ছেন। পূর্বে সাংবাদিকদের মাত্র একটি ইউনিয়ন থাকায় মালিকপক্ষ এ ধরনের গর্হিত অপকীর্তির সুযোগ গ্রহণের সাহস পেতো না। এখন দুই ইউনিয়ন পরস্পরের চরম শত্রু বিধায় বঞ্চিত সাংবাদিকের পক্ষ নিয়ে ইউনিয়ন যথোপযুক্ত ভ‚মিকা পালনে ব্যর্থ। বিভক্তির কারণেই ইউনিয়নের শক্তিমত্তা পূর্বের ন্যায় নেই। সাংবাদিক ইউনিয়ন কার্যত এখন ঠুঁটো জগন্নাথ তুল্য। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এধরনের অনভিপ্রেত অগণতান্ত্রিক-একপেশে কাণ্ডকীর্তির সুযোগ থাকার কথা নয়। দেশে গণতন্ত্র কেবল নামেই রয়েছে কার্যকালিতায় নেই। এটা খুবই বাস্তব সত্য কথা। তারই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকের পেশা এবং পেশার স্থায়িত্ব অনিশ্চিত রূপে সমাজে বিরাজ করছে। দার্শনিক এ্যারিস্টটল তাঁর রাজনীতি (চড়ষরঃরপং) গ্রন্থের শুরুতে লিখেছেন ‘রাষ্ট্র হচ্ছে এমন একটি সংস্থা যার উদ্দেশ্য মহৎ।’ বাস্তবতা কি তা বলে? মোটেও না। কেন নয়? নয় এ জন্যই আমাদের রাষ্ট্র স্বাধীন দেশের রাষ্ট্র নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তানি রাষ্ট্রের ধারাবাহিক রাষ্ট্ররূপে স্বাধীন দেশে বিদ্যমান। পরাধীন দেশের রাষ্ট্র ভাঙা তো পরের কথা। রাষ্ট্র বদল পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। কেবল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে। নতুন নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এর অতিরিক্ত কিছু ঘটেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে ছিল। স্বাধীনতার পর ক্ষমতাও জাতীয়তাবাদীদের অধীনে রয়েছে, নানা দল ভিন্নতায়। স্বাধীন দেশের ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকার নিজেদের জাতীয়তাবাদী দাবি করেছে। অথচ জাতীয়তাবাদীমাত্রই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভ‚মিকা বাঞ্ছনীয় কেবল নয়, অপরিহার্য। ভবিতব্য এই যে, জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের প্রতিটি সরকার সাম্রাজ্যবাদের নিরঙ্কুশ তোষণকারী। এতে তাদের জাতীয়তাবাদী দাবি নির্লজ্জ উপহাসে পরিণত। ঐ যে রাষ্ট্রের কথা বলেছি, এ রাষ্ট্রের মালিকানা কাদের নিয়ন্ত্রণে? রাষ্ট্র ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক কারা? এর উপরই নির্ভর করে রাষ্ট্রের চরিত্র এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। বিদ্যমান তথাকথিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পর্যন্ত জনগণের বুর্জোয়াতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত নেই। সর্বত্র লুটপাটের সংস্কৃতি বিরাজিত। দলের ভিন্নতা থাকলেও নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে ভিন্নতা কিন্তু শাসক শ্রেণির মধ্যে নেই। যে দ্বন্দ্বে পরস্পর শত্রুতে পরিণত, তার মূলে ক্ষমতায় থাকা এবং না থাকার দ্ব›দ্ব। আমাদের শাসক দলের লুটপাট, জবরদখল, দুর্বৃত্তায়ন ইত্যাদিতে অর্জিত সম্পদ ও পুঁজি বিদেশে পাচারেও কিন্তু ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়নি। এই লুটেরাদের মালিকানায় দেশের প্রায় সব সংবাদপত্র। তাদের অধীনে পেশায় নিয়োজিত সাংবাদিকরা ‘স্বাধীন পেশাজীবী’ কিন্তু নয়। মালিকপক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ক্রীড়নক স্বরূপ। সাংবাদিকরা কার্যত মালিকপক্ষের আদেশ-নির্দেশ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভিত্তিতে পেশাগত ভূমিকা পালন করে থাকেন। সাংবাদিকতার নীতিবোধ-মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা সমস্তই সংবাদপত্রের মালিকপক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল এখন। ব্যতিক্রম যে নেই, তা কিন্তু নয়। নিশ্চয় আছে। এবং ব্যতিক্রম আছে বলেই সংবাদপত্রের গুরুত্ব এখনো রয়েছে। দেশে অসংখ্য দৈনিকের নগণ্য দৈনিক এবং সাংবাদিক পেশাগত নৈতিকতা শত প্রতিক‚লতায় অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। চাকরি হারানোর আতঙ্কে সাংবাদিকদের পেশা এখন রাজা ত্রিশঙ্কুর ন্যায় দোদুল্যমান। পেশার অনিশ্চয়তা এবং সংবাদপত্রের সীমাবদ্ধতায় সংবাদকর্মীদের নির্মোহ-নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন এ সব সঙ্গত কারণেই সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও সমস্ত সীমাবদ্ধতা ডিঙিয়ে আমাদের অনেক সাংবাদিক সমাজ পেশাগত অঙ্গীকার পালনে অসামান্য দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন। সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। অতীতে প্রতিটি সংবাদপত্রে একজন সম্পাদক ছিলেন বটে। তবে সাংবাদিকদের কাছে সম্পাদকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি ছিলেন বার্তা সম্পাদক। যিনি পুরো পত্রিকার সংবাদের নিয়ন্ত্রক। সংবাদের কোনটি যাবে না যাবে, কোন সংবাদ কোন স্থানে কত কলামে সমস্তই নির্ধারণ করতেন বার্তা সম্পাদক। এখন ঐ পদটি প্রতিটি পত্রিকায় আছে, তবে ঐ পদের কার্যকারিতা আর পূর্বের ন্যায় নেই। সবই এখন সম্পাদকের নিয়ন্ত্রণে। সম্পাদক মালিকপক্ষের যোগ্য-বিশ্বস্ত প্রতিনিধি রূপেই ঐ পদে বহাল থাকেন। সামান্য ব্যতিক্রমে সম্পাদকের চাকরিচ্যুতি এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। চাকরি রক্ষায় সম্পাদক যেমন মালিকপক্ষের আজ্ঞাবহ। ঠিক তেমনি সাংবাদিকেরাও বটে। সমস্তই বিদ্যমান অব্যবস্থার দর্পণ। অনিবার্য কারণে সংবাদপত্রে সমাজের চিত্র সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে প্রকাশিত হয় না। একই সংবাদ ভিন্ন কাগজে ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। সমাজের প্রতি অঙ্গীকার-দায়বদ্ধতা ক্রমেই এই সৃজন ও সৃষ্টিশীল পেশা থেকে দূরত্বে চলে যাচ্ছে। সেটা হতাশাজনক নিশ্চয়। তারপরও আমরা আশাবাদী হতে চাই। চাই সংবাদপত্র সমাজের নির্ভেজাল দর্পণ রূপে শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করুক। প্রকাশিত হোক দল-মত নিরপেক্ষ সামষ্টিক মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুতে নির্ভিক সংবাদপত্র।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App