×

বিশেষ সংখ্যা

ঢাকায় উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্যচিন্তার ধরন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:২৭ পিএম

ঢাকায় উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্যচিন্তার ধরন

ইংরেজ শাসনের কুফল সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথও সারাটা জীবন সজাগ ছিলেন। তিনি বহুরাজকতা সম্বন্ধে লিখেছিলেন, ‘ইতিপূর্বে ভারতবর্ষের সিংহাসনে একটি বাদশা ছিল। তাহার পরে একটি কোম্পানি বসিয়াছিল.. এখন ইংরেজ জাত জানে ভারতবর্ষ তাদের সকলেরই। একটা পরিবার মাত্র নহে, সমস্ত ইংরেজ জাতটা এই ভারতবর্ষকে লইয়া সমৃদ্ধি সম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছে।.. মোট কথা একটা আস্ত জাত নিজের দেশে বাস করিয়া অন্যদেশকে শাসন করিতেছে, ইতিপূর্বে এমন ঘটনা ইতিহাসে ঘটে নাই।.. একটা দেশ যত রসালো হউক- একজন রাজাকে পালিতে পারে, দেশসুদ্ধ রাজাকে পারে না।’ তবে রবীন্দ্র সাহিত্যকে ব্যুপনিবেশ সাহিত্য বললে যথার্থ মূল্যায়ন হয় না। গভীরভাবে দেখতে গেলে রবীন্দ্রনাথ মূলত আসলে আধুনিক প্রাচ্যতত্ত্বের উদ্গাতা। উত্তর-আধুনিকতার সঙ্গে যা গভীরভাবে অন্বিত। জীবনের শেষপর্বে এসে এই কবি প্রাচ্যতত্ত্বকে তুলে ধরার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে বেড়িয়েছেন। বলেছেন, পৃথিবীর আজ গভীর অসুখ। প্রাচ্যের দর্শন ছাড়া মুক্তি নেই। প্রাচ্যকে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একপায়ে খুঁড়িয়ে চলা আজকের পৃথিবীকেও এশিয়াই পারে আরেকটি পা সংযোজন করতে। রবীন্দ্রনাথের এ চিন্তা ছিল, উত্তর-উপনিবেশিক চেতনার অগ্রদূত এডওয়ার্ড সাঈদের অনেক আগে।

ঢাকার সাহিত্যাঙ্গনে বিগত বছর দশক ধরে উত্তর-উপনিবেশ শব্দটি জোরেশোরে চালু হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি সুস্পষ্ট বলে মনে হয় না। বিশেষ করে যারা কবিতা-গল্প লিখছেন তাদের এ ব্যাপারে আগ্রহের কমতি রয়েছে। আর এটিই স্বাভাবিক। বাংলা সাহিত্যের ধারাটিই তেমন। বাংলা সাহিত্য কোনো ইজমের ধার ধারে না। খুব একটা উত্থান-পতন ছাড়াই এগিয়ে চলে। মাঝেমধ্যে শক্তিমান লেখক এসে কিছুটা নাড়া দিয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত কম শক্তিমানরা সেই নাড়াতেই কিছুকাল সচল থাকেন। পূর্বতনদের নির্দেশিত পথ থেকে সরতে চান না। বাঙালি রিস্ক নিতে জানে না। বাঙালির ব্যবসায়িক বুদ্ধি কম। ইজম আসে পশ্চিম থেকে।

যা অধিকাংশ সময় সীমাবদ্ধ থাকে আমাদের ভাবুকদের মধ্যে। তারা বিষয়টি জানেন। পত্র-পত্রিকায় কিছু আর্টিক্যাল লেখেন। তা থেকে আমাদের ভাসা-ভাসা ধারণা জন্মে। কিছুদিন বিতর্কের পর তাও মিলিয়ে যায়। আবার নতুন ইজম আসে কিন্তু বাঙালি তাতেও সাড়া দেয় না। বাঙালি জাড্য ধর্মে বিশ্বাসী। এমনকি সাগর অতিক্রম করাও সনাতন বাঙালির শাস্ত্র-নিষিদ্ধ।

প্রাচীনকালে ঈশ্বর তাদের দু’হাতে দান করেছিলেন। এ দেশকে খাদ্যের ভাণ্ডারে পরিণত করেছিলেন। আবহাওয়া ছিল নাতিশীতোষ্ণ। নদীগুলো পরিপূর্ণ ছিল জীবন্ত মাংসে। তাই কোথাও যাওয়ার দরকার হয়নি। পৃথিবীর অন্য-প্রান্তের মানুষ এসেছে এখানে। কখনো ব্যবসায়িক বুদ্ধি নিয়ে, কখনো লুট করতে। তাদের কেউ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে এখানেই থেকে গিয়েছে।

কালক্রমে তারাই হয়ে উঠেছে বাঙালি জীবনের প্রধান স্রোত। বাংলা ভাষাকে, বাঙালির শাসনকে তারাই চিরস্থায়ী রূপ দিয়েছে। হাজার বছরের বাঙালি জীবনে গতির হেরফের খুব একটা দেখা না গেলেও ১৭৫৭ সাল থেকে একটি ভিন্ন ধারার সূচনা হয়। বাঙালির উপনিবেশ-দলন তখন থেকেই।

আজ থেকে আড়াই’শ বছর আগে ইংরেজ বণিক ক্লাইভ বাংলায় শ্বেত-মসনদ চালু করেছিলেন। আগেও অন্য জাতির লোক বাঙালিদের শাসন করেছে। কিন্তু কালক্রমে তারাই হয়ে উঠেছে বাঙালি। তবে ইউরোপীয়দের প্রকৃতি একটু আলাদা। নিজের জাত বাঁচিয়ে রেখে অন্যের জাত নষ্ট করা। ভারতবর্ষে ইংরেজের উপনিবেশ সেখান থেকেই। উপনিবেশের মূল উদ্দেশ্য শাসন নয়, শোষণ করা।

উত্তর-উপনিবেশ নিয়ে কথা বললে উপনিবেশ সম্বন্ধে জানতে হয়। উপনিবেশের ধারণা অসম্পূর্ণ থাকলে উত্তর-উপনিবেশ বিষয়টি তালগোল পাকিয়ে যায়। বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইউরোপীয়রা। যার শুরু পাঁচশ বছর আগে।

১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলোম্বাসের আমেরিকা যাওয়ার পথ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। এবং প্রায় একই সময়ে (১৪৯৮) ‘উত্তম-আশা’ দিয়ে (নিয়ে) ভাস্কো দা গামা এসেছিলেন ভারতে। একজন স্প্যানিশ অন্যজন পর্তুগিজ। এই দুই নাবিকের আবিষ্কারের পর আর তাদের পেছনে তাকাতে হয়নি। ইউরোপের প্রায় সবাই ভাগাভাগি করে নিয়েছিল পৃথিবী নামক ক্ষুদ্র গ্রহটিকে। শুরু হয়েছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্য বিস্তারের মহোৎসব।

এমনকি অনেক ভূখণ্ডে তারা আদিবাসীদের অধিকারও স্বীকার করেনি। তাদের ভূখ- থেকে করেছিল সমূলে উৎখাত। দেশের নাম পর্যন্ত পাল্টে দিয়েছিল। স্বদেশীরা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে পড়েছিল। এভাবে ১৯৩০ সাল নাগাদ গোটা পৃথিবীর প্রায় ৮৭ ভাগ জমির মালিক হয়ে দাঁড়ায় ইউরোপীয় প্রভুরা। পৃথিবী বিভক্ত হয়ে পড়ে শাদা আর কালোয়। ইংরেজ গুণগ্রাহী কবি রুডিয়ার্ড কিপলিং তাই জাক করে বলেছিলেন, West is west, east is east. দুটিতে কখনো মিশ খাবার নয়।

ঔপনিবেশিক শিক্ষার প্রধান মাজেজা, ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ। আর এই ধারণা পদাবনত পৃথিবীর মানুষের মগজের রন্ধ্রে পৌঁছে দিয়ে শোষণের প্রক্রিয়া স্থায়ী করা। ফ্রাঞ্জ ফানো বিষয়টি আমাদের আরো পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন। ফ্রয়েডের একটি বিশ্লেষণ ধার করে তিনি এর তুলনা দিয়েছেন। অবদমনের ফলশ্রুতিতে নারীর মধ্যে যেমন পুরুষ হবার আকাক্সক্ষা জাগে তেমনি উপনিবেশ শোষিত কালো মানুষের মনেও শাদা হবার বাসনা উপ্ত হয়। উপনিবেশের মানুষরা নিজেদের যাবতীয় আচরণকে খারাপ এবং উপনিবেশ প্রভুদের সবকিছু ভালো ভাবতে শুরু করে। এই হীনমন্যের বোধ তাদের জাতি হিসেবে দাঁড়াতে দেয় না। এবং তারা পরিচয়ের সমস্যায় নিপতিত হয়।

উপনিবেশের এসব গভীর ক্ষত নিয়ে উত্তর-উপনিবেশের যাত্রা। উত্তর-উপনিবেশ একটি অনির্ধারিত ও অমীমাংসিত শব্দ-বন্ধ। অনেকেই বলে থাকেন, উপনিবেশের শিক্ষাই তো শেষ হয়নি। তারপর শুরু হয়েছে নয়া উপনিবেশবাদ। বিশ্বায়নের থাবা এলোমেলো করে দিচ্ছে প্রতিটি জাতির নিজস্ব পরিচয়। কোনো কিছু দানা বাধার আগেই বণিকায়নের মুঠো তার রস চিপে নিচ্ছে। এই যখন অবস্থা তখন উত্তর-উপনিবেশ ধারণাটি কেন আমাদের চিন্তার ঘাড়ে নতুন করে চেপে বসছে। উপনিবেশের অবসান হলেও আমাদের মগজের উপনিবেশবাদ আরো সুদৃঢ় হচ্ছে।

এমনকি উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে পরিচয়ের যে অহংকার গড়ে উঠেছিল, কালক্রমে যেন তাও হারাতে বসছে। তারপর উত্তর-উপনিবেশ শব্দের গ্যাঁরাকল আমাদের আরো সন্দিহান করে তুলছে। উপনিবেশ আমলে তো ছিল কেবল মালিক আর দাস। এখন উভয়ই এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। বোঝার উপায় নেই, কে শোষক আর কে শোষিত। উত্তর-উপনিবেশ ধারণাটি আমরা মেনে নিলে শোষক ইউরোপ আর শোষিত এশিয়া-আফ্রিকা এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। এই সঙ্গে আমরা আরো একটা ভুল করে থাকি, তাহলো উপনিবেশ প্রভুরা বিদায় হওয়ার পরে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে স্বাধীন দেশসমূহই কেবল উত্তর-উপনিবেশের আওতাভুক্ত। কিন্তু আদৌ তেমন নয়। নতুন ইংরেজি সাহিত্যকে আজকাল প্রায়ই ‘পোস্ট-কলোনিয়াল লিটারেচার’ বলে উল্লেখ করা হয়।

কেবল সাহিত্য নয় ‘পোস্ট-কলোনিয়াল কমোডিটি’ ও ‘পোস্ট-কলোনিয়াল লিটারেচার’ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। অনেকেই বলেন, আমেরিকাও তো ব্রিটিশ কলোনিভুক্ত ছিল। আমেরিকায় ব্রিটিশ কলোনি ছিল এটা যেমন সত্য, তেমনি আমেরিকা নিজেই সর্ব-ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারে সদা-তৎপর। তাহলে উত্তর-ঔপনিবেশিক ধারণা কি সর্বত্র সমান?

তবে উপর্যুক্ত আলোচনার দ্বারা উত্তর-উপনিবেশের ধারণাটি অস্বীকার করা হচ্ছে না। গত শতাব্দীর শেষার্ধ্বে উপনিবেশের ধারণাটির একটি দৃশ্যগত পরিবর্তন এসেছে। বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে অন্য কোনো দেশে সরাসরি শাদা মানুষের শাসন লক্ষ করা যাচ্ছে না। তবে এখনো উদাহরণ বিরল নয়। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজস্ব আদায় আর নিজের দেশের শিল্প-কারখানার জন্য কাঁচামাল সরবরাহ।

১৮৪৮ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ সেনাবাহিনীর দ্রুত চলাচল, ভারতীয়দের অসন্তোষ দমন ও সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য রেলপথ নির্মাণের প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। ডালহৌসির লক্ষ্য ছিল রেলপথের মাধ্যমে ব্রিটিশজাত পণ্যের জন্য বৃহত্তর ভারতীয় বাজার সৃষ্টি করা। সুতরাং কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, উপনিবেশ এবং উত্তর-উপনিবেশ ধারণাটি পুরোপুরি রাজনৈতিক। আর এই রাজনৈতিক উপায় কীভাবে সাহিত্যের পথ হতে পারে সেখানেই বিতর্ক। মিশেল ফুঁকো প্রমাণ করতে চেয়েছেন, আমাদের ভয় ও আতঙ্ক, সুখ ও আনন্দের প্রায় সবটাই রাজনীতি কেন্দ্রিক। রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা কিংবা প্রতিহিংসাই কেবল মানুষ এবং মানবকে সর্বময় নির্মূল করতে পারে। এই সত্য প্রমাণের জন্য সব সময় ইতিহাসের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের নিজেদের জীবন থেকেও এসব উদাহরণ সংগ্রহ করা দুরূহ নয়। সুতরাং রাজনৈতিক মতবাদ সাহিত্যের ধারা প্রবর্তনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে সে সত্য অস্বীকার করার নয়।

উত্তর-উপনিবেশ ধারণাটি পরবর্তীকালের অন্তত আরো দুটি মত দ্বারা আবিষ্ট ও বাধাগ্রস্ত। তার একটি পোস্ট-মর্ডানিজম কিংবা উত্তর আধুনিকতা; অন্যটি Decolonization বা ব্যুপনিবেশিকতা। এই ধারণা দুটিও উত্তর-উপনিবেশের সমান্তরাল। সহজ করে বলা যায়, ইংরেজের মর্ডানএজ বা আধুনিককালেই ইউরোপ পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই আধুনিক কালটিই ছিল ক্রিশ্চানিটির উত্থান কাল। প্রভু ও তার পুত্রের নাম সারা বিশ্বময় পৌঁছে দেয়া। আর উপনিবেশ নিষ্পেষিত অসংখ্য কালো মানুষ ও দাসদের তাদের সুখের জন্য প্রভু-পুত্রের মতো বলি দেয়া।

বিশ্বব্যাপী ইউরোপের সম্প্রসারণের এই দীর্ঘ সময়ই আধুনিক কাল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে তাদের সময় স্রোত আলাদাভাবে শুরু হয়েছে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশ আজ সম্প্রসারণবাদ ত্যাগ করেছে। ঈশ্বরের কৃপায় উপনিবেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থবিত্তে তারা আজ রাজার হালে আছে।

এমনকি নিজেদের জন্য একদিন তারা যে ন্যায়যুক্তি গড়ে তুলেছিল অন্য দেশের মানুষের জন্য তাদের সে শুভবোধ কখনো কখনো সক্রিয় বলে মনে হয়। আর তাই আজ যখন সরাসরি উপনিবেশে নেই, আর পৃথিবী যখন এক অক্ষের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রযুক্তির দানবীয় উন্নয়নে আগের কোনো হিসেবই মেলানো যাচ্ছে না, তখন আগের যুগ দিয়ে তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? তাই ভাবুকরা এই যুগের নাম দিতে চান উত্তর-আধুনিক কাল।

আধুনিক কালটি মানুষকে এত বেশি দিন শাসন করেছে যে মানুষ তার সীমানা থেকে বাইরে যাবার সাহস দেখাতেও ভয় পায়। অনাধুনিক হবার হয়, প্রযুক্তির আগ্রাসনের ভয়, কালচালিত চেতনা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করা এবং পরিণামে নিঃসঙ্গ হবার ভয় তাকে পেয়ে বসে। এবং মানুষ এও বলতে ভুলে যায়, আধুনিককালে প্রযুক্তির যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, মানবীয় শাখায় তার স্পর্শ লেগেছে কম। এমনকি এই যুগে যন্ত্রের কাছে মানুষ হেরে গেছে। তাই আধুনিকতা ঔপনিবেশিকতা মানুষ আর মনে রাখতে চায় না। সে সব কিছু ব্যাখ্যা করতে চায়, উত্তর-আধুনিকতা ও উত্তর-উপনিবেশিকতা দিয়ে। উত্তর-উপনিবেশ ও উত্তর-আধুনিক তাই সমান্তরাল চেতনাবাহী। ব্যুপনিবেশ (Decolonization) ধারণার সঙ্গে অনেকেই উত্তর-উপনিবেশ (Post-colonization) ধারণাটি গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু এ দুটি ধারণার মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। এবং একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক নেই বলা চলে। ব্যুপনিবেশের শুরু হয়েছে সেই তখন থেকে, যখন পরদেশী ইউরোপীয়রা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তরে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছিল। ব্যুপনিবেশ একটি বিদ্রোহার্থক চেতনা।

যা মূলত ভূমিপুত্রদের নিজের মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকার লড়াই। বিদ্রোহ ও রক্তপাত এমনকি নির্মূল হয়ে যাবার আশঙ্কাও এই চেতনার মধ্যে নিহিত। ব্যুপনিবেশকালে স্বদেশীদের শুভবুদ্ধির কাছে আবেদন জানানো হয়। তাদের সামনে তুলে ধরা হয় বিশেষ মূল্যবোধ। তাদের বারবার বলা হয় ব্যুপনিবেশ বলতে পশ্চাৎপদতা বোঝায় না।

বলা হয়, আমাদের যা, তা পরীক্ষিত খাঁটি ও শ্রদ্ধেয়; আমাদের যা নিজেদের তার ওপর আস্থা রাখতে হবে। উপনিবেশ প্রথমেই একটি মুৎসুদ্দি শ্রেণি তৈরি করে। স্থানীয়দের সংস্কৃতির মধ্যে হট্টগোল বাধিয়ে দেয়। সর্বত্র ভাষা শিক্ষার প্রকল্প গ্রহণ করে। আর মুৎসুদ্দির কাজ শ্বেতাঙ্গ মূল্যবোধের মাহাত্ম্য প্রচার করা। যা কিছু দেশি তার সবই খারাপ। কিন্তু ব্যুপনিবেশকালে মানুষজন ঔপনিবেশিক প্রভুদের সবকিছু খারাপ বলতে শুরু করে। তাদের মূল্যবোধ পরিহাস করে, অপমান করে এবং বমি করে উগরে দেয়। বিলাতি পণ্য বর্জন করে, চরকার গান গায়।

বাংলা সাহিত্য মূলত ব্যুপনিবেশের সাহিত্য। বাঙালির ছেলে মধুসূদন ইংরেজের কবি হতে চেয়েছিলেন, এ গল্প আমরা সকলেই জানি। ইংরেজি শিখেছিলেন, ইউরোপের বহু জায়গা পরিভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু বাংলার রসাল-বৃক্ষ ইউরোপের শীত ও উত্তাপহীন মাটিতে জন্মাতে পারে না, শিগগির সে বোধ তার হয়েছিল। তাই বাকি জীবন বাঙালি ও বাংলার সেবা করে কাটিয়েছিলেন। কপোতাক্ষ নদের কথা লিখেছিলেন, বঙ্গভাষা ও বাঙালির উৎসবের কথা লিখেছিলেন। রসাল ও বটবৃক্ষের কথাও বাদ যায়নি।

এমনকি ইয়ং বেঙ্গল চিন্তার স্কুলের ছাত্র হয়েও হিন্দুর দেব দেবতা, পুরাণ কাহিনী নিয়ে সারাটা জীবন লিখেছেন, হিন্দু বীরাঙ্গনা সম্ভাষণের পাশাপাশি সুলতানা রাজিয়াকেও ভোলেননি। উগ্র ব্যুপনিবেশিকতা তখনো শুরু হয়নি। তবু ‘রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী? আমি কি ডরাই সখি ভিখেরী রাঘবে।’ এভাবে আগ্রাসী তস্করদের শাসিয়েছেন তিনি।

ইংরেজ শাসনের কুফল সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথও সারাটা জীবন সজাগ ছিলেন। তিনি বহুরাজকতা সম্বন্ধে লিখেছিলেন, ‘ইতিপূর্বে ভারতবর্ষের সিংহাসনে একটি বাদশা ছিল। তাহার পরে একটি কোম্পানি বসিয়াছিল.. এখন ইংরেজ জাত জানে ভারতবর্ষ তাদের সকলেরই। একটা পরিবার মাত্র নহে, সমস্ত ইংরেজ জাতটা এই ভারতবর্ষকে লইয়া সমৃদ্ধি সম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছে।.. মোট কথা একটা আস্ত জাত নিজের দেশে বাস করিয়া অন্যদেশকে শাসন করিতেছে, ইতিপূর্বে এমন ঘটনা ইতিহাসে ঘটে নাই।.. একটা দেশ যত রসালো হউক- একজন রাজাকে পালিতে পারে, দেশসুদ্ধ রাজাকে পারে না।’

তবে রবীন্দ্র সাহিত্যকে ব্যুপনিবেশ সাহিত্য বললে যথার্থ মূল্যায়ন হয় না। গভীরভাবে দেখতে গেলে রবীন্দ্রনাথ মূলত আসলে আধুনিক প্রাচ্যতত্ত্বের উদ্গাতা। উত্তর-আধুনিকতার সঙ্গে যা গভীরভাবে অন্বিত। জীবনের শেষপর্বে এসে এই কবি প্রাচ্যতত্ত্বকে তুলে ধরার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে বেড়িয়েছেন। বলেছেন, পৃথিবীর আজ গভীর অসুখ। প্রাচ্যের দর্শন ছাড়া মুক্তি নেই। প্রাচ্যকে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একপায়ে খুঁড়িয়ে চলা আজকের পৃথিবীকেও এশিয়াই পারে আরেকটি পা সংযোজন করতে। রবীন্দ্রনাথের এ চিন্তা ছিল, উত্তর-উপনিবেশিক চেতনার অগ্রদূত এডওয়ার্ড সাঈদের অনেক আগে।

তবে ব্যুপনিবেশিক সাহিত্যের প্রতীক ও মনুমেন্ট হিসেবে বেঁচে থাকবেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহকে যতই আমরা নেতিবাচক উপস্থাপন করি না কেন, বিদ্রোহের বন্দুক হচ্ছে, পরাধীন মানুষের মানবতার প্রমাণ। সার্ত্রে বলেছেন, ‘কারণ, বিদ্রোহের প্রথমভাগে তাকে খুন করতে হয়। একজন ইউরোপীয়কে গুলি করে হত্যা করা এক ঢিলে দুই পাখি মারার শামিল; একজন অত্যাচারীকে ধ্বংস করা এবং সেই সাথে অত্যাচারিতাকে ধ্বংস করা। তারপর থাকে একজন মৃত মানুষ, আর একজন মুক্ত মানুষ; যে বেঁচে থাকে সে প্রথমবারের মতো পায়ের নিচে জাতীয় ভূমির স্পর্শ পায়।

সেই মুহূর্তে জাতি চুপ করে থাকে না। সে যেখানেই থাকে, জাতিও তাকে অনুসরণ করে চলে, চোখের আড়াল করে না। কারণ, জাতিও তার মুক্তির সঙ্গে একীভূত।’ উত্তর-উপনিবেশিক কালে ব্যুপনিবেশের নায়কদের কৌশলে সরিয়ে রাখা হয়। উচ্চ কণ্ঠতাকে নিন্দা জানানো হয়। সমকালকে উপেক্ষা করে অতীতের কোনো বিষয়কে লোগোফাইড করা হয়।

যা কিছু স্বাভাবিক, যা কিছু দেশজ তার ওপর সিলমোহর মেরে দিতে হয়। একজন ভূমিপুত্রের পক্ষে কিছুতেই বোঝা সম্ভব হয় না এসব পেটেন্টের লড়াই। একদিন তার ক্ষেতে যেয়ে দেখতে পায়, সে আর আউশ ধান বুনতে পারছে না, আইলের চারপাশে নিমের চারা লাগাতে পারছে না। ঠিক যেমন করে ঔপনিবেশিক আমলে তার জমিকে নীল চাষের জন্য পত্তনি দিতে হতো। আফিম চাষের জন্য দাদন নিতে হতো। আর অস্বীকার করলেই দেশীয় দালালরা শ্বেতাঙ্গদের পক্ষ হয়ে তাকে ধরে নিয়ে যেয়ে চুনের গুদামে আটকে রাখতো। রাতের অন্ধকারে গুম করে দিতো। উত্তর-উপনিবেশিক কালেও এ চিত্রের পরিবর্তন হয়নি। বরং বহুমুখী সম্বন্ধের দ্বারা পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। পূর্বভারতীয় দৃশ্যমান কোম্পানির বদলে বহুমুখী বণিক-স্বার্থ একত্রিত হয়েছে। নিজের জরায়ুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হলেও কৃষকের জমির ব্যাপারে এ সত্য এখনো খাটে না।

এমন একটা জটিল কোটেশনের মধ্যে এগুচ্ছে উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্য চিন্তা। তবে উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্য চিন্তার মহোত্তম প্রকাশ একটি জাতির চারিত্রিক পরিচয় তুলে ধরা। জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষাপটে উপনিবেশিক আমলে সৃষ্ট পুরনো সাহিত্য বিচার ও পুনর্পাঠ করা।

এবং এ কথা বলা যে, ঔপনিবেশিক আমলে আমরা কেন কীভাবে ভুলে ছিলাম ‘নিজ গৃহে বাছা রতনের রাজি।’ আমরা কেন ইউরোপীয় সাহিত্যকেই আমাদের মডেল করে তুলতে চেয়েছিলাম। নাকি আমাদের সামনে এমন কোনো আইকন তুলে ধরা হয়েছিল যার মাধ্যমে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব মানা আমাদের পক্ষে সহজ ছিল। উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্যে সেই সব সাহিত্য-কর্মের নিন্দা করা হয়, যারা নিজেদের ভাষা মিথের পরিবর্তে ঔপনিবেশিক প্রভুদের ঐতিহ্য ব্যবহারে বেশি সচেষ্ট।

ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপ ছাড়া বাকি পৃথিবীর জ্ঞান ছিল আমাদের কাছে অজ্ঞাত। ভিক্টোরীয় কিংবা এলিজাবেথীয় যুগের ইংলিশ কবি-সাহিত্যিক পদাবনত পৃথিবীর সাহিত্যকে রাজার পক্ষ থেকে শাসন করতে চেয়েছিল। অথচ ভাষা সাহিত্যের ইতিহাস বিবেচনা করলে দেখা যাবে ইংরেজি ভাষার সাহিত্যও, এমনকি বাংলার চেয়ে খুব পুরনো নয়। অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন, শেলী, কিটস, বায়রন কিংবা ইয়েটস, এলিয়টের মতো কবির এখন আর জন্ম হচ্ছে না কেন? অথবা বোদলেয়ার, র‌্যাবো, মালার্মে? এর সহজ জবাব উপনিবেশ নেই বলে। তাদের বাজার ছোট।

পুরো ইউরোপের লোক সংখ্যা ভারতের চেয়েও কম। চীনের প্রায় অর্ধেক। এখন বাজার সালমান রুশদি, অরুন্ধতি, আচেবে, সাঈদ, গায়ত্রী, জুম্পা, নাইপল, অনিতা দেশাই প্রমুখের। কারণ একদিকে উপনিবেশের হাতেগোনা প্রাক্তন মালিক, অন্যদিকে আফ্রিকা থেকে এশিয়া এমনকি ল্যাটিন আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত অসংখ্য পাঠক-জনতা। তবে পণ্য যেখানেই তৈরি হোক না কেন তার ব্যবসাদার কিন্তু ইউরোপীয় কোম্পানি।

বর্তমান বাংলা সাহিত্যে ঔপনিবেশিক ও ব্যুপনিবেশিক দুটি স্পষ্ট ধারা বিদ্যমান। কিন্তু উত্তর-উপনিবেশবাদীরা যতই চেঁচাক তাদের কর্ম পরিষ্কার নয়। আবার অনেকেই ঝাড়-ফুঁক, তন্ত্র-মন্ত্র ও পুরনো হুঁকো-কল্কিকে উত্তর-উপনিবেশ মনে করছে। বিশৃঙ্খল চিন্তার কোলে সবাই সমর্পিত। আমাদের লেখককুলকে মনে রাখতে হবে, ঝড়ের পরে গৃহস্থ প্রথমেই ঝাড়– দিয়ে তার আঙিনা পরিষ্কার করে। বাইরে থেকে উড়ে আসা আবর্জনা বাইরে ফেলে দেয়। তারপর হাতের কাছে প্রাপ্ত সরঞ্জামাদি দিয়ে শক্ত করে ঘরের চাল বাঁধে, খুঁটি লাগায়। মনে রাখতে হবে, আরেকটি ঝড়ে যাতে সহজেই পড়ে না যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App