×

মুক্তচিন্তা

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বহুমাত্রিক পরিচিতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:১৫ পিএম

তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদাশীল, নির্লোভ, শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত, অতিশয় আত্মনির্ভরশীল, অন্ধত্ব, বধিরতা, দাম্ভিকতা ও পদলেহীতামুক্ত। তদবিরকে এড়িয়ে চলেছেন আজীবন। নিজের ক্ষমতা তিনি কখনো অপব্যবহার করেননি। সংগঠক হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন।

আজ ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ৭৬তম জন্মদিন। এই দিনে সারা পৃথিবীতে কয়েক সহস্র মানুষ জন্ম নিয়েছিল; তাদের বিশালাংশ পৃথিবী থেকে নীরবে নিভৃতে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু একজন ওয়াজেদ মিয়াই বহু পরিচয়ে ও অভিধায় আমাদের কাছে বেঁচে আছেন এবং জন্ম-জন্মান্তরে বেঁচে থাকবেন।

৬৭ বছর বয়সে ২০০৯ সালের ৯ মে তিনি আমাদের কাঁদিয়ে ও ব্যথিত করে চলে গেছেন, কিন্তু তাকে আমরা আজো স্মরণ করি একজন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের করিৎকর্মা চেয়ারম্যান হিসেবে, একজন মানবতাবাদী বিজ্ঞানী হিসেবে, একজন গবেষক ও গ্রন্থকার হিসেবে, একজন সহজ সরল, নির্লোভ, দাম্ভিকতাবহির্ভূত, শক্ত শিরদাঁড়া ও লক্ষ্যাভিমুখী মানুষ হিসেবে।

ওয়াজেদ মিয়া ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানার ফতেহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবদুর কাদের মিয়া ছিলেন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। তাদের ছিল পর্যাপ্ত জমিজমা। ৪ ভাই ও তিন বোনের পরিবারে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। জীবনে তিনি বহু বিষয়ে আকর্ষিত ছিলেন। পড়াশুনায় ছিলেন অতি মনোযোগী এবং তার ফলাফলও পেয়েছেন হাতে হাতে। স্কুলজীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি প্রথম হতেন।

১৯৫৬ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে ডিসটিকশনসহ তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৮ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে তিনি ২য় স্থান নিয়ে বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আইএসসি পাস করেন। আইএসসি পাস করে ওয়াজেদ মিয়া ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্র ছিলেন। রাজনীতির সঙ্গে প্রথমত তার ন্যূনতম সম্পৃক্ততা ছিল।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি পরোক্ষভাবে অংশ নিলেও তার পরবর্তী জীবনে ভাষা সৈনিক মতিয়ূর রহমান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা ও আদর্শের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে তিনি জীবনকে রাজনীতিবিদ হিসেবে নয় একজন বিজ্ঞানী হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন। তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি ছাত্ররাজনীতির বলয়ে চলে আসেন। তিনি ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের একবার কোষাধ্যক্ষ ও একবার সহসভাপতি ছিলেন। ছাত্ররাজনীতি তার মেধার স্বাক্ষর মুছে দিতে পারেনি।

তিনি ১৯৬১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় ও ১৯৬২ সালে এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। স্মরণীয় যে তিনি আয়ুব শাহীর শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কিছু সময়ের জন্য জেল খাটেন। জেলে থাকাবস্থায় তিনি তার হবু শ্বশুর ও মহান জাতির মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। ওয়াজেদ মিয়া সুধা মিয়া নামে পারিবারিক গণ্ডি ও বন্ধুদের কাছে আদৃত ও পরিচিত ছিলেন। সুধা শব্দের আর একটি অর্থ মধু। বাংলাদেশের বর্তমান মধুময় পরিস্থিতিতে তার প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই।

তিনি জেল খাটা সত্ত্বেও অনন্য মেধাবী হিসেবে পাকিস্তান এটমিক এনার্জির শীর্ষ ব্যক্তি সাবেক আমলা ও পরবর্তী জীবনে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আই এইচ ওসমানীর দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছিলেন এবং তার অধীনে তিনি কিছুদিন লাহোরে আনবিক শক্তি কেন্দ্রে চাকরিও করেন। পিএইচডিতে অন্তর্ভুক্তির পূর্বে তিনি লন্ডনের বিশ্বখ্যাত ইমপেরিয়াল কলেজে একটি স্বল্পমেয়াদি কোর্সও সম্পন্ন করেন যা তার পিএইচডি ডিগ্রি দ্রুত সমাপ্তিতে সহায়ক হয়েছিল।

১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যেই তিনি বিশ^বিখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ইবান জে স্কুইয়ার্সের অধীনে তার পিএইচডি ডিগ্রি সমাপ্ত করেন। ইতালিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানি নাগরিক ও নোবেল বিজয়ী ড. আবদুস সালামের ত্রিয়েস্তির আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান কেন্দ্রে তিনি সহযোগী সদস্য হিসেবে গবেষণায় জড়িত ছিলেন। পোস্টডক্টরাল প্রোগ্রামও তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন।

অবশ্য এই দুটি কাজ তিনি সেরেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে বিয়ের পর। বঙ্গবন্ধু জেলে অন্তরীণ থাকাবস্থায় রাজনীতিবিদ মতিয়ুর রহমানের মধ্যস্থতায় তিনি বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে বিয়ে করেন। সে ছিল এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামির কন্যাকে পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের একজন বিজ্ঞানীর বিয়ে করা ছিল একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তখন তো ৩২ নম্বরের পাশ দিয়ে তেমন কেউ হাঁটতও না। শেখ মুজিবের অতি কাছের মানুষরা তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল বা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।

সেই অবস্থায় ওয়াজেদ মিয়া ওই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের দুঃসাহসিকতা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনন্য শ্রদ্ধার নিদর্শন রেখেছিলেন। এর আগেও তিনি এমনি দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির সংবর্ধনা সভায়। সংবর্ধনা সভায় অকুতোভয় ওয়াজেদ মিয়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কারা মুক্তি দাবি করে বসেন এমনকি তিনি সেনা শাসনের বদলে গণতান্ত্রিক শাসনের দাবি জানান। মুক্তিযুদ্ধের কালে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, জামাল, রাসেল ও স্বীয় শাশুড়িকে আগলে রেখেছেন কা-ারির মতো। বঙ্গবন্ধুর পূর্ব পরামর্শ মোতাবেক নিজের ছেলে নাম রাখেন জয়। পাকিস্তানিরা তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্নও করেছিল, তিনি শাব্দিক ব্যাখ্যার বদলে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

এমনকি তিনি এরশাদ পতনের লক্ষ্যে শেখ হাসিনা ও খালেদাকে এক টেবিলে বসিয়ে একজন চাকরিজীবী হিসেবে দুঃসাহসের পরিচয়ই দিয়েছিলেন। তার পদক্ষেপ এরশাদ পতনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। সেই এরশাদ পরম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় ড. ওয়াজেদ মিয়ার অন্তিম যাত্রায় রংপুরে উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭৫ সালে দেশে থাকলে যে তার ও তার স্ত্রীর নিস্তার ছিল না তা বুঝা যায় খুনিদের আচরণে। খুনিরা শুধু বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হানা দেয়নি, গোলাগুলি করে কামাল, জামাল, রাসেল, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতাকে হত্যা করেনি, তারা বঙ্গবন্ধুর কয়েক বাসার পর অবস্থিত ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনার বাসায় গোলাগুলি করেছিল। ১৯৭৫ সালের দুঃসহ ও মর্মান্তিক ঘটনার পর তিনি শেখ হাসিনা ও রেহানাকে অভয় ও আশ্রয় দিয়েছেন পরম যত্নে। তখন তাদের জীবন ছিল বিপন্ন। মাস্টার রোলে চাকরি করে তিনি জীবনযাপন করেছেন এবং কারো করুণা নিয়ে বেঁচে থাকেননি।

পরবর্তী জীবনে বহু লাঞ্ছনার ও গঞ্জনার মধ্যে তাদের জীবন কেটেছে। সুযোগ পেয়েও সব একেবারে পুষিয়ে নেবার মানসিকতা তার ছিল না বরং সযতনে তিনি ক্ষমতার বলয়ের বাইরে নিজকে রেখেছিলেন।

ড. ওয়াজেদ মিয়া ২০০৯ সালের ৯ মে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন। আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে রইলেন একজন অতি মেধাবী ও অনুকরণীয় শিক্ষার্থী হিসেবে, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী হিসেবে, একজন মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে; একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হিসেবে, বন্ধুবৎসল ব্যক্তিত্ব হিসেবে, একজন গবেষক ও গ্রন্থকার হিসেবে, একজন দেশপ্রেমিক, সমাজসেবক হিসেবে, একজন দার্শনিক হিসেবে, শীতার্ত ও ক্ষুধার্ত মানুষের বন্ধু হিসেবে কিংবা যুদ্ধাপরাধী ও ঘাতকদের বিচারে একজন বলিষ্ঠ প্রতিবাদী হিসেবে।

তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদাশীল, নির্লোভ, শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত, অতিশয় আত্মনির্ভরশীল, অন্ধত্ব, বধিরতা, দাম্ভিকতা ও পদলেহীতামুক্ত। তদবিরকে এড়িয়ে চলেছেন আজীবন। নিজের ক্ষমতা তিনি কখনো অপব্যবহার করেননি। সংগঠক হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার কর্মগুণেÑ এ কথাও একান্ত সত্য। বহু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে তার ছিল সংশ্লিষ্টতা। গভীর নৈকট্য ছিল সাধনার সংসদের সঙ্গে এবং মাদক, জঙ্গি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন মূর্তিমান লড়াকু সৈনিক।

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী: বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App