×

বিশেষ সংখ্যা

জার্নাল: শীতকাল যায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:০৫ পিএম

জার্নাল: শীতকাল যায়

কলকাতায় আর একজন মানুষের কথা লিখি। ইনি হলেন আমার দাদাঠাকুর। অধীর বিশ্বাস। বনটিয়া, দোয়েল, গাঙচিলের কারিগর। তাকে আমি কেন দাদাঠাকুর ডাকি? পরিচয়ের আগে ডাকতাম না। দেখা হওয়ার পর থেকে ডাকি। কেন? এই মানুষটা আমার ‘দাদাঠাকুর’ বলে।

আরো একটা আজব শীতকাল।

শীত পড়ল কি পড়ল না নগরে।

একটা দিন চাদর পরতে পারলাম না। দুটো টি-শার্টেই হয়ে গেছে, অল্প শীত পড়েছে যে সাড়ে তিনদিন। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া না দিলে শীত? জানালার কাচে কুয়াশা না জমলে শীত? অথচ শীত সামান্য দূরে। কলাতিয়ায়। কলাতিয়া কত দূর আর, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোতে যাওয়া যায়। চল্লিশ মিনিটের মতো লাগে। নগরের অশীতিপর না, অ-শীত-পরা রাত থেকে, দরকারে-অদরকারে মিথুনের সঙ্গে কথা হয় কত।

‘কী করো মিথুন?’ ‘এই তো, ঘরে যাই দাদা।’ ‘ঠাণ্ডা কেমন?’

‘ঠাণ্ডার কথা আর বলবেন না দাদা। রাস্তায় ঘাটে আর একটা কেউ নাই। আমি খসরু ভাইরে দেখতে গেছিলাম তো, দেরি হয়ে গেছে। আন্দাজে হাঁটতেছি দাদা। কুয়াশায় কিছু দেখা যায় না।’

লরা ইঙ্গেলস ওয়াইলডারের ‘লিটল হাউস অন দ্য প্রেইরি’র কেউ হবে মিথুন। কী পাভেল কী ইভান। কেউ একজন রুশ দেশের আশ্চর্য গল্পসমূহের। চাকরি-বাকরি না, চাষবাস করে। সে থাকে কলাতিয়ায়।

সর্ষে ফুল দেখতে কিছুদিন আগে আমরা মিথুনের ডেরায় গিয়েছিলাম। বুক ভরে সর্ষে ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে ফিরেছি। কলাতিয়ার আশ্চর্য রূপ দেখে ফিরেছি। এত সবুজ। চোখ ধাঁধায়। মানুষের মতো গাছ দেখেছি একটা। আর একটু হলে জন লেনন, আর একটু হলে রবীন্দ্রনাথ। গাছের ছবি তুলে রাখা হয়েছে। কোনো একটা বইয়ের প্রচ্ছদে দেখা যেতেই পারে কখনো।

বইয়ের প্রচ্ছদ। এই সময়টা আমার কাটে শুধুই বইয়ের প্রচ্ছদ এবং প্রচ্ছদ চিন্তা নিয়ে। কতজনের কত রকম বই। এর বইয়ের প্রচ্ছদ এমন করতে হবে, ওর বইয়ের প্রচ্ছদ অমন করতে হবে। এর পছন্দ স্নিগ্ধ নীল রং, এর পছন্দ গাঢ় লাল রং।

প্রচ্ছদে এই রং থাকলে ভালো হয়, ভাই। প্রচ্ছদে এই রং থাকলে ভালো হয়, দাদা।

‘ভালো হয়! তবে প্রচ্ছদটা কেন আপনি নিজেই করেন না। রং বলে দিচ্ছেন, ঢং বলে দিচ্ছেন।’

পারলে তো করতামই। ভাব এমন। আরে বইয়ের মলাট যারা বানায়, তারা কেউ কখনো কোনো লেখককে বলেছে, আপনার লেখাটা ভালো লাগল না ভাই। নায়িকার নাম রেখেছেন প্রিয়তী, খুদিস্তা রাখলেন না কেন? নায়কের নাম অরূপ কেন, উন্দা কামাল রাখলে পারতেন।

বিরক্তি-টিরক্তি না, মজা সবটাই। এত লেখক, এত লেখক। কত বই প্রকাশিত হয় এখন একুশে বইমেলা উপলক্ষে? চার হাজার? পাঁচ হাজার? চার-পাঁচ হাজার বই মানে অন্তত হাজার বারশ লেখক। পুরাণের সব দেব-দেবী কি এক ফুলে তুষ্ট হয়েছেন কখনো? তা না। তবে আমি তেমন ভাবতে যাব কেন? ভাবি না। শীতকাল হলো প্রচ্ছদকাল আমাদের। প্রচ্ছদ ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবি না। প্রচ্ছদ বানাই, আনন্দ পাই, কখনো কখনো হতচকিতও হই। বিতং না করে তেমন দুটো অভিজ্ঞতার কথা বলি। কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ করেছি একটা। ক্ষমতাবান কবি। বলার কথা হলো কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ সব সময়ই আমি একটু আলাদা যত্ন নিয়ে করি। ক্ষমতাবানের বইটাও করেছি। আমার যতটুক সাধ্য ততটুকু যত্ন নিয়ে আর কি। সেই প্রচ্ছদ নিয়ে গেছেন প্রকাশ। ছাপাও হয়ে গেছে। দেখে ক্ষমতাবান কবি ফায়ার, ‘এটা কী প্রচ্ছদ হইছে? ও তো আমার কবিতা বুঝতেই পারে নাই। বাম হাতে এঁকে দিছে। এই প্রচ্ছদ পাল্টাতে হবে। ভালো আর্টিস্টকে দিয়ে আমিই করিয়ে দেব। আরে, অমুক ভাই পর্যন্ত বলছেন, এটা ওর স্ট্যান্ডার্ডের কাজই হয় নাই।’

অমুক ভাই দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের একজন। বিদ্বজন তার জ্ঞান আর আমার জ্ঞান? তিনি যে পর্যায় থেকে শিল্প বোঝেন, আমি সে পর্যায় থেকে কী করে বুঝব? বিগত চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর ধরে প্রচ্ছদ খাই, প্রচ্ছদ পরি বললেও।

হায় রে। কোন প্রচ্ছদ ভালো, কোন প্রচ্ছদ খারাপ, এটা এখন কারা ঠিক করেন? সকলেই মাথার ভেতরে যার যার ‘ফ্রেম’ নিয়ে বসে আছেন। এর বাইরে কিছু হলেই, হলো না। ভেরি গুড! কমিটি করে প্রচ্ছদের একটা সংজ্ঞা ঠিক করে দিলে হয় এখন। ইহা প্রচ্ছদ, ইহা প্রচ্ছদ না!

আরেকটা প্রচ্ছদ। বইয়ের নাম বলি। অগ্নি প্রভাত। লেখক সাঈদ আজাদ। ‘শব্দঘর- অন্যদিনের’ উদ্যোগে ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে হচ্ছে বইটা। প্রথম কিস্তি গত বছর ‘শব্দঘর’ ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। পড়ে স্টোনড হয়ে গিয়েছিলাম। এ কোন লেখক? কোত্থেকে? এর লেখা তো আগে পড়িনি। বয়সে তরুণ সাঈদ আজাদ। উপন্যাস লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। বিরাট ক্যানভাস, বিরাট উপন্যাস। অসাধারণ; অসাধারণ এবং অসাধারণ একটা লেখা। প্রাণ দিয়ে করেছি এই বইয়ের প্রচ্ছদটা। সাঈদ আজাদ দেখেছেন কিনা জানি না। দেখে থাকলে তার কী মনে হয়েছে কিংবা যখন দেখবেন, কী মনে হবে! আমি তার লেখা ধরতেই পারি নাই!

দুর! এসব কী লিখছি। কদিন আগে কলকাতায় গিয়েছিল মিথুন। বুদ্ধদার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ফিরেছে। কবি ও মহান চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। দাদা তার ‘কথা সমগ্র ১’ পাঠিয়েছেন মিথুনকে দিয়ে।

ধ্রুবকে অশেষ ভালোবাসা শুভেচ্ছা আর ভালোবাসায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ৫/২/১৯

কিছুদিন আগে দাদার নতুন চলচ্চিত্র ‘উড়োজাহাজ’-এর আন্তর্জাতিক পোস্টার আমি করেছি। পোস্টার দেখে দাদা খুশি হয়েছেন, খুবই খুবই খুশি হয়েছেন। অন্যত্র এ নিয়ে লিখব কখনো।

কলকাতায় আর একজন মানুষের কথা লিখি। ইনি হলেন আমার দাদাঠাকুর। অধীর বিশ্বাস। বনটিয়া, দোয়েল, গাঙচিলের কারিগর। তাকে আমি কেন দাদাঠাকুর ডাকি? পরিচয়ের আগে ডাকতাম না। দেখা হওয়ার পর থেকে ডাকি। কেন? এই মানুষটা আমার ‘দাদাঠাকুর’ বলে।

দাদাঠাকুরও তার প্রকাশনার কিছু চমৎকার বই পাঠিয়েছেন মিথুনের সঙ্গে।

বসে আছি এখন সেসব বই নিয়ে। বুদ্ধদার বই, দাদাঠাকুরের বই, মঞ্জিরা সাহা, শৈলেন সরকার এবং পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই। উল্টেপাল্টে দেখছি না কোনোটাই। প্রচ্ছদ দেখছি শুধু। প্রচ্ছদ, প্রচ্ছদ এবং প্রচ্ছদ। কিংবা ভালোবাসা, ভালোবাসা এবং ভালোবাসা।

আর... আর... আর...

বড় মিস করছি আপনাকে, স্যার। যতদিন প্রচ্ছদ করব, ততদিন করব। শীতকাল, প্রচ্ছদকাল, আপনার জন্য আমার শূন্য শূন্য লাগবেই। যতদিন আছি ততদিন। আপনি কি কোথাও থেকে দেখছেন, এখন আমার শীতকাল কী করে যায়! আপনার লেখা নতুন হিমু বা মিসির আলির প্রচ্ছদ তো আর কখনো করবো না। কখনোই না। স্যার...! শীতকাল যায়...!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App