×

বিশেষ সংখ্যা

গ্রামীণ সাংবাদিকতা ও কাঙাল হরিনাথ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৪:৩৭ পিএম

গ্রামীণ সাংবাদিকতা ও কাঙাল হরিনাথ
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬) একালে প্রায়-বিস্মৃত একটি নাম। অথচ উনিশ শতকে এই মানুষটি নিস্তরঙ্গ গ্রামবাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন। নাগরিক নবচেতনার প্রেরণায় দূর-মফস্বলেও রচনা করতে পেরেছিলেন জাগৃতির বাতাবরণ। এই বহুমাত্রিক মানুষটি একাধারে ছিলেন সাহিত্যশিল্পী, সংবাদ-সাময়িকপত্র-পরিচালক, শিক্ষাব্রতী, সমাজ-সংস্কারক, নারীকল্যাণকামী, দেশহিতৈষী, রায়ত-কৃষক-প্রজাপ্রেমী, সাধক ও ধর্মবেত্তা এবং নব্য-সাহিত্যসেবীদের উদার পৃষ্ঠপোষক। বিশেষ করে গ্রামীণ সাংবাদিকতার জনক হিসেবে তাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। সাময়িকপত্র সম্পাদনা কাঙাল হরিনাথের সামাজিক কর্মকাণ্ডের সর্বাপেক্ষা গৌরবময় অধ্যায়। আশৈশব জমিদার, মহাজন, কুঠিয়াল ও গোরা পল্টনের অত্যাচার ও উৎপীড়ন প্রত্যক্ষ করে হরিনাথের মনে যে প্রতিকারচিন্তা জাগে সেখান থেকেই তিনি সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রেরণা লাভ করেন। কবি ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’র সংবাদদাতা হিসেবে এ-বিষয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ প্রস্তুতির পটভ‚মি রচিত হয়। লোকহিত-ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাঙাল হরিনাথ ১২৭০ সালের ১ বৈশাখ (এপ্রিল ১৮৬৩) ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেই যুগে অখ্যাত ‘মফস্বলপল্লী’ কুমারখালী থেকে এই পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ একটি অসাধারণ ঘটনা। ‘গ্রামবার্ত্তা’ প্রকাশের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হরিনাথ তাঁর ‘স্বলিখিত দিনলিপি’তে উল্লেখ করেছেন : “আমি ইতোপূর্ব্বে নীলকুঠিতে ও মহাজনদিগের গদিতে ছিলাম, জমিদারের সেরেস্তা দেখিয়াছিলাম এবং দেশের অন্যান্য বিষয় অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইয়াছিলাম; যেখানে যত প্রকার অত্যাচার হয়, তাহা আমার হৃদয়ে গাঁথা ছিল। দেশীয় সংবাদপত্রের অনুবাদ রবিন্সন সাহেব যখন অনুবাদ কার্য্যালয় খুলিলেন, আমিও সেইসময় গ্রামবার্ত্তা প্রকাশ করিলাম।” তাঁর অপ্রকাশিত দিনলিপিতে হরিনাথ এ-বিষয়ে আরো লিখেছেন : “গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা সংবাদপত্রিকার দ্বারা গ্রামে অত্যাচার নিবারিত ও নানা প্রকারের গ্রামবাসীদিগের উপকার সাধিত হইবে এবং তৎসঙ্গে মাতা বঙ্গভাষাও সেবিতা হইবেন, ইত্যাদি নানা প্রকার আশা করিয়া গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার কার্য্য আরম্ভ করিলাম।” গ্রাম-হিতৈষণার আদর্শ নিয়েই ‘গ্রামবার্ত্তা’র আত্মপ্রকাশ। বাংলা সাময়িকপত্রের নগরকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে উপেক্ষিত গ্রামীণ-স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে এই পত্রিকার একটি বিশেষ অঙ্গীকার ছিল। ‘গ্রামবার্ত্তা’র প্রথম সংখ্যায় (বৈশাখ ১২৭০) পত্রিকার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে সম্পাদক তাই উল্লেখ করেছিলেন : “... এ পর্য্যন্ত বাঙ্গলা সংবাদপত্রিকা যতই প্রচারিত হইতেছে তাহা কেবল প্রধান প্রধান নগর ও বিদেশিয় সম্বাদাদিতেই পরিপূর্ণ। গ্রামীয় অর্থাৎ মফঃস্বলের অবস্থাদি কিছুই প্রকাশিত হয় না। তজ্জন্য গ্রামবাসীদিগের কোন প্রকার উপকার দর্শিতেছে না। যেমন চিকিৎসক, রোগীর অবস্থা সুবিদিত না হইলে তাহার প্রতিকারে সমর্থ হন না, তদ্রুপ দেশহিতৈষী মহোদয়গণ গ্রামের অবস্থা, অবিদিত থাকিলে কিরূপে তাহার প্রতিকার করিতে যত্নবান হইবেন? যাহাতে গ্রামবাসীদের অবস্থা, ব্যবসায় রীতিনীতি, সভ্যতা, গ্রামীয় ইতিহাস, মফঃস্বল-রাজকর্ম্মচারীগণের বিচার এবং আশ্চর্য্য ঘটনাদি প্রকাশিত হয় তাহাই এই পত্রিকার প্রধানোদ্দেশ্য এবং লোকরঞ্জনার্থ, ভিন্নদেশীয় সম্বাদ ও গদ্যপদ্য চিত্তরঞ্জন বিষয়ও লিখিত হইবেক।...” ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে কয়েক পর্যায়ে মোট ২২ বছর চলেছিল। ‘গ্রামবার্ত্তা’ প্রথমে কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিদ্যারত্ন যন্ত্রে মুদ্রিত হতো। পরে রাজীবলোচন মজুমদারের সহায়তায় হরিনাথ ১২৮০ সালের প্রথমদিকে কুমারখালীতে ‘মথুরানাথ যন্ত্র’ স্থাপন করেন এবং তখন থেকে ‘গ্রামবার্ত্তা’ এই প্রেসে মুদ্রিত হতো। প্রেস স্থাপনের পর হরিনাথ কয়েক বছর ‘গ্রামবার্ত্তা’ পরিচালনা করে ঋণগ্রস্ত হন, তখন কুমারখালী বাংলা পাঠশালার প্রধান শিক্ষক প্রসন্নকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও আরো কয়েকজন হিতৈষীবান্ধব ‘গ্রামবার্ত্তা’র পরিচালনাভার গ্রহণ করেন। তাঁরা কয়েক বছর পত্রিকা প্রকাশ করেন, কিন্তু ক্রমে ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় হরিনাথ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দেন। পরে ১২৮৯ সালের বৈশাখ মাসে কাঙাল-শিষ্য জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব প্রমুখের উদ্যোগে ‘গ্রামবার্ত্তা’ (সাপ্তাহিক) পুনঃপ্রকাশিত হয় এবং ১২৯২ সালের আশ্বিন মাস পর্যন্ত চালু থাকে। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করলে ‘গ্রামবার্ত্তা’ হয়তো আরো দীর্ঘকাল পরিচালিত হয়ে জনগণের সেবা করতে পারত। এই পত্রিকা পরিচালনা করতে গিয়ে হরিনাথ কেবল ঋণগ্রস্তই নয়, বলতে গেলে প্রায় সর্বস্বান্ত হন। ‘গ্রামবার্ত্তা; প্রকাশে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের জন্য হরিনাথ তাঁর আয়ের একমাত্র উৎস বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার কর্মও ত্যাগ করেন। ‘গ্রামবার্ত্তা’র জন্যে কাঙাল যে কী পরিমাণ শ্রম ও ক্ষতিস্বীকার করেন তা তাঁর অপ্রকাশিত দিনপঞ্জি ও সমকালীন সাক্ষ্য থেকে জানা যায়। সাময়িকপত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, একাগ্রতা, নিবেদিতচিত্ততা একটি বিরল ও স্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। নানা প্রতিক‚লতা সত্ত্বেও একক প্রচেষ্টা, শ্রম ও যত্নে হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা’ পরিচালনা করেছেন। তাঁর সাধ ও স্বপ্নের এই পত্রিকা প্রকাশে হরিনাথকে প্রায় এককভাবে সার্বিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ-সম্পর্কে অপ্রকাশিত দিনলিপিতে তিনি বলেছেন : “আমি লেখক, আমিই সম্পাদক, আমিই পত্রিকা লেফাফা ও বিলিকারক এবং আমিই মূল্য আদায়কারী অর্থ সংগ্রাহক।” ‘গ্রামবার্ত্তা’র লোকহিতকর ভূমিকা ‘সোমপ্রকাশ’, ‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘হিন্দু হিতৈষিণী’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা কর্তৃক বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। তাই এর প্রকাশ বন্ধ বা অস্তিত্ব-বিলপুপ্তিতে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘সুলভ সমাচার’ প্রভৃতি সমকালীন পত্র-পত্রিকা যথেষ্ট দুঃখ ও আক্ষেপ প্রকাশ করেছিল। ‘গ্রামবার্ত্তা’ সংবাদ-সাময়িকপত্র যে জনকল্যাণ ও সৎ-সাংবাদিকতার আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল তা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করেছিল। সেই কারণে দূর-মফস্বল থেকে প্রকাশিত হলেও সমকালে ‘গ্রামবার্ত্তা’ একটি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকপত্র হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করেছিল। ‘গ্রামবার্ত্তা’ একদিকে যেমন জনগণের অভাব-অভিযোগ-সমস্যামূলক সংবাদ প্রকাশ করে প্রতিকারের জন্যে জনমত সৃষ্টি ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, অপরদিকে সুপারিশ ও পরামর্শমূলক প্রস্তাব পেশ করে সরকারের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেও চেষ্টা করতো। এই প্রচেষ্টায় ‘গ্রামবার্ত্তা’র সাফল্য ছিল উল্লেখযোগ্য। এ-সম্পর্কে জলধর সেন বলেছেন : “গ্রামবার্ত্তা দ্বারা, প্রদেশের প্রভ‚ত উপকার সাধিত হইয়াছিল। ইহা যে কেবল জমিদারের মহাজনের এবং নীলকুঠির অত্যাচার নিবারণের মুষ্টিযোগস্বরূপ হইয়াছে তাহা নহে, প্রজার প্রতি রাজার কর্ত্তব্য সম্বন্ধে যে সকল প্রবন্ধ থাকিত তদনুসারে কার্য্য করিতে গবর্নমেন্টেরও যথেষ্ট অনুরাগ লক্ষিত হইত। বাঙ্গলা গবর্নমেন্টের বাঙ্গলা সংবাদপত্রের অনুবাদক মি. রবিন্সন্ সাহেব বাহাদুর স্বয়ং বিদ্যারত্ন যন্ত্রে উপনীত হইয়া “গ্রামবার্ত্তা” গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং গবর্নমেন্টের গোচরার্থে গ্রামবার্ত্তা হইতে যে সকল অনুবাদ করিতেন, তাহাতে গ্রাম ও পল্লীবাসী নিরীহ দুঃখীপ্রজার বিস্তর উপকার সাধিত হইয়াছিল। নদীখাল প্রভৃতি পয়ঃপ্রণালী সংস্কারপূর্ব্বক জলকষ্ট নিবারণ, পুলিশ-বিভাগের সংস্কার ব্যবস্থা, গো-ধন রক্ষা, রেলপথ দ্বারা জলনিঃসরণের পথ বন্ধ হওয়ায় এদেশ যে অস্বাস্থ্যকর ও ম্যালেরিয়ার আকরভ‚মি হইতেছে, পোষ্টাফিসের মনিঅর্ডার প্রথা প্রচলন প্রভৃতি অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় সম্বন্ধে হরিনাথ লেখনী পরিচালনা করিয়া রাজা ও প্রজা উভয়েরই হিতাকাক্সক্ষী বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। তৎকালে ‘সোমপ্রকাশ’ ও ‘গ্রামবার্ত্তা’ই উচ্চশ্রেণীর সাময়িকপত্র ছিল” (‘কাঙ্গাল হরিনাথ’, ১ম খণ্ড, কলকাতা, ১৩২০; পৃ. ১২)। কৃষক-তাঁতি, রায়ত-প্রজা, শ্রমজীবী মানুষের সমস্যা ও অধিকার সম্পর্কে ‘গ্রামবার্ত্তা’র ভ‚মিকা ও সচেতনতা ছিল প্রবল। এদের অভাব-অভিযোগের কথা বলতে গিয়ে ‘গ্রামবার্ত্তা’ কোনো দ্বিধা বা কুণ্ঠা বোধ করেনি। পাক্ষিক ‘গ্রামবার্ত্তা’র প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই এদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বর্ণিত হয়েছে। এই দুঃখ-দুরবস্থার বর্ণনায় রায়তপ্রজার প্রতি সহানুভ‚তি, সরকারি ভ‚মিকা সম্পর্কে অভিযোগের সুর ও কখনো ব্যঙ্গের ইঙ্গিতও মেলে। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি দায়িত্ববোধের অভাব বা ঔদাসীন্য সম্পর্কে বেদনা ও অভিযোগ জানিয়ে কর্তব্যচেতনা জাগানোর চেষ্টা রয়েছে। দেশীয় শোষক-জমিদার কিংবা বাক্-সর্বস্ব তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের আচরণ ও ভ‚মিকাও পত্রিকায় সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। দেশীয় তন্তুবায় স¤প্রদায়ের দুরবস্থা এবং সরকারের ঔদাসীন্য সম্পর্কে ‘গ্রামবার্ত্তা’র তীব্র মন্তব্য স্বাদেশিকতার বিশেষ পরিচয় বহন করে : “লাঙ্কেষ্টরের তাঁতিরা যতদিন গবর্নমেন্ট হৃদয়ে বাস করিবে, ততদিন এদেশীয় তাঁতি জোলার দুরবস্থা সেই হৃদয়ে স্থান পাইবে, এরূপ ভরসা করা যায় না” (নভেম্বর ১৮৭৩)। কৃষির উন্নতি ও মধ্যশ্রেণির আয়-উপার্জনের বিষয়টি পরস্পর-সাপেক্ষ বিবেচনা করে ‘গ্রামবার্ত্তা’ অভিমত প্রকাশ করেছে : “এক্ষণে গ্রাম ও পল্লীবাসী মধ্যবৃত্তি লোকের জীবিকানির্ব্বাহ করা কঠিন হইয়াছে।... জমিদারদিগের সহিত প্রজাদিগের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত না হইলে, গ্রাম ও পল্লীবাসী মধ্যমাস্থ লোকদিগের অবস্থান্নোতির অন্য কোন উপায় নাই। বস্তুতঃ মধ্যবৃত্তি লোকের কৃষিকার্য্যে নিযুক্ত না হইলে চাষের উন্নতি হইবে না। খাল খনন করিয়া নদীর জল আনিলে কোন্ ভ‚মির উপকার ও কোন্ ভ‚মির অপকার হয়; কি প্রণালীতে চাষ করিলে অধিক লাভ হইতে পারে; ইত্যাদি কৃষিকার্য্য বিষয়ী জ্ঞান যাহা কিছু, মধ্যবৃত্তি ও চাষালোকেরই আছে; বিলাসী বড়মানুষদিগের তাহা কিছুমাত্র নাই” (জানুয়ারি ১৮৭০)। পাবনার প্রজা-বিদ্রোহ সম্পর্কে ‘গ্রামবার্ত্তা’ বিশেষ সহানুভ‚তিশীল ছিল। রায়ত-প্রজার উপর জমিদারের অন্যায় পীড়নই এই অসন্তোষের কারণ বলে ‘গ্রামবার্ত্তা’ মনে করেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রে (জুন ১৮৭৩) জানা যায়, প্রজাপীড়ন ও অযৌক্তিক খাজনা বৃদ্ধিই এই বিক্ষোভের মূল কারণ। বাংলাদেশের জমিদার-স¤প্রদায়ের প্রজাহিতকর কর্মোদ্যোগের মূলে ছিল তাঁদের শোষণ সম্পর্কে দৃষ্টি-বিভ্রান্তির চেষ্টা এবং রাজ-সম্মানলাভের আকাক্সক্ষা। জমিদারের এই স্বরূপ উন্মোচন করে ‘গ্রামবার্ত্তা’ স্পষ্ট বক্তব্য পেশ করেছে : “জমিদারদিগের দ্বারা যত বিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছে, রাজদ্বারে সম্মান লাভেচ্ছাই তাহার অধিকাংশের কারণ।... মফস্বলের এক একজন জমিদার দাতব্য ডিস্পেনসারি ও বিদ্যালয়াবরণ দিয়া, আমেরিকা দেশের ভ্যাম্পাইয়ার বাদুড়ের ন্যায় প্রজার রক্তপান করেন। হাকিমেরা মফস্বলে আসিয়া স্কুল ও ডিস্পেনসারি দেখিয়া ভুলিয়া যান, প্রজার ক্রন্দন কিছুই শুনেন না।... জোড়াসাঁকোনিবাসী শ্রদ্ধাস্পদ জমিদার শ্রীযুক্ত বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এদেশের অদ্বিতীয় ধার্ম্মিক।... স¤প্রতি একটা কথা শুনিয়া দুঃখিত ও বিস্মিত হইয়াছি। তিনি শিলাইদহের স্কুল হইতে ইংরেজি শিক্ষা উঠাইয়া দিয়াছেন” (আগস্ট ১৮৭২)। হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা’ রাজশক্তির সমালোচনাতেও পিছ-পা ছিল না। পল্লীবাসীর নিদারুণ জলকষ্টে সরকারের উদ্যোগহীনতাকে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করে পত্রিকায় লেখা হয়েছে : “এতৎ প্রবন্ধে কর্তৃপক্ষ-সমীপে এইমাত্র বক্তব্য, গবর্নর জেনারেল প্রভৃতির সিমলার বিহারের নিমিত্ত প্রতি বর্ষে রাজকোষ হইতে সাড়ে চারিলক্ষ টাকা ব্যয় হয়, গ্রাম ও পল্লীবাসীর দরিদ্র প্রজাদিগের নিমিত্ত কিঞ্চিৎ ব্যয় কি রাজধর্ম্ম বিরুদ্ধ” (জুন ১৮৭২)। প্রশাসন-যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের ত্রু টি-বিচ্যুতি-স্খলনকে ‘গ্রামবার্ত্তা’ কঠোরভাবে সমালোচনা করেছে। পাবনার ইংরেজ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট একবার এক দরিদ্র বিধবার একটি দুগ্ধবতী গাভী জবরদস্তি করে সংগ্রহ করেন। হরিনাথ ম্যাজিস্ট্রেটের এই অসঙ্গত ও অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করে ‘গ্রামবার্ত্তা’য় ‘গরুচোর ম্যাজিস্ট্রেট’ নামে সংবাদ প্রকাশ করেন। ম্যাজিস্ট্রেটের এই কাজ তাঁর পদমর্যাদা ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে যে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, হরিনাথ নির্ভীকভাবেই সেই মত প্রকাশ করেন। ‘গ্রামবার্ত্তা’র সংবাদে ম্যাজিস্ট্রেট হরিনাথের প্রতি রুষ্ট হন এবং তাঁকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কাঙালের অসামান্য জনপ্রিয়তা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে তাঁকে বিপদগ্রস্ত করা সম্ভব হয়নি, বরঞ্চ পরবর্তীকালে স্বাধীন মতপ্রকাশের নির্ভীকতার জন্যে কাঙাল উক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশংসা অর্জন করেন। অনেকাংশে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও হরিনাথ নির্ভীক ও সৎ-সাংবাদিকতার একটি আদর্শ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশ্য শাসক-সরকার, নীলকর, জমিদার, মহাজন প্রমুখ কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করার কারণে তাঁকে অনেক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। এতে যে তাঁকে কেবল পীড়িত-অপদস্থ-বিপন্ন হতে হয়েছে তাই নয়, কোনো কোনো সময়ে তাঁর জীবন-সংশয়ও হয়েছে। নির্ভীক ভূমিকার জন্যে তাঁকে ‘জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এবং পরগণার জমিদার’ উভয়েরই বিরাগভাজন হতে হয়। কিন্তু কাঙাল সাহস ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে এইসব প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেছেন, তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। এ-সম্পর্কে হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা’য় লিখেছেন : “মাতৃ ও পিতৃভক্ত কোন ব্যক্তিকে কেহ যদি বলে, তুমি তোমার পিতামাতার সেবা পরিত্যাগ কর, যদি না কর তবে দণ্ডিত হইবে। এই দণ্ডভয়ে কি পিতামাতার সেবা পরিত্যাগ করিতে পারেন? সত্যপালনই জগৎপিতার সেবা করিবার উপায়; এই সত্য পালন করিয়া জগৎপিতার সেবা করিতে যদি কেহ দণ্ড করেন, তাহা হইলে কি আমরা তাঁহার সেবা পরিত্যাগ করিব? অতএব যাঁহারা নতুন আইনের কথা শুনিয়া গ্রাম ও পল্লীবাসীদিগের প্রতি অত্যাচার করিতে আরম্ভ করিয়াছেন, আমরা তাহাদিগকে বলিতেছি, ভ্রাতৃভাবে বিনয় করিয়া বলিতেছি, অত্যাচার পরিত্যাগ করুন।... অত্যাচার করিয়া একদিন না হয় দুদিন পার পাইবে, তিনদিনের দিন অবশ্যই তাহা রাজার কর্ণগোচর হইবে। আমরা এতদিন সহ্য করিয়াছি, আর করিতে পারি না। সকল কথা প্রকাশ করিয়া কর্ত্তব্য সম্পাদন করিতে ত্রু টি করিব না। ইহাতে মারিতে হয় মার, কাটিতে হয় কাট, যাহা করিতে হয় কর, প্রস্তুত আছি।” হরিনাথ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে সততা ও সাহসের পরিচয় প্রদান করেন তা তাঁকে কিংবদন্তির পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। বিশেষ করে প্রজাপীড়নের সংবাদ-প্রকাশকে কেন্দ্র করে ঠাকুর-জমিদারদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তাঁর চরিত্রে স্বতন্ত্র মর্যাদা আরোপ করেছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবারের জমিদারি ছিল কুষ্টিয়ার বিরাহিমপুর পরগণায়। শিলাইদহে ছিল তার সদর দফ্তর। ঠাকুর-জমিদারদের এলাকায় ‘প্রিন্স’ দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকেই প্রজা-পীড়নের অভিযোগ ছিল। ‘মহর্ষি’ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় এই পীড়ন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। খাজনা বৃদ্ধি, নানা আবওয়াব-কর আরোপ, জুলুম করে প্রজার ভিটেমাটি উচ্ছেদ, অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টিতে বিপন্ন রায়ত-প্রজার নিকট থেকে বলপূর্বক খাজনা আদায় ইত্যাদি ঘটনা হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা’য় দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করতেন। এর পাশাপাশি প্রজাকল্যাণে জমিদারের অনীহা বা ঔদাসীন্য সম্পর্কেও সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। ‘গ্রামবার্ত্তা’র এই জমিদার-স্বার্থবিরোধী ও তাঁদের চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচনকারী ভ‚মিকা অনুমোদন করা ঠাকুর-জমিদারদের পক্ষে সঙ্গত কারণেই সম্ভব হয়নি। তাই নানাভাবে তাঁরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। মহর্ষিদেবের প্রযত্নে কাঙাল নানাভাবে নিগৃহীত হন। এই অত্যাচারী জমিদার সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়ে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় আবেগপূর্ণ ভাষায় বলেছেন : “হরিনাথ যাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া সুতীব্র সমালোচনায় রাজদ্বারে পল্লীচিত্র বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তিনি এ দেশের সাহিত্য-সংসারে এবং ধর্ম্মজগতে চিরপরিচিত; তাঁহার নামোল্লেখ করিতে হৃদয় ব্যথিত হয়, লেখনী অবসন্ন হইয়া পড়ে” (‘সাহিত্য’, বৈশাখ ১৩০৩; পৃ. ২৫)। ঠাকুর-জমিদারদের পক্ষ থেকে প্রথম পর্যায়ে অর্থের প্রলোভনে হরিনাথকে বশ করার চেষ্টা হয়। এই চেষ্টা ব্যর্থ হলে লাঠিয়াল বাহিনী নিযুক্ত করা হয়। “কিন্তু লাঠিয়ালেরা তেজস্বী হরিনাথের দেহ স্পর্শ করিতে সাহসী হইল না। তীতু মিঞা, আব্বাস মিঞা, ঋতু মিঞা প্রভৃতি দল হাল ছাড়িয়া দিলে একজন পাঞ্জাবি গুণ্ডা হরিনাথের বাড়ি সশস্ত্র উপস্থিত” (‘ভারতবর্ষ’, বৈশাখ ১৩৩৮; পৃ. ৭৮৩)। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে পাঞ্জাবি গুণ্ডার উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। কাঙালের অপ্রকাশিত ‘দিনপঞ্জি’ থেকে জানা যায়, জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর হাত থেকে বিপন্ন বন্ধু হরিনাথকে রক্ষা করার জন্য বাউলসাধক লালন ফকির “তাঁর দলবল নিয়ে নিজে লাঠি হাতে সেই লাঠিয়ালের দলকে আচ্ছা করে ঢিট্ করে সুহৃদ কৃষক-বন্ধু হরিনাথকে রক্ষা করেন” (হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ‘লোকসঙ্গীত সমীক্ষা : বাংলা ও আসাম’, কলকাতা, ১৩৮৫; পৃ. ৬৭-৬৮)। হরিনাথের সাহিত্য-শিষ্য অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন : “যতদিন ‘গ্রামবার্ত্তা’ জীবিত ছিল, প্রায় ততদিনই কোন-না কোনরূপে হরিনাথকে জমিদারের উৎপীড়ন সহ্য করিতে হইত”। অক্ষয়কুমারকে লিখিত এক পত্রে (২১ চৈত্র ১২৮৫) কাঙাল নিজেই বলেছেন : “জমিদারেরা প্রজা পরিত্যাগ করিয়া আমার প্রতি যতদূর সাধ্য অত্যাচার করেন।” কিন্তু উপকৃত পল্লীবাসী হরিনাথের বিপদ ও সংকটে নিস্পৃহ ও উদাসীন ভূমিকা পালন করলে মর্মাহত হরিনাথ ঐ পত্রে আক্ষেপ করে লিখেছেন : “জমিদারেরা যখন আমার প্রতি অত্যাচার করে এবং আমার নামে মিথ্যা মোকদ্দমা উপস্থিত করিত যত্ন করে, আমি তখন গ্রামবাসী সকলকে ডাকিয়া আনি এবং আত্মাবস্থা জানাই। গ্রামের একটি কুকুর কোন প্রকারে অত্যাচারিত হইলেও গ্রামের লোকে তাহার জন্য কিছু করে, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ও আমার এতদূরই দুর্ভাগ্য যে, আমার জন্য কেহ কিছু করিবেন, এরূপ একটি কথাও বলিলেন না। যাঁহাদের নিমিত্ত কাঁদিলাম, বিবাদ মাথায় করিয়া বহন করিলাম, তাঁহাদিগের এই ব্যবহার!” যুগের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে সংবাদ-সাময়িকপত্র পরিচালনায় হরিনাথের সাফল্য ছিল অসাধারণ। আর্থিক অসঙ্গতি, গ্রাহক-পৃষ্ঠপোষকদের সহযোগিতার অভাব, জমিদার-মহাজনদের বিরোধিতা, পত্রিকা প্রকাশের আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার অভাব সত্তে¡ও হরিনাথ দীর্ঘ ২২ বছর ‘গ্রামবার্ত্তা’ প্রকাশ করে জনকল্যাণের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা অবিস্মরণীয়। প্রথম পর্যায়ে নিকটবর্তী মফস্বলের কোথাও কোনো ছাপাখানা না থাকায় ‘গ্রামবার্ত্তা’ যখন কলকাতা থেকে মুদ্রিত হতো তখন কাঙালকে যথেষ্টই সমস্যা ও অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে। রেল-যোগাযোগ তখনো স্থাপিত না হওয়ায় কুমারখালী-কলকাতার যাতায়াত ছিল খুবই দুরূহ ও কষ্টসাধ্য। সে সময়ে সংবাদপত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাও স্পষ্ট ছিল না। এইসব প্রতিক‚লতা ও অন্তরায় সত্তে¡ও হরিনাথ পল্লীবাসীর দুঃখ-মোচনের ব্রত নিয়ে ‘গ্রামবার্ত্তা’ প্রকাশ করেন। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আর্থিক ঝুঁকি গ্রহণ করেও কেবলমাত্র জনকল্যাণ ও লোকশিক্ষার জন্যে তিনি অতি সুলভ মূল্যে পত্রিকা প্রচারে ব্রতী হন। পত্রিকা-সম্পাদক হিসেবে হরিনাথের বিশেষ খ্যাতি ও পরিচিতি ছিল। জানা যায়, কুমারখালী অঞ্চলে হরিনাথ স্বনামে বিশেষ পরিচিত ছিলেন না, ‘কাঙাল ফিকিরচাঁদ’ নামে অনেকে চিনত, কিন্তু ‘এডিটর মহাশয়’ বললে শিশুরাও তাঁকে চিনতে পারত। এই ছিল তাঁর “সার্ব্বজনিক নাম”। সাময়িকপত্র-পরিচালনা ছিল হরিনাথের জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ ‘মিশন’। এ-বিষয়ে তিনি যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন সত্যিকার অথেই তা স্মরণীয়। বিপন্ন ও পীড়িতের স্বার্থরক্ষায় ‘গ্রামবার্ত্তা’র ভ‚মিকা ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও কার্যকর। যে উদ্দেশ্যে ও অঙ্গীকার নিয়ে ‘গ্রামবার্ত্তা’র যাত্রা শুরু হয়েছিল সম্পাদক হিসেবে হরিনাথ সততার সঙ্গে তা পালন করেছিলেন। ‘গ্রামবার্ত্তা’র সাফল্য সম্পর্কে হরিনাথ তাঁর অপ্রকাশিত দিনলিপিতে উল্লেখ করেছেন : “... পূর্ব্বের অনেক ধনবানাদি সবল লোকেরা দুর্ব্বলের প্রতি প্রকাশ্যরূপে সহসা যে প্রকার অত্যাচার করিতেন, এক্ষণে যে তদ্রুপ করিতে সাহসী হইতেছেন না... গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকাই তাহার কারণ।” সমাজে যে এই পত্রিকার একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল এই বক্তব্য থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্পাদক হিসেবে হরিনাথের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁর সাহিত্য-শিষ্য দীনেন্দ্রকুমার রায় যে মন্তব্য করেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ... হরিনাথ উদরান্নের সংস্থানের আশায় সম্পাদকের বৃত্তি অবলম্বন করেন নাই, স্বত্বাধিকারীর মনোরঞ্জনের জন্য ভাড়াটে সম্পাদকের মত তাঁহাকে আত্মসম্মান বিক্রয় করিতে হয় নাই...। ...হরিনাথ বহু অত্যাচারে জর্জ্জরিত, নানা অভাবে পীড়িত পল্লী-অঞ্চলের অভাব অভিযোগ বিদূরিত করিবার অভিপ্রায়ে লেখনীধারণ করিয়াছিলেন; কাহারও ধমকে তিনি এই কঠোর কর্ত্তব্যব্রত পরিত্যাগ করেন নাই, কাহারও লাঠীর ভয়ে তিনি তাঁহার স্বাধীন মন্তব্য প্রত্যাহার করেন নাই। আর্তের পরিত্রাণের জন্য, উৎপীড়কের দমনের নিমিত্তে তিনি লেখনীর ব্যবহার করিয়াছিলেন।... হরিনাথ সংবাদপত্র-সম্পাদকগণের আদর্শ ছিলেন। মুদ্রাযন্ত্রের এই অতি-প্রসারের দিনে, এখনও মফস্বল হইতে কত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হইতেছে, কিন্তু হরিনাথের গ্রামবার্ত্তার মত বার্ত্তাসহ একালে সর্ব্বদা দেখিতে পাই না” (‘সাহিত্য’, আষাঢ় ১৩২০; পৃ. ১৯৮)। হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা’ যথার্থই পল্লীর জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। এই পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে পল্লীবাসী এর প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। পরবর্তীকালে যে-সব পত্র-পত্রিকা এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয়, তা ‘গ্রামবার্ত্তা’র মতো পরিপূর্ণভাবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়নি। মীর মশাররফ হোসেন পরিচালিত ‘হিতকরী’ পত্রিকা‘য় ‘পল্লীবাসী প্রজা’র নামে প্রকাশিত একটি চিঠিতে একজন পত্রলেখক তাই আক্ষেপ করে লেখেন : “আজ কয়েক বৎসর হইতে গ্রামবার্ত্তার কণ্ঠ নীরব হইয়াছে। গ্রামবার্ত্তার সতেজ লেখনী প্রভাবে এ অঞ্চলের পুলিশ, বিচারক, হাকিম, মিউনিসিপ্যাল কমিশনার, জমিদার প্রভৃতির অত্যাচার শান্তভাব ধারণ করিয়াছিল। গ্রামবার্ত্তার জীবন এই সমস্ত অত্যাচার কাহিনী প্রকাশ করিয়া অনেকসময় নানা বিপদে পড়িতে হইয়াছিল যে তাহার আর উল্লেখের প্রয়োজন নাই; এ প্রদেশের সকলেরই অন্তরে তাহা জাগরিত রহিয়াছে।... তাই আমাদের নিবেদন গ্রামবার্ত্তার কণ্ঠ নীরবের পর যখন হিতকারী অভ্যুদয় হইয়াছে; তখন আমরা পল্লীবাসী আমাদের দুঃখের কথা গ্রামবার্ত্তায় যেমন তীব্রভাবে আলোচিত হইয়া রাজার গোচর করিত, সেইরূপ আলোচিত হইয়া আমাদের দুঃখ দূর করিতে চেষ্টা করুন।... পূর্ব্বে যখনই দুঃখ পাইতাম তখনই গরীবের দুঃখের দুঃখী, কান্নায় সমভাগী গ্রামবার্ত্তার দ্বারে গিয়া কতবার কাঁদিতাম। স্বকরুণ স্বরে আমাদের জন্য কত কান্নাই সম্পাদক রাজার নিকট, জমিদারের নিকট না কাঁদিয়াছেন; কিন্তু এখন কাহার কাছে যাইব?... গ্রামবার্ত্তার স্থানে আবার হিতকারীকে আমরা দেখিতে পাইয়া গ্রামবার্ত্তার অভাবকষ্ট ভুলিয়া যাইব” (‘হিতকরী’, ২৬ আগস্ট ১৮৯১; পৃ. ১০৮)। ‘গ্রামবার্ত্তা’ পল্লীবাসী প্রজা-সম্প্রদায়ের মনে যে কী গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল, ‘গ্রামবার্ত্তা’ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরও তার অভাব যে কী তীব্রভাবে সমস্যা-জর্জরিত ও পীড়িত পল্লীবাসী অনুভব করেছেন, তার স্পষ্ট প্রমাণ ‘হিতকরী’তে প্রকাশিত এই পত্র। এই পটভ‚মিকা মনে রাখলে এ-কথা বলতেই হয়, গ্রামীণ সাংবাদিকতার জনক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পত্রিকা, যা কৃষক-প্রজা-রায়ত-শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যশ্রেণির স্বার্থের অনুক‚লে একটি যুগোপযোগী ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App