×

জাতীয়

গতি ফেরাবে মেট্রোরেল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:৪২ এএম

গতি ফেরাবে মেট্রোরেল
গতি ফেরাবে মেট্রোরেল
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের সূচনা করবে মেট্রোরেল। আগামী ডিসেম্বরেই রাজধানী ঢাকায় ঘুরবে মেট্রোরেলের চাকা। পুরো প্রকল্প এখন দৃশ্যমান। উত্তরার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম অংশের কাজের ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। শুধু পিয়ারই ওঠেনি, দিয়াবাড়ী অংশে মেট্রোরেলের অবকাঠামো প্রায় ১ কিলোমিটার পুরোপুরি দৃশ্যমান। ফাউন্ডেশনের কাজ শেষে এখন সুপার স্ট্রাকচারের নির্মাণ কাজ চলছে। দিয়াবাড়ী অংশে রেলের ট্র্যাক বসানোর কাজও শুরুর প্রস্তুতি চলছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ট্র্যাক বসানো শেষে মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক পরিচালনা শুরু হবে। ইতোমধ্যেই জাপানে মেট্রোরেলের কোচ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে মেট্রোরেলের চলাচলের জন্য নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার কাজও এগিয়ে চলছে। রাজধানীর যানজট নিরসনে ২০ বছর মেয়াদি সংশোধিত পরিবহন কৌশল পরিকল্পনা (আরএসটিসি) অনুযায়ী মোট ৫টি মেট্রোরেলের রুট নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে এমআরটি-৬। এখন এই প্রকল্পের কাজ চলছে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টেুরেন্টে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় এই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাইকার এক সদস্য নিহত হন। এরপর প্রকল্পের কার্যক্রম বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। তবে পরে আবার শুরু হয়। প্রকল্প পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক জানান, প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে। তবে চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম অংশের কাজ শেষে মেট্রোরেল চলাচল শুরু করবে। মেট্রোরেল চালু হলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যেই দিয়াবাড়ী অংশে প্রকল্পের অবকাঠামো এক কিলোমিটারের বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। সেগমেন্ট বসানোর সঙ্গে সঙ্গেই রেললাইন বসানো হবে। সেগমেন্ট তৈরি আছে। আগামী জুন-জুলাই মাসের দিকে রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হবে বলে আমরা আশা করছি। সরেজমিন দেখা গেছে, প্যাকেজ-৩ ও প্যাকেজ-৪-এর আওতায় উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত প্রকল্পের প্রথম অংশের নির্মাণ কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ভায়াড্রাক্ট ও ৯টি স্টেশনের নির্মাণ কাজ চলছে। পুরো প্রকল্পে মোট ৭৬৬টি পাইলক্যাপের মধ্যে ইতোমধ্যেই ৩২৭টির কাজও শেষ হয়েছে। ১৩০টি পিয়ার দৃশ্যমান। আরো ৩২৭টি পাইলিং হয়েছে। এগুলোতেও দ্রুত পিয়ার জেগে উঠবে। এ ছাড়া মোট ৪৪৮টি পিয়ার হেডের মধ্যে ৮৮টি এবং ৪ হাজার ৫৭৭টি প্রিকাস্ট সেগমেন্টের মধ্যে ৬১৭টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। উত্তরার দিয়াবাড়ীতে ৬০ একর জমিতে মেট্রোরেলের ডিপো হবে। এখানে মাটির নিচের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এখন ওপরের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। একই সঙ্গে ১০ তলা বিশিষ্ট কন্ট্রোল রুম ও অন্যান্য কয়েকটি ভবন নির্মাণ কাজ শেষের দিকে এগিয়ে চলছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অপারেশন কন্ট্রোল টাওয়ার, প্রধান ওয়ার্কশপ নির্মাণ, স্ট্যাবলিং ইয়ার্ড (বিরতির সময় ট্রেন রাখার স্থান), ট্রেন মেরামত ও ওভারহলোর মালামালের গুদামঘর নির্মাণের কাজ চলছে। এ ছাড়া ট্রেন মেরামত ও ওভারহোল স্থান, ট্রেন ইন্সপেকশন, জেনারেটর ও ইলেকট্রিক্যাল ভবন, ট্রেন ওয়াশ স্থাপনা, ম্যানুয়াল ট্রেন ওয়াশিং, বহুতল কার পার্কিং ও গ্রিন স্পেসের কাজও চলছে। আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টি স্টেশন নির্মাণের জন্যও পাইলিংসহ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে। অন্যদিকে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দ্বিতীয় অংশের কাজও এগিয়ে চলছে। এই অংশে পিয়ার তৈরির জন্য পাইলিং শুরু হয়েছে। ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানেও মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। রাস্তার প্রায় অর্ধেকজুড়েই বেরিকেড দিয়ে চলছে মেট্রোরেলের কাজ। কাজের জন্য কোথাও আইল্যান্ড, কোথাও ফুটপাত, কোথাও পার্ক, আবার কোথাও ফুট ওভারব্রিজ ভেঙে ফেলা হয়েছে। মেট্রোরেল নির্মাণের কারণে সড়কের অবকাঠামো বদলে যাচ্ছে। চলতি বছরের শেষে এই অংশে অনেক পিয়ার দৃশ্যমান হবে। প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, মোট ৮টি প্যাকেজের আওতায় পুরো মেট্রোরেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। ঢাকা ম্যাস-ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রকল্পের আওতায় মেট্রোরেল নির্মাণে মূল কাজ করবে। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডের দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা দিন-রাত এক করে কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানের আর্থিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ১৬ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকার জোগান দেবে। অবশিষ্ট টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। মেট্রোরেলের কোচগুলো ইতোমধ্যেই জাপানে তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। জাপানের বিখ্যাত নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘কাওয়াসাকি মিৎসুবিশি কনসোর্টিয়ামের’ নিজস্ব কারখানায় অত্যাধুনিক কোচগুলো তৈরি হচ্ছে। কোচগুলোতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রঙের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নৌপথে কোচগুলো জাপান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হবে। নতুন এই ট্রেন চালানোর জন্য লোকজনকে টেনিং দেয়া হবে। মোট ২৪ জোড়া অর্থাৎ ৪৮টি কোচ মেট্রোরেলে চলাচল করবে। প্রাথমিক অবস্থায় একটি কোচে ৬টি করে বগি থাকবে। পরে আরো দুটি করে বগি বাড়িয়ে ৮টি করা হবে। প্রতি ৪ থেকে ৫ মিনিট পরপর রেল স্টেশন ছেড়ে যাবে। কোচগুলো স্টিলের তৈরি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এতে উভয় পাশে লম্বা সিটে বসে ও দাঁড়িয়ে একসঙ্গে ১ হাজার ৭৩৮ জন যাত্রী চলাচল করতে পারবে। অসুস্থ, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য দুটি হুইল চেয়ার থাকবে। মেট্রোরেলের কোচগুলোতে ৯৪২ জন যাত্রী বসে এবং ৭৫৪ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে যেতে পারবেন। প্রতিটি কোচে ৪টি করে স্বয়ংক্রিয় দরজা থাকবে। মেট্রোরেলের কোচের মতো স্টেশনগুলোও এলিভেটেড ও বিদ্যুৎ চালিত স্টেশন হবে। প্রতিটি স্টেশন তিন তলা হবে। তৃতীয় তলায় থাকবে প্লাটফর্ম। প্লাটফর্ম থেকে ট্রেনে ওঠার গেটও স্বয়ংক্রিয় হবে। ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়ানোর পর একই সঙ্গে কোচের দরজা এবং স্টেশনের দরজা খুলবে ও বন্ধ হবে। স্টেশনে টিকেট কাউন্টার থাকবে দোতলায়। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই টিকেট কাটতে হবে। সবকিছুর জন্যই স্টেশনে নির্দেশিকা থাকবে। স্টেশনের প্লাটফর্মে উঠা-নামার জন্য চলন্ত সিঁড়ি (এক্সিলেটর) থাকবে। পুরো স্টেশন এলাকা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় থাকবে। কোচগুলো যাত্রী ওঠানামার পর ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে। চলার সময় ট্রেনের শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যাধুনিক ব্যবস্থা থাকবে। উত্তরা থেকে ৩৫ মিনিটে মতিঝিল পৌঁছবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশনে গাড়িতে যাত্রী উঠা-নামা করাবে। স্টেশনগুলো হলো উত্তরা-উত্তর, উত্তরা-সেন্টার, উত্তরা-দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিল। মেট্রোরেলের ট্র্যাক নির্মাণ শেষ হলে কোচগুলো লাইনে বসানো এবং এরপর বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হবে। মেট্রোরেলের চলাচলের জন্য নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা থাকবে। এ লক্ষ্যে দিয়াবাড়ীতে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। এখানেও কাজের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার কারণে কখনোই কোনো ধরনের বিদ্যুৎ সমস্যা থাকবে না। রেলের চলাচল বন্ধ হবে না। তবে মেট্রোরেল চলাচলের সময় এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। ভোর ৪টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App