×

বিশেষ সংখ্যা

একুশে ফেব্রুয়ারি, বইমেলা ও লিট্ল ম্যাগাজিন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:৪৭ পিএম

একুশে ফেব্রুয়ারি, বইমেলা ও লিট্ল ম্যাগাজিন

একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতি। মানুষের মুখের ভাষার অধিকারই শুধু নয়, সমগ্র জাতির অধিকার ও অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে এই একুশের চেতনাকে ঘিরে। মায়ের মুখের ভাষার এই দাবি পৃথিবীর সব মানুষের জন্মগত অধিকার। এটা নিছক কোনো পাওনা কিংবা বাড়তি চাওয়া নয়- এটা হচ্ছে স্বাধীনভাবে মন খুলে কথা বলার অধিকার, মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলার অধিকার। এই ভাষার দাবিকে অগ্রাহ্য করার দৃষ্টতা দেখানো কারোর পক্ষেই সম্ভব হয়নি, আগামীর পৃথিবীর জন্যও সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এর কারণ পণ্যদ্রব্যের মতো মানুষের স্বকীয়তা বিক্রি হয়ে যাওয়ার অশুভ কাল বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। বাঙালি জাতি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের কবল থেকে স্বাধীনতা পেয়েও দেশীয় শোষকের কবলে যেন নতুন করে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এটাও আরেক ধরনের শোষণ। সচেতন মানুষের তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি।

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গৌরবময় দিন। এটি ক্যালেন্ডারের পাতায় একটি দিন মাত্র নয়, এটি পৃথিবীর শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের রক্তঝরা দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে সভ্যতার ইতিহাসে। পৃথিবীব্যাপী ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আজ শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

আজ বাঙালি আর বাংলাদেশের পরিচিতির প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের রক্তে নির্মিত শহীদ মিনার। মায়ের মুখের ভাষার সম্মান রক্ষা করার এই দিন- আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’- আজ সারা দুনিয়ার মাতৃভাষা সঙ্গীত। ভাবতেও গর্বে বুক ভরে যায়!

এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় উত্থাপন করাও যৌক্তিক মনে হয় আজ। তা হলো- আমরা ইংরেজি ভাষার অনুকরণে বা বাংলা ভাষার আধুনিকায়ন করার লক্ষ্যে অনেক শব্দবন্ধ পরিমার্জন করার কথা ভাবি। ভাষা যেহেতু নদীর গতির মতোই প্রবহমান, তা ক্রমাগত নতুনতর দিকে বাঁক পরিবর্তন করে করেই এগিয়ে যাবে- এটাই স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু যেসব শব্দবিন্যাস- জাতীয় ক্ষেত্রে আমাদের প্রতীক অর্থাৎ বিশেষ নির্দেশক চিহ্ন হয়ে গেছে, সেসব শব্দ পরিবর্তন বা সংশোধন করা কতটুকু সমীচীন তা ভেবে দেখা দরকার। যেমন: ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘সাতই মাচর্’, ‘ছাব্বিশে মাচর্’, ‘ষোলোই ডিসেম্বর’, ‘পহেলা বৈশাখ’ ইত্যাদি।

আমরা অবশ্যই লেখালেখির সময় বাক্যনির্মাণে- ১ জানুয়ারি, ২ জানুয়ারি বা ৩ বৈশাখ লিখতে পারি। কিন্তু পূর্বে বর্ণিত বিশেষ দিনগুলো উল্লেখ করার সময় সেই নির্দিষ্ট শব্দটি প্রতীকী-শব্দ হিসেবে তা যেভাবে বিশেষ দিনের প্রতীক হয়ে গেছে, সেভাবেই তার ব্যবহার সমীচীন মনে করি। আমরা কি কোনো অবস্থাতেই- ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশ ফেব্রুয়ারি’ কি লিখতে পারবো? না, পারবো না! এটা এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতীক!

এ ছাড়া স্ত্রীবাচক শব্দ ব্যবহারেও পরিবর্তন আনা দরকার, হচ্ছেও ধীরে ধীরে। আমরা এখন ‘অধ্যাপক’, ‘প্রভাষক’, ‘বন্ধু’, ‘পরিচালক’ বলছি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। আমরা একইভাবে উভয় ক্ষেত্রে বলতে পারি- ‘লেখক’, ‘ছাত্র’ ইত্যাদি পরিচিতিমূলক শব্দও। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিভাজন না করেই পারি। আমরা সবাই মানুষ, যোগ্যতার বা পরিচিতির বেলায় স্ত্রীবাচক শব্দ রাখার কি আদৌ দরকার আছে? আমরা একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এই বৈষম্যমূলক পরিচিতি কি উঠিয়ে দিতে পারি না! আমরা এও দেখি ‘সভাপতি’ শব্দ লিখতে অনেকে অস্বস্তিবোধ করেন। আমরা যে সব শব্দ ব্যবহার করি- তার অর্থ আমরাই নির্দেশ করি। শব্দার্থ নির্ভর করে শব্দের ব্যবহারের ওপর।

একই শব্দ বহু অর্থকে নির্দেশ করে। ‘পতি’ শব্দের অর্থ কি? ‘পতি’ শব্দের অর্থ- কর্তা, নেতা, প্রধান ব্যক্তি ইত্যাদি। হতে পারে পরিচালক, পালক, প্রভু প্রভৃতিও। আর আমরা এই শব্দার্থ শুধু ‘স্বামী’তেই আবদ্ধ করে রেখেছি। তা-ই বা কতটুকু যৌক্তিক? ভাষা গতিশীল, পরিবর্তশীল। তা কি কোনো শব্দের অর্থকে অপরিবর্তনীয় মনে করে আঁকড়ে ধরে বসে থাকবে? আমরা কি এটুকু বুঝতে পারি না- সভাপতি শব্দের অর্থ ‘প্রধান’ ব্যক্তি। সভার প্রধান, কোনো বিভাগের প্রধান, কোনো সংস্থার প্রধান ইত্যাদি! আমাদের আরো উদার মানসিকতা নিয়ে পথ চলতে হবে, তুলে দিতে হবে- নারী-পুরুষের যোগ্যতার বিভক্তি-চিহ্ন।

সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মেয়েরা ছেলেদের চাইতেও এগিয়ে অনেক বিষয়ে। আমাদের আজ যোগ্যতার মাপকাঠিতে, পরিচয়ের মাপকাঠিতে বৈষম্যমূলক শব্দগুলোকে সমার্থক করে ভাবতে শিখতে হবে। এখন সমানাধিকারের যুগ। আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের একুশ, আমাদের ভাষার অধিকার ও আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি।

একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতি। মানুষের মুখের ভাষার অধিকারই শুধু নয়, সমগ্র জাতির অধিকার ও অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে এই একুশের চেতনাকে ঘিরে। মায়ের মুখের ভাষার এই দাবি পৃথিবীর সব মানুষের জন্মগত অধিকার। এটা নিছক কোনো পাওনা কিংবা বাড়তি চাওয়া নয়- এটা হচ্ছে স্বাধীনভাবে মন খুলে কথা বলার অধিকার, মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলার অধিকার। এই ভাষার দাবিকে অগ্রাহ্য করার দৃষ্টতা দেখানো কারোর পক্ষেই সম্ভব হয়নি, আগামীর পৃথিবীর জন্যও সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এর কারণ পণ্যদ্রব্যের মতো মানুষের স্বকীয়তা বিক্রি হয়ে যাওয়ার অশুভ কাল বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে।

বাঙালি জাতি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের কবল থেকে স্বাধীনতা পেয়েও দেশীয় শোষকের কবলে যেন নতুন করে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এটাও আরেক ধরনের শোষণ। সচেতন মানুষের তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। প্রকৃত অর্থে নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই অংশের মাঝে বড় ফারাক ছিল স্ব স্ব অঞ্চলের সংস্কৃতি ও আচার। এ থেকেই সূচিত হয় রুচিভেদের, চিন্তার ভিন্নতার। এই সবকিছু নিয়েই আমরা এক রাষ্ট্রের নাগরিক ছিলাম প্রায় দুই যুগ- মনোজগতের ভিন্নতা সত্ত্বেও। এখন আমরা স্বাধীন। আমাদের আছে, ভাষা, আমাদের আছে ‘একুশ’, আছে বইমেলা।

এখন চলছে একুশের বইমেলা, পুরো একুশের মাস জুড়ে। আমরা লেখকরাও আজ অনেকটা সিজনাল লেখক হয়ে গেছি। এ কথা সর্বাংশে না হলেও অনেকাংশে সত্যি। সারা বছর আমরা লিখি বটে, কিন্তু অপেক্ষা করে থাকি একুশের বইমেলার সময়ে প্রকাশের জন্য। এও যেন আজ বাঙালি সংস্কৃতির অংশ, বাঙালি জীবনধারার অংশ হয়ে গেছে।

শুধুই কি লেখক- বাঙালি পাঠকও হয়ে পড়েছে একুশনির্ভর! একুশের বইমেলা লেখক-পাঠকের এক মহামিলনমেলা। এই মেলাকে ঘিরে জমে ওঠে নবীন-প্রবীণ লেখকের আসর অর্থাৎ লেখক আড্ডা। তরুণ লেখক-কবিদের মৌসুম এই একুশ, একুশের বইমেলা।

শুধু তরুণরা নয়, পাশাপাশি প্রবীণরাও পসরা সাজিয়ে বসেছেন নিজেদের সম্পাদিত-প্রকাশিত লিট্ন-ম্যাগাজিন নিয়ে। ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি চিত্র- লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশের তাগিদে তারুণ্যের মুদ্রিত-প্রকাশ। প্রকৃতভাবে চর্চা করলে অনেকের মেধার ফসল সমাজকে জাতিকে দেশকে অনেক কিছু দিতে পারা সম্ভব। যে কোনো ধরনের মেধা চর্চার ক্ষেত্রে চায়- প্রকাশের আনন্দ।

আমরা যারা সাহিত্য চর্চা করি, তাদের ক্ষেত্রে লিট্ল ম্যাগাজিন একটি প্রায় জরুরি প্রকাশ-মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। নিজের রচনা ভালো হোক আর মন্দই হোক- এই যে একটি রচনা তৈরি হলো, তার মুগ্ধতাবোধ এর রচয়িতাকে তা প্রকাশে উৎসাহিত করে তোলে। এই বিবেচনায় শক্তিশালী কিংবা কম শক্তিশালী যে কোনো ধরনের তরুণ লেখক আত্মপ্রকাশের অনুভব থেকে প্রকাশ করেন ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ এই তরুণদের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে বর্ধমান হাউসের পেছনে- ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ চত্বর নামে আলাদা স্থান। এটা অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক উদ্যোগ বাংলা একাডেমির। এই চত্বরটির জন্য এই স্থানটিই যথাযথ।

এই ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ প্রকাশ বা প্রচারের ভিন্ন তাগিদও রয়েছে তরুণদের। সেই তাগিদবোধই ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’-এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য বলে সর্বজন বিবেচিত। এই বৈশিষ্ট্য হলো= বিশেষ মতাদর্শে দীক্ষিত চিন্তার কিংবা আত্মসমর্থিত মতামত প্রকাশের ও তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার তাগিদবোধ। এই তাগিদ প্রথাগত নয়- পুকুর বা দীঘির মতো আবদ্ধ জলাশয় নয়, তা নদীর মতো চলিষ্ণু। ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ কথাটি চালু হয়েছে তার প্রকাশগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই।

প্রথম মহাযুদ্ধ-পরিস্থিতির কালে ১৯১২ সালে শিকাগোর ‘লিট্ল থিয়েটার’ আন্দোলনের ধারণা থেকে ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’-এর ব্যবহার শুরু হয় বলে অনেকের ধারণা। প্রথম মহাযুদ্ধেরকালে ১৯১৪ সালে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কবি এজরা পাউন্ডের সহায়তায় মার্গারেট এন্ডারসন-এর সম্পাদনায় যুক্তরাষ্ট্রে ‘লিট্ল রিভিউ’ বলে একটা সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এভাবে এসেছে ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’-এর ধারণা।

‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ বলতে আমরা তরুণ কবি যশপ্রার্থী কিংবা তরুণদের সাহিত্য উদ্যোগকে বুঝে থাকি। ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’-এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘ছোট কাগজ’ও অনেকে বলে থাকেন। ‘ছোট কাগজ’ হচ্ছে- আকারে ছোট, পরীক্ষা-নিরীক্ষাপ্রবণ, নতুন ভাবনার প্রকাশ, সংস্কার মুক্তির চেষ্টা ইত্যাদি বুঝি।

প্রাতিষ্ঠানিক কাগজে সবার প্রবেশাধিকার থাকে না। প্রতিষ্ঠানের আদর্শের সঙ্গে অমিল হলে যেমন তাতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায় না, তেমনি মানসম্মত বা রুচিসম্মত লেখা না হলেও বড় কাগজে প্রবেশাধিকার মেলে না। তার জন্য চায় ‘ছোটকাগজ’ বা ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’- নিজস্ব বক্তব্য ও লেখা প্রকাশের মাধ্যম। লেখক বা কবি তো শুরুতেই বড় লেখক হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। কৈশোর তারুণ্যের দিন পার করে পরিণত পর্যায়ে আসতে সময় লাগে। কিন্তু লেখকের তো চায়- আত্মপ্রকাশ। এই বাসনাকে অবদমনের সাধ্য কার! তাই একজন লেখকের জীবনে ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’-এর ভূমিকাকে ছোট্ট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সেই সঙ্গে একথাও সত্যি যে, বিশেষ ক্ষেত্রে দু’একজন শক্তিশালী তরুণ বীরদর্পে সাহিত্যে প্রবেশ করতেই পারেন। বড় কাগজে, বলছি- প্রাতিষ্ঠানিক ম্যাগাজিন বা দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় স্থান করে নিতে পারেন। এই দু’একজনকে দিয়ে তো আর সামগ্রিক সাহিত্য ক্ষেত্রের সুবিবেচনা করা যায় না! নতুনত্বের দাবি নিয়ে আমাদের সাহিত্যে ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’-এর সূচনা হয় রবীন্দ্র যুগে। প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ ১৯১৪ সালে প্রথম লিট্ল ম্যাগাজিনের চরিত্র নিয়ে প্রকাশিত হয়। গতানুগতিক ধারার বিপরীতে নতুন চিন্তা চেতনার ধারক হিসেবে ‘সবুজপত্র’-এর ভূমিকা সাহিত্যের ইতিহাসে নিশান উড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর পরে ‘কল্লোল’ প্রকাশ পায় ১৯২৩ সালে।

বাংলাদেশের ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ প্রসঙ্গে কবি কায়সুল হকের বক্তব্য স্মর্তব্য- ‘আমাদের এখানে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকেই শুরু হয় লিট্ল ম্যাগাজিনের অভিযাত্রা। আমাদের লেখকদের রুচিশীল পত্রিকার অভাবে প্রধান আশ্রয়স্থল তথা পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়ায় দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য- ক্রোড়পত্র। কিন্তু এখানেও বিপত্তি ঘটে, একে তো স্বল্প পরিসর বড় পত্রিকার যে চারিত্র তার কোনো হেরফের নেই এখানে- লেখকের স্বাধীনতা খর্ব করা এদের প্রধান ব্রত।’

এই ভূখণ্ডে ১৯৪৭-সাল পরবর্তী সময়ে সাহিত্যসেবীদের স্বকীয় চিন্তা প্রকাশের প্রণোদনা জুগিয়েছে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য-সাময়িকীর সঙ্গে মতাদর্শ বা রুচির ভিন্নতা। এভাবেই ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ প্রকাশে এগিয়ে আসেন উৎসাহী সাহিত্যকর্মীরা। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে চট্টগ্রাম থেকে ১৯৪৮ সালে মাহবুব-উল আলম চৌধুরী ও সুচরিত চৌধুরী সম্পাদিত ‘মুক্তি’ লিট্ল ম্যাগাজিন প্রকাশের পথিকৃৎ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।

সেই সময় ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ হয়ে ওঠে নতুন লেখকদের সাহিত্য প্রকাশের আশ্রয় স্থল। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত সদ্য স্বাধীনতা-উত্তরকালে তারুণ্যের উদ্যম নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে সাহিত্য ক্ষেত্রকে। তখন থেকে বেশ কিছু সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ বা ছোট সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে বাংলাদেশে। লিট্ল ম্যাগাজিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে এগুলোকে পৃথক করে দেখা যাবে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর প্রকাশনার স্থায়িত্ব নেই। দীর্ঘস্থায়ী পত্রিকা সব সময়ই হাতেগোনা। এই আলোচনায় বিভিন্ন সমেয় প্রকাশিত লিট্ল ম্যাগাজিনের তালিকা থেকে বোঝা যাবে বাংলাদেশের সাহিত্যে এর ভূমিকা শুরু থেকেই উল্লেখযোগ্য ছিল, এখনো রয়েছে।

এক সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘কবিকণ্ঠ’, ‘কণ্ঠস্বর’, ‘কিছুধ্বনি’, স্বদেশ, গণসাহিত্য, সময়, অতলান্তিক, যাত্রিক, স্পন্দন, ‘মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’, লোকায়ত, যুবরাজ, ঈষিকা; চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘সীমান্ত’, অচিরা; রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ; কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত ‘অলক্ত’ আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সত্তর, আশি, নব্বইয়ের দশক ও তৎপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে থেকে বহু ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ প্রকাশিত হয়।

এর মধ্যে অধিকাংশের প্রকাশ এখনও অব্যাহত আছে। কোনো কোনোটা সাহিত্য-সংস্কৃতি এমনকি সমাজ-রাজনীতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ সব ম্যাগাজিনের সূচি পর্যালোচনা করলে পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে রাজনীতি, সমাজ দর্শন, সাহিত্য-সংস্কৃতির সব শাখা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এতে। প্রবন্ধ, কবিতা, ছোটগল্প তো আছেই। আরো আছে সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, নাট্যকলা, স্মৃতিকথা, আন্তর্জাতিক দর্শন, শিক্ষা রাজনীতি, অনুবাদ ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়। কোনো কোনোটা ঋতুভিত্তিক সংখ্যা এবং কোনোটা একক বিষয়ভিত্তিক বিশেষ সংখ্যা হিসেবে ও প্রকাশিত হচ্ছে।

বর্তমান সময়েও বহু ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ এর প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে। বাংলা একাডেমির বইমেলায় এবারও ১৭৬টি ‘লিট্ল ম্যাগাজিন বা ছোটকাগজ’-এর স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

বর্তমানে প্রকাশিত কিছু ‘ছোটকাগজ’-এর নাম তুলে ধরা হলো: জলধি, কাঠপেন্সিল, খেয়া, প্রকাশ, চারবাক, প্রান্ত, নৃ, দেশলাই, খড়িমাটি, প্রতিবুদ্ধিজীবী, একবিংশ, দাঁড়কাক, অনুভূতি, কবিতাপত্র, লোক, শালুক, কর্ষণ, কবিতাবাংলা, খনন, টাঙ্গন, অনুরণন, কবিতাঅলা, কালের ধ্বনি, মানুষ, সাম্প্রতিক, কবি, শিড়দাঁড়া এবং মানুষ, রোদ্দুর, কোরাস, শব্দগুচ্ছ, ভিন্নচোখ, দাগ, অনুপ্রাণন, কথা, প্রান্তস্বর, নতুন দিগন্ত, ম্যাজিক লণ্ঠন, চিরকুট, স্বপ্নকুঁড়ি, ল্যাম্পপোস্ট, গল্পকথা, ম, শাব্দিক, সরলরেখা, শব্দ, কবিতার রাজপথ, কাব্যকথা, বাংলার কবিতাপত্র, প্রতিধ্বনি, জলতরঙ্গ, তৃতীয় চোখ, অনুঘটক, মনন, সপ্তবর্ণ, জলছবি, অবিনশ্বর, কালধারা, নান্দীপাঠ, চন্দ্রবিন্দু, ধ্রুপদী, অমিত্রাক্ষর, চিহ্ন, মেঘ, পান্থজনের সখা, পর্ব, কার্পাস, চর্যাপদ, লাটাই, পুনশ্চ, কাশবন, আলোকধারা, উত্তরায়ন, সারস, কাদাখোঁচা, কাদাখোঁচা, রৌদ্রছায়া, উলুখাগড়া, শিল্প ও সাহিত্য, হরিৎপত্র, পাণ্ডুলিপি, শব্দ কাহন, সম্পীতি, খেয়া, ছিন্নপত্র, দোয়েল, সময়চিহ্ন, স্বাক্ষর, বৃত্তায়ন, কালপত্র, আবহমান, লিরিক, বৈঠা ইত্যাদি।

তবে এর বাইরেও অনেক ‘ছোটকাগজ’ ঢাকা থেকে ও ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। এ থেকেও বাংলাদেশের ‘লিট্ল ম্যাগাজিন’ ও আমাদের সাহিত্যের বর্তমান হাল জানা সম্ভব। লিটল ম্যাগাজিন আমাদের সাহিত্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন চিন্তার বাহক হিসেবে লিট্ল ম্যাগাজিনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমাদের একুশ, আমাদের বইমেলা- আমাদের গর্বিত অহঙ্কারের নাম।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App