×

বিশেষ সংখ্যা

একজন পাঠকের দৃষ্টিতে গণমাধ্যমের একাল-সেকাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৫:১৮ পিএম

একজন পাঠকের দৃষ্টিতে গণমাধ্যমের একাল-সেকাল
বিজ্ঞজনরা হয়তো ভাবতে পারেন আমার বয়সই বা কত যে গণমাধ্যমের কাল নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। ভাবনাটা অস্বাভাবিক না হলেও কিছুটা সঙ্কুচিত বটেই কারণ দেখতে দেখতে আমারও বয়স কম হলো না। অবশ্য এখানে আমি গণমাধ্যমের মূল্যায়ন করতে যাচ্ছি না সে যোগ্যতা আমার হয়নি বা হলেও দেখাতে যাচ্ছি না। শ্রেফ একজন পাঠক হিসেবে পড়তে শিখার দিনগুলো থেকে এ পর্যন্ত যা দেখেছি বা দেখছি তার ভিত্তিতেই আমার কিছু চাওয়া, প্রত্যাশা বা হতাশার কথা বলতে চাই। মূলত আমি পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম। জন্মের পর থেকে জেনেছি এই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল এক ভীষন আকাক্সক্ষা নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের প্রত্যাশাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও তাদের এদেশি রাজাকার আলবদর বন্ধুদের বিরুদ্ধে বিনা অস্ত্রে লড়াই করে ‘বাংলাদেশ’ নামক দেশটির জন্মের কারণ। বুঝ হবার পর থেকে দেশের ইতিহাস যা জেনেছি তার বেশিরভাগটাই পারিবারিক উৎস থেকে। পারিবারিক রাজনৈতিক ইতিহাস থাকার কারণে ছোটবেলা থেকেই ছিলাম রাজনৈতিকভাবে সচেতন অর্থাৎ, দেশ ও রাজনীতির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে শিখেছি। এর বাইরে শিক্ষক হিসেবে যারা ভ‚মিকা রেখেছে এর অন্যতম একটি সোর্স ছিল সংবাদ মাধ্যম। ছোটবেলায় গণমাধ্যম বলতে বুঝতাম দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকা আর ভিজুয়াল মাধ্যম বলতে কেবল বাংলাদেশ টেলিভিশন যা সরকারি সংবাদ মাধ্যম হিসেবেই পরিচিত ছিল। বাসায় দৈনিক পত্রিকা রাখা হতো সব সময়। আমার মা ছিলেন আমাদের প্রধান শিক্ষক। মা’কে দেখেই শিখেছি প্রতিদিন পত্রিকা পড়তে হয়। পত্রিকা পড়েই জেনেছি দেশের কোথায় কী হচ্ছে। আর সব ঘটনাই জানা মানেই এর কার্যকারণ বা ফলাফল নিয়ে নিজের মধ্যে আলোচনা, নানা এঙ্গেলে দেখতে শিখার চোখ জন্মেছে সেই সময় থেকেই। বিভিন্ন বিখ্যাত ও সুলেখকদের লেখা ছাপা হতো। তাঁরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে বিশ্লেষণমূলক লেখা লিখতেন। মারাত্মক এক আকর্ষণ কাজ করতো অনেকের লেখা পড়ার জন্য। পড়া মানেই শিখা। পত্রিকার সংবাদ মানেই সে ঘটনার এক বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও ফলো-আপ। একটি ঘটনার ঘটে যাওয়া বিষয় নয় কেবল এর পিছনের ও সামনের অনেক বিষয় সম্পর্কেও পাঠকদের মনের তৃষ্ণা মিটানোর চেষ্টা থাকতো। দিন পাল্টেছে। এখন একটি চ্যানেলের জায়গায় এসেছে ৩৭/৩৮টি চ্যানেল। হাতে গোনা সংবাদপত্রের জায়গায় ছাপানো হয় অনেক। কেবল ছাপার কাগজেই নয়, এসেছে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমও। কেবল এখানেই আটকে নেই গণমাধ্যমের বিস্তৃতি। যুক্ত হয়েছে সামাজিক গণমাধ্যম নামের নতুন একটি ধারাও। কিন্তু ফলাফল কী হয়েছে? একজন পাঠক হিসেবে আমার মনের তৃষ্ণা কিন্তু কমেনি বরং বেড়েছে অনেক। এখন এত নানামুখী মাধ্যমের সুযোগে পাঠকের সংখ্যা যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনি ঘটনার ঘনঘটাও হচ্ছে ঘন ঘন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য হচ্ছে যে, সংখ্যাগত দিক দিয়ে বাড়লেও কমেছে গুণগত মানের জায়গাটি। আর গুণগত মানের শূন্যতা পাঠকের তৃষিত হৃদয়কে বঞ্চিত করে যাচ্ছে। ঠিক তেমনি আমাদের বিস্তৃত পরিসরের গণমাধ্যমও পাঠক তৈরিতে ক্রমশ ব্যর্থ হচ্ছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মিডিয়ার পরিবর্তন সময়ের দাবি। হয়তো কাগজের জায়গা দখল করেছে অনলাইন বা ভার্চুয়াল মাধ্যম কিন্তু কনটেন্টের জায়গাটির কী অবস্থা? মানের জায়গাটি কোথায় আছি আমরা? গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজ বা রাষ্ট্রের তৃতীয় নয়ন। দুটি নয়ন যখন সঠিক দায়িত্বটি পালনে ব্যর্থ হয় তখন তৃতীয় নয়নের সাহায্য নিতে হয় সমাজকে। সমাজের মানুষ তখন আশায় থাকে কখন সেই নয়নটি ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিকে পরিষ্কার করে দিবে। দায়িত্বের জায়গাটি যেন এখন অনেকটাই দায়সারা গোছের হয়ে গেছে। হয়তো অনেকেই বলবেন এর পেছনের কারণ না বলে কেবল ফলাফলকে নিয়ে আলোচনা করলে সেটা কতটা সঠিক কিন্তু পুরো বিষয়টা ভাইস ভার্সা। আমাদের গণমাধ্যম এখন অনেকটাই ফলোয়ারের ভ‚মিকা পালন করে থাকে। বেশিরভাগ মাধ্যমই হয়ে গেছে কেবল সংবাদ কুড়ানোর চ্যানেল। যে মাধ্যমটি ছিলো পাঠক তৈরির শিক্ষক সে মাধ্যমটি হয়ে পড়েছে মারাত্মকভাবে বিতর্কিত। এই বিতর্ক আগে ছিল না তা নয় তবে তখন পক্ষপাতমূলক সংবাদ আর কোনটা বস্তুনিষ্ঠ সেই পার্থক্য করা যেত অনায়াসেই আর এখানেই ছিল পাঠকের তৃপ্তির জায়গা। এখন সে জায়গাটিতে এসেছে নানা ট্যাগের আলোচনা। সংবাদপত্রের নাম শুনলেই পাঠকের মনে আগেই ধারণা চলে আসে কোন ধরনের সংবাদ ছাপানো হয় সেখানে। কে কার পক্ষ নিয়ে কাজ করছে সে আলোচনার পাশাপাশি আছে সোর্সের বস্তুনিষ্ঠতার বিতর্ক। আছে সঠিক বেঠিক বিশ্লেষণের পার্থক্য। জ্ঞানের আরেকটি মাধ্যম ছিলো আমাদের গণমাধ্যম যেখানে কথা বলা হবে ‘গণ’ অর্থাৎ, সাধারণ মানুষের হয়ে। তর্কে বিতর্কে উঠে আসবে সমাজের চলমান অসঙ্গগতির চিত্র যেখান থেকে শিখতে চাইবে আমাদের নীতিনির্ধারকরাও। পাঠকের মন বুঝা যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ঠিক তেমনি পাঠকের মনকে চালিত করাও অন্যতম দায়িত্ব। আমাদের সমাজে এখন অনেক বেশি অনিশ্চয়তার খেলা চলে। মানুষ যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে সমস্যার বহুমাত্রিকতাও। এসেছে অপরাধের ভিন্নতা। মানুষ এখন আর কোনো কিছুতেই স্থির থাকতে পারে না। প্রতি মুহূর্তে আসছে পরিবর্তন, পরিবর্ধন। এর কোনটা ইতিবাচক আবার বেশিরভাগই নেতিবাচক হয়ে ধরা পড়ে। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা ইস্যুতে চোখ রাখলেই বুঝা যায়। ফেসবুকের মতো মাধ্যম এখন চালিত করে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের মতামতকে। এমনকি আমাদের মূল ধারার গণমাধ্যমও বসে থাকে কোনো বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতটা আলোচিত হচ্ছে। সে অনুযায়ী সংবাদের সংবাদ মূল্য নির্ধারিত হয়। আমি বলছি না সবাই কিন্তু বেশিরভাগই এই কাজটি করছে। তাড়াহুড়ো করে ব্রেকিং দিতে জীবিত মানুষকে মৃত বলে ঘোষণা দেয়ার মতো ভুল সংবাদও আমরা দেখেছি। পরবর্তীতে ক্ষমা চাওয়ার মতো ঘটনাও কম নয়। অথচ হওয়ার কথা ছিল উলটো। ভুল সংবাদকে সঠিকভাবে উপস্থাপনের দায়িত্ব কিন্তু আমাদের স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমেরই। ফেসবুক পরিচালিত এই সংবাদের কালে আমরা বসে থাকি কখন সংবাদটি মূল ধারার মাধ্যমে আসবে কারণ এখনো আমরা পাঠকরা বিশ্বাস করি ফেসবুকের সংবাদ সবার আগে এলেও এর ‘অথেনটিসিটি’ নিয়ে থেকে যায় বিস্তর সন্দেহ। যারা শিক্ষিত ফেসবুক ইউজার তারা কখনই স্রোতের সঙ্গে শামিল হয়ে যায় না। ফেসবুকের গুজব কতটা ক্ষতিকর হতে পারে এর উদাহরণ খুব বেশি দূরে নয় সা¤প্রতিক কোটা ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলন দেখলেই বুঝা যায়। এই সময়টাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে আমাদের গণমাধ্যম। ছাপার কাগজ দেরিতে এলেও টিভি চ্যানেলগুলো লাইভ থাকে সব সময়। মিনিটে মিনিটে আপডেট দিচ্ছে তারা। কেবল দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমাদের নিউজ মিডিয়ার শক্তিশালী ও বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা কাম্য। দেশের নানা ইস্যুতেই মাঝে মাঝে গরম হয়ে উঠে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। সেখানেও থেকে যায় বস্তুনিষ্ঠতার প্রশ্ন কারণ সেসব মাধ্যমের সংবাদ সংগ্রহের উৎস কী তাও একটা বড় প্রশ্ন। এমন অনেক বিষয়কেই দেখেছি কেউ কেউ ব্যক্তিস্বার্থে আমাদের রাষ্ট্রের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পিছ পা হয়নি। একটা সময়ে সংবাদ মাধ্যমে যারা কাজ করতেন তাদের দেখা হতো একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে কারণ তারা হচ্ছেন সমাজের আয়না যে আয়নায় সমাজ ও রাষ্ট্র নিজেদের দেখতে পান। যে আয়না যত স্বচ্ছ হয় চেহারার প্রতিটি বাঁক তত স্পষ্ট হয়ে সামনে আসে। আজকাল সে জায়গাটিতেও এসেছে অস্বচ্ছতা। দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার জায়গাটি যেন হারিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। গদবাঁধা সংবাদে ভরপুর মিডিয়া। একই ছকে আলোচনা চলে দিনের পর দিন। নেই কোনো ভিন্নতা বা নতুনত্বের ছোঁয়া।। গবেষণার জায়গাটি মনে হয় না এখন কেউ ভাবেন। এত বড় ক্ষেত্রটিকে আরো কতটা শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, কেমন করে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে নতুন চিন্তার দ্বার উন্মুক্ত করা যায় সে জায়গাটিতে খুব একটা কাজ দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগগুলো থেকে যারা পাস করে বেরুচ্ছেন তারাই বা নতুন কী নিয়ে বাজারে আসছেন সেটাও একটা ভেবে দেখার মতো বিষয়। আমি হয়তো সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত কেউ নই তবে একজন সচেতন ও শিক্ষিত পাঠক হিসেবে আমি চাই আমাদের সমাজের এই তৃতীয় নয়নটি যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে নতুন করে সাজিয়ে তুলে। ল্যান্সের নিত্যনতুন আবিষ্কার চাই তবে সেটা যেন কেবল ফ্যাশনেবল বা রঙ পরিবর্তনেই সীমাবদ্ধ না থেকে প্রকৃত অর্থেই দেখার পরিধি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App