×

বিশেষ সংখ্যা

আনন্দধারা বহিছে ভুবনে...

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:১৫ পিএম

আনন্দধারা বহিছে ভুবনে...

দীর্ঘ চার দশককালের অধিক সময় ধরে যে কবিতা লিখছি তা কিন্তু সব সময় অন্যের সন্তুষ্টি মাথায় নিয়ে লিখছি না। কারো ভালো লাগলেও লিখছি, কারো ভালো না লাগলেও লিখছি। কাগজে যখন লেখা পাঠাই, সব লেখাই ছাপা হয় না। অনেক সম্পাদক চেয়ে নিয়েও লেখা ছাপেন না অথবা ছাপতে পারেন না, তাতে কি কবির লেখা বন্ধ করে দিলে চলে? যাদের লেখা ছাপা হচ্ছে তারাই কি উত্তীর্ণ কবিতাটি লিখছেন? তা নয়- কবিতা ছাপা হচ্ছে নানান মাপকাঠি বিবেচনা করে। সম্পাদক কবিতা বোঝেন মানছি, কিন্তু আমরা কবিতা কিছুই বুঝি না, সে কথা একেবারেই মানছি না। প্রসঙ্গক্রমে একটা বিষয়ের অবতারণা করতে চাই, আমার মতো যারা মফস্বলে জীবন-যাপন করেন তারা কেবল নিজের দশকেই নন, যাপিত-জীবনের শেষ দশকে এসেও কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন না। সে বিবেচনায় ব্রাত্যজীবনে যারা সত্তরের দশকে কাব্যচর্চা শুরু করেছেন এবং মফস্বলেই অবস্থান করেছেন, তারা কেবল নিজের দশকেই নন, শতাব্দী পেরিয়ে নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকের কবিও হয়ে ওঠেননি অনেকেই, বিশেষ করে স্বনামখ্যাত গবেষকদের কাছে।

রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নয়, এ আলোচনা কবিতার, এ আলোচনা নাটকের, শিল্পের এবং এ আলোচনা সংগ্রামের; যে সংগ্রামের সাথে আমাদের শিল্পী-কবি-সংবাদকর্মী-সংস্কৃতিকর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন, কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়াও।

চারটি প্রশ্ন সংবলিত একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেলেন একটি ছোট কাগজের মেধাবী সম্পাদক, তরুণ কবির চোখে-মুখে পরিতৃপ্তি। সম্পাদক যখন প্রশ্ন চারটি রেখে যান তখন আমি সদ্য হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছি। যে কারণে চার প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সম্পাদক আমাকে খুব একটা তাগাদা করেননি।

তবে এ কথা বলেছিলেন সংখ্যাটি একুশের বইমেলার আগে প্রকাশ করতে চান। তিনি আমাকে শক্ত তাগাদা না করলেও সম্প্রতি তিনি আমার মোবাইলে ই-মেইল এড্রেস দিয়ে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন। প্রত্যক্ষ তাগিদ না হলেও পরোক্ষ তাগিদ বুঝলাম, সম্পাদকের তাগিদ দেয়ার কৌশলটা আমার ভালোই লাগল।

এবার আমি নিজের তাগাদাতেই তার দেয়া প্রশ্নপত্রটি খুঁজে বের করে উত্তর লিখতে বসলাম। প্রশ্ন চারটি পড়ে আমার মনে হলো, চারটি প্রশ্নের আলাদা আলাদা উত্তর না লিখে চার প্রশ্নের আলোকে একটা ছোট্ট গদ্য লিখে দেয়াই যৌক্তিক হবে। আমার চিন্তার সাথে ছোট কাগজের সম্পাদক অথবা আমার পাঠক একমত হবেন কী-না জানি না।

প্রথমত, যদি সম্পাদক আমার উত্তর পদ্ধতি অনুমোদন না করেন তাহলে পাঠকের বিবেচনার সুযোগই থাকে না; আর যদি আমার উত্তরপত্র সম্পাদকের দপ্তর পার হয়ে যায় তখন পাঠকের বিবেচনার কথা ভাবতে হবে বৈকি। সব ভাবনা মাথায় রেখেই বর্তমান এই উত্তরপত্রের নাজুক উপস্থাপনা।

উত্তর উপস্থাপনের আগে প্রশ্ন চারটি উপস্থাপন করা যাক। ক) মৌলিক কবিতা বলতে আপনি কি বুঝেন? অথবা কবিতার মৌলিকত্ব কি? খ) মৌলিক কবিতা কেন মৌলিক? গ) কবিতা কীভাবে মৌলিক হতে পারে? এবং ঘ) কবিতার কেন জন্ম হয় বলে আপনি মনে করেন?

প্রশ্নকর্তার প্রশ্নে কোন বিচ্যুতি আছে কী-না সে প্রসঙ্গে যাবো না, তবে প্রশ্ন চারটি যেভাবে আমি পেয়েছি সেভাবেই উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। যদি আমাকে আটকে দেয়ার অভিসন্ধি থেকে প্রশ্ন করা হয়ে থাকে তবে বলব, সম্পাদক যথার্থ কাজটিই করেছেন। কবিতা সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান সঞ্চয় না করেও আমি যে চার দশককালের অধিক সময় ধরে নিজেকে কবিতার সাথে সম্পৃক্ত রেখেছি তার জন্য সামান্য হলেও তো আমার দণ্ড হওয়া উচিত; কিন্তু হচ্ছে না। কবিতার অঙ্গন থেকে কেউ আমাকে বহিষ্কারও করছে না।

এ কেবল আমি একা নই, আমার মতো অসংখ্য। নিজে নিজে যে অধীত অঞ্চল ছেড়ে যাবো, সে ইচ্ছেরও জন্ম হয় না। কোনো বেকায়দা ধাক্কায় যদি বিদায় হই তা-ই বা মন্দ কী? প্রশ্নোত্তর দিয়ে পরীক্ষায় অসাধারণ ফলাফল করার ছাত্র আমি নই, একথা যেমন সত্য, উত্তরপত্রে কম নম্বর দিয়ে আমাকে ফেল করিয়ে দেয়া সহজ হবে তেমনটিও মনে করি না। আরো একটা কথা পরীক্ষকদের বিবেচনার জন্য শুরুতেই বলে নিতে চাই, উত্তরপত্রে প্রশ্নের ক্রম ধরে উত্তর না খোঁজাই সঙ্গত হবে। কেন না আমি চারটি প্রশ্নকে একটি ধরে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব। কার কাছে কত নম্বর পাবো জানি না; আমার কাছে বড় বিষয় হবে নিজের দেয়া উত্তরপত্রে আমি নিজে সন্তুষ্ট হতে পারব কী-না। আমি নিজে যদি সন্তুষ্ট হয়ে যাই, তাহলে অন্যের দেয়া নম্বরের খুব একটা পরোয়া করি না।

দীর্ঘ চার দশককালেরর অধিক সময় ধরে যে কবিতা লিখছি তা কিন্তু সব সময় অন্যের সন্তুষ্টি মাথায় নিয়ে লিখছি না। কারো ভালো লাগলেও লিখছি, কারো ভালো না লাগলেও লিখছি। কাগজে যখন লেখা পাঠাই, সব লেখাই ছাপা হয় না। অনেক সম্পাদক চেয়ে নিয়েও লেখা ছাপেন না অথবা ছাপতে পারেন না, তাতে কি কবির লেখা বন্ধ করে দিলে চলে? যাদের লেখা ছাপা হচ্ছে তারাই কি উত্তীর্ণ কবিতাটি লিখছেন? তা নয়- কবিতা ছাপা হচ্ছে নানান মাপকাঠি বিবেচনা করে। সম্পাদক কবিতা বোঝেন মানছি, কিন্তু আমরা কবিতা কিছুই বুঝি না, সে কথা একেবারেই মানছি না।

প্রসঙ্গক্রমে একটা বিষয়ের অবতারণা করতে চাই, আমার মতো যারা মফঃস্বলে জীবন-যাপন করেন তারা কেবল নিজের দশকেই নন, যাপিত-জীবনের শেষ দশকে এসেও কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন না। সে বিবেচনায় ব্রাত্যজীবনে যারা সত্তরের দশকে কাব্যচর্চা শুরু করেছেন এবং মফস্বলেই অবস্থান করেছেন, তারা কেবল নিজের দশকেই নন, শতাব্দী পেরিয়ে নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকের কবিও হয়ে ওঠেননি অনেকেই, বিশেষ করে স্বনামখ্যাত গবেষকদের কাছে। তাঁরা ভুলে যান পৃথিবী অনেকটাই এগিয়েছে; ডিজিটাল-বিশ্বে ‘মফস্বল স্ট্যাম্প’ দিয়ে বাদ দেয়ার দিন ফুরিয়েছে। দায়িত্বশীলদের এ বোধোদয় হলে অনেক বিতর্কই কমে যেতে পারে। কবি তো নিজের মনের আনন্দেই লিখে যান।

এভাবেই পৃথিবীতে কবিরা নিজের মনের আনন্দে কবিতা লিখে যাচ্ছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। কাব্যচর্চা কখনো থেমে থাকেনি। সুন্দরের সপক্ষে, প্রেমের সপক্ষে, মুক্তির সপক্ষে, বঞ্চিত-নিপীড়িত-শোষিতের সপক্ষে কবিতা লেখা হবে- হতেই থাকবে। কবিতার এই চলমান প্রক্রিয়াকে রুখবে সাধ্য কার?

যদি কবিতাই না থাকে তবে তার মৌলিক আর যৌগিক কী? তাই প্রথমেই কবিতার জন্মরহস্য। তার আগে প্রশ্ন কবিতা কী? না, আমি এখানে কোনো তত্ত্ব আলোচনায় যাবো না। কবিতা কী- এ কথা ইতোমধ্যে অনেকেই সংজ্ঞা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন; কিন্তু ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে যখন বলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম! এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!’ তখন সারা বাংলা নড়ে ওঠে- গর্জে ওঠে গোটা বাংলা। ঘরে ঘরে বাঙালি প্রস্তুত হয়ে যায় যুদ্ধের জন্য। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় নেমে যায় রাস্তায়। কারো হাতে বর্শা, কারো হাতে দা-বল্লম-বন্দুক-বংশদণ্ড ইত্যাদি। সামনে কী হবে কেউ জানে না, বাঙালি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যুদ্ধের মহড়া শুরু করে দিল, এমনকি কিশোররাও মাঠে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা শুরু করলো। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের জন্য অনেকেই বলেন- ‘বঙ্গবন্ধু রাজনীতির কবি’। অর্থ দাঁড়ায়, সাধারণ অর্থে আমরা যাকে কবিতা বলে জানি, তার বাইরেও কবিতা আছে।

বলতে পারি, প্রগতির পথে, কল্যাণের পথে, শান্তি ও স্থিতির পথে, সুন্দরের পথে, জাগরণের পথে, সত্য ও প্রেমের পথে যা কিছু সাহসী ও দৃপ্ত উচ্চারণ তাও কবিতা হতে পারে। কবিতার জন্ম হয় আনন্দে- কবিতার জন্ম হয় বেদনায়- কবিতার জন্ম হয় কষ্টে- কবিতার জন্ম হয় প্রাপ্তিতে- কবিতার জন্ম হয় মুক্তিতে- কবিতার জন্ম হয় বিচ্ছেদে- কবিতার জন্ম হয় সংকটে- কবিতার জন্ম হয় সম্ভাবনায়- কবিতার জন্ম হয় অভিমানে- কবিতার জন্ম হয় বিজয়ে- কবিতার জন্ম হয় সব হারিয়েও। স্বপ্নের সন্ধানে কবিতার জন্ম- স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে কবিতার জন্ম- স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে কবিতার জন্ম- স্বপ্ন প্রার্থনায়ও জন্ম হয় কবিতার। কবিতা জন্মের এই যে উৎসগুলো, সবই কিন্তু মৌলিক। কবিতায় ছলনা-প্রতারণা-প্রবঞ্চনার অবকাশ নেই। ‘জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্যশব্দ কবিতা’ (আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতার পঙ্ক্তি)। পিতল দিয়ে কি সোনার অলঙ্কার তৈরি করা যায়?

অন্যদিকে স্বর্ণালঙ্কার তৈরিতে সোনার সাথে হয়তো সামান্য খাদ মেশাবারও প্রয়োজন পড়ে; অলঙ্কারে খাদ মেশাবার রীতি তো সবার কাছেই অনুমোদিত; কিন্তু কবিতার শিল্পালঙ্কার তৈরিতে কবির আবেগ-অনুভূতি-প্রেম-প্রজ্ঞা-মনন-মনীষা-মনোযোগ যাই লাগুক তার কোনোটিই খাদ নয়, কবিতার সবটাই খাঁটি। অজস্র খাঁটির যোগফল খাঁটি হতে বাধ্য, যেমন অজস্র শূন্যের যোগফল ‘শূন্য’ হতে বাধ্য। অজস্র মৌলিকের যোগফল মৌলিক হতে বাধ্য। অন্তত উত্তীর্ণ কবিতা মৌলিক কবিতাই হতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাইলে যে কোনো বিষয় নিয়ে সৃষ্টি করা যায়; যে কোনো বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে পণ্ডিতরা যুক্তি জুড়ে কখনো ‘পক্ষ’কে কখনো ‘বিপক্ষ’কে বিজয়ী করতে পারেন। যুক্তির পাল্লা যেদিকে ঝুলবে তাকেই আমরা বিজয়ী বলে মেনে নেবো, কিন্তু সব যুক্তিবিদদের বিজয়কেই কি আমরা সত্য বলে মেনে নেবো সব সময়? পরীক্ষার দুর্বল ছাত্র হিসেবে ‘মৌলিক’ কবিতার প্রশ্নে উত্তরপত্রে আমি হয়তো ‘লেটার মার্কস’ নাও পেতে পারি, কিন্তু তাই বলে আমার উত্তর মিথ্যা বলে মেনে নিতে পারি না।

বাংলাদেশের কবিতার প্রশ্নে বিদগ্ধ প-িতরা ‘মূলধারার কবি’ বলে যাদের চিহ্নিত করেছেন তাঁরা হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-ত্রিশের আধুনিক কবিরা: জীবনানন্দ দাশ-অমিয় চক্রবর্তী-বুদ্ধদেব বসু-বিষ্ণু দে-সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-প্রেমেন্দ্র মিত্র, পরবর্তী কালের কবি আহসান হাবিব-ফররুখ আহমদ-শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ-সৈয়দ শামসুল হক-নির্মলেন্দু গুণ-রফিক আজাদ-মুহম্মদ নূরুল হুদা-হাবীবুল্লাহ সিরাজী-অসীম সাহা-আবিদ আজাদ প্রমুখের পরম্পরা।

সে পরম্পরায় কিন্তু লালন ফকির-কাজী নজরুল ইসলাম-জসীমউদ্দীন-জালাল উদ্দিন খাঁ-হাছন রাজা-রাধারমন ঘোষ-উকিল মুন্সী-আবদুল করিমরা ব্রাত্য। তাঁদের বিবেচনা করা হয় গৌণ ধারার কবি হিসেবে। কেউ পল্লীকবি- কেউ লোককবি- কেউ বিদ্রোহী কবি- কেউ বাউল সম্রাট ইত্যাদি।

প্রাবন্ধিক-গবেষক অধ্যাপক যতীন সরকার তাঁর একাধিক প্রবন্ধে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে- বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটে বরং গৌণরাই মাটির কবি-বাংলার লোকমানসের কবি-বাংলার মূলধারার কবি; মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দরা শিষ্ট-শিক্ষিত মানুষের কবি। বাংলার সংখ্যা গরিষ্ঠের জীবনাচার-আশা-আকাক্সক্ষা তাঁদের কবিতায় ততটা বাক্সময় নয়, যতটা তথাকথিত লোককবিদের কবিতায় উচ্চারিত। যতীন সরকারের যুক্তির বিরুদ্ধে কাউকে ততটা সোচ্চার হতে দেখিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, বাংলার কবি হিসেবে যিনি নিজেকে একজন পরিপূর্ণ বাঙালি করে নিয়ে বিশ্ব প্রেক্ষিতকেও ধারণ করেন নিজের চেতনায় তিনিই হতে পারেন বাংলার একজন আধুনিক কবি।

আক্ষরিক অর্থেই রবীন্দ্রনাথ যা করে দেখিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশকেও বাংলার কবি হিসেবে- বাঙালির কবি হিসেবে বাদ দেয়ার সুযোগ দেখি না। মাইকেল মধুসূদন দত্তর যখন বোধোদয় হয়, তিনি ‘হে বঙ্গ ভা-ারে তব বিবিধ রতন/ তা সবে অবহেলা করি অবোধ আমি/পর ধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ’ ইত্যাদি বলে আক্ষেপ করেন, অথবা উচ্চারণ করেন- ‘শতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে/শতত তোমারই কথা ভাবি এ বিরলে’ তখন তাঁকে বাঙালির কবি হিসেবে মেনে নিতে কার আপত্তি থাকে? বাঙালিকে বিপ্লবী চেতনায় যিনি প্রথম উজ্জীবিত করেছেন, তিনি মধুসূদন। কবি মধুসূদন যখন প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রচনা করেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, যখন রাবণকে নায়ক করে গড়ে ওঠে কাব্যের কাঠামো তখন আমাদের মনে পড়ে যায় ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়/ দাসত্ব শৃঙ্খল কে পরিবে পায় রে কে পরিবে পায়?’-এই তো বাঙালির চেতনা। ইংরেজি সাহিত্যের কবি হয়ে উঠার পূর্ব-মোহের পাপ মুহূর্তেই খ-ন হয়ে যায়; মধুসূদন হয়ে ওঠেন বাংলার কবি- বাঙালির কবি।

বাংলা নাটকের ইতিহাস বয়ানে আমরা দেখতে পাই, ভিনদেশি লেবেদফের হাত ধরে বাংলা নাটক নতুন এক পথের দিশা খুঁজে পেয়েছে; কিন্তু বাংলা নাটক ভিনদেশিদের প্রভাবে যে ধারায় গা ভাসিয়ে ছিল, তা থেকে সরে এসে বাংলা নাটক লোকবাংলার চিরায়ত নাট্যরীতির পালাগান, কিসসা পালা, যাত্রা, গাইনের গীত, কীর্তন ইত্যাদি থেকে বিকশিত হয়ে আধুনিক নাট্যরীতির সাথে শামিল হতে পারত, যদি বাংলার নাট্যকর্মীরা আবহমান বাংলার লোকধারা থেকে কেউ যদি নাটকের উপস্থাপন শৈলীতে লোকবাংলার আঙ্গিকের ব্যবহার করে দেখাতেন, তাহলে সেখানেও আধুনিক বাংলা নাটক এক স্বতন্ত্র ধারার সন্ধান করে নিতে পারত, আমাদের নাটকের ইতিহাসও ভিন্নতর হতে পারত। বিশ্বকে মোকাবেলা করতে বাঙালি যদি নিজের মাটিতে শেকড় রেখে শিক্ষিত হয়ে ওঠে তাতে দোষের কী? দোষ হয় তখন যখন বাঙালি নিজের শিকড় ছিঁড়ে বৈশ্বিক হতে চায়। দোষ হয় তখন যখন নিজের মাটির সুর ও সংস্কৃতিকে অস্বীকার করতে চায়।

কবিতার একজন সাধারণ মানের শিক্ষানবিস হিসেবে আমি মৌলিক কবিতা বলতে বুঝতে চাই- কবিতার বিষয়-উপস্থাপনশৈলী-বিন্যাস-শব্দ চয়ন সব ক্ষেত্রেই খুঁজে পাওয়া যাবে কবির নিজস্বতা। একজন মৌলিক কবির যেমন থাকবে নিজস্ব কাব্যভাষা-নিজস্ব বয়নরীতি এবং নিজস্ব উপস্থাপনশৈলী, তেমনি কবিতার অরূপরতন অন্বেষণে নিরলস প্রচেষ্টা- ক্রমাগত অনুসন্ধান। স্বাতন্ত্র্যের জন্য কবিদের সংগ্রাম লক্ষযোগ্য। রবীন্দ্র-উত্তর ত্রিশের কবিরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য খুঁজে পেতেই অস্বীকার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে।

তাঁরা বুঝেছিলেন বাঙালির মনন-মনীষা রবীন্দ্রপ্রভাবে এতটাই আচ্ছন্ন যে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়েও তাঁদের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। তাঁদের সেই নিমজ্জমান অবস্থা থেকে নিজেদের উদ্ধার করতে চারপাশের সব আচ্ছন্নতাকে গুঁড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন তাঁরা। তাঁরা মনে করেন রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকারের মাধ্যমেই আসতে পারে তাঁদের মুক্তি। তাঁদের সেই বিদ্রোহ বাংলা কবিতার জন্য কল্যাণকরই হয়েছিল।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁদের বিদ্রোহকে মেনে নিয়ে যুক্ত হয়েছিলেন তাঁর নিজের বিরুদ্ধেই এবং অতিক্রম করে গেলেন নিজেকেই। বাংলা কবিতায় সূচিত হলো নতুন অধ্যায়। তাঁর সহগামী হলেন ত্রিশোত্তর কবিরাও। সে অধ্যায়েও নায়ক হয়ে রইলেন রবীন্দ্রনাথ। একজন মৌলিক কবির জন্য নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়াও জরুরি। নিজেকে অতিক্রম করে যেতে না পারলে কবিকে একই আবর্তে ঘুরে পুনরাবৃত্তির ক্লান্তিতে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়; যা কিছুতেই সৃষ্টিশলতার লক্ষণ হতে পারে না।

কবিতার মৌলিকত্ব ও জন্মরহস্য সন্ধান করতে গিয়ে অনেক কথাই বলা হয়ে গেল, হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরও হয়ে গেছি, কিন্তু যে সব অনুষঙ্গকে স্পর্শ করেছি সবই উত্তীর্ণ কবিতা রচনার জন্য গুরুত্ব বহন করে; কেন না কবিতা যতই কবি নিজের আনন্দে লিখুন, সমাজের সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে কবির যেমন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে, তেমনি নিজের চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাস-উপলব্ধিকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজনকেও অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু কথা হচ্ছে, লিখলেই কি সব থাকছে? কালের আবর্তে অধিকাংশই কি হারিয়ে যাচ্ছে না?

আবার কিছু কিছু পঙ্ক্তি টিকেও যাচ্ছে- থেকেও যাচ্ছে মানুষের মুখে মুখে। যারা টিকে যাচ্ছে তারা টিকে যাচ্ছে কেন? কোনো যোগ্যতায় তারা টিকে যাচ্ছে সেইটে ভাবার কথা। কোনো গভীর গবেষণা ছাড়াই টিকে যাওয়া কিছু পঙ্ক্তির কথা স্মরণ করতে পারি; যেমন ‘যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ কিংবা ‘নানান বরণ গাভী রে ভাই একই বরণ দুধ/জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুত’ অথবা ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ কিংবা ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’ এই যে পঙ্ক্তিগুলোর উল্লেখ করা হলো এ সব পঙ্ক্তির যারা রূপকার তাদের সবার নাম অধিকাংশেই হয়তো জনেন না কিন্তু পঙ্ক্তিগুলো আওড়ে যান অবলীলায়।

এর অর্থ, নিশ্চয়ই পঙ্ক্তিগুলোর নিজস্ব কোনো শক্তি আছে যে শক্তিটি আবিষ্কার সৃষ্টিশীল প্রত্যেক কবির জন্য জরুরি। কবিকে আবিষ্কার করে নিতে হবে কবিতার বাণীসত্তাকে, পাশাপাশি শিল্পসত্তাকেও। বাংলা কবিতায় চাঁদের অজস্র উপমা আমরা দেখি, কিন্তু সুকান্ত ভট্টাচার্য যখন লেখেন ‘পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ তখন পাঠক চাঁদের নতুন একটা অবয়ব প্রত্যক্ষ করেন এবং ক্ষুধার্ত মানুষের চেতনার সাথে চাঁদের এই বিপর্যয়টিকে যথার্থ মনে করেন এবং মেনে নেন। পঙ্ক্তিটি মানুষের মুখে মুখে চালান হয়ে যায় এবং যুগ যুগ ধরে ক্ষুধার্ত মানুষের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। রবীন্দ্রনাথ যখন উচ্চারণ করেন,

তৃণ ক্ষুদ্র অতি তারেও বক্ষে ধরিয়া মাতা বসুমতি কহিছেন- যেতে নাহি দেবো! ঘায় তবু চলে যায় তবু যেতে দিতে হয়।

রবীন্দ্রনাথ উচ্চারিত ‘যেতে নাহি দেবো’ তাই যুগ যুগ ধরে মানুষের বিচ্ছেদ মুহূর্তের আর্তি হয়ে উচ্চারিত হতে থাকে সর্বকালের মানুষের আকুতিতে। মানুষের কাছে কবির চিন্তা-দর্শন-আদর্শকে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব কবির একার নয়, সে দায়িত্ব সমাজের সংবেদনশীল-সচেতন মানুষ প্রত্যেকের। প্রতিটি মানুষ যখন নিজের দায়িত্বটি নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করবেন তখন সমাজ অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে।

কেবল কবিতায় নয়, বাঙালির মৃত্তিকাসংলগ্ন থাকতে হবে শিল্পকলার প্রতিটি আঙিনায়; মৃত্তিকাসংলগ্ন থাকতে হবে দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালোবেসে; ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তের ঋণ বারবার সে কথাই যেন শুনিয়ে যায় আমাদের।

আমরা যদি সেই সত্যের আলোকে স্রোত হতে পারি, তখন সমাজে শুদ্ধতার প্রবাহ বয়ে যাবে। সবাই মিলে গেয়ে উঠবে- ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে.. .. .. ..’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App