×

মুক্তচিন্তা

স্মৃতির ফাগুন দিনে সবুজের আবাহন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:৫৬ পিএম

স্মৃতির ফাগুন দিনে সবুজের আবাহন
স্মৃতির ফাগুন দিনে সবুজের আবাহন

ক্যাম্পাসের বসন্ত রাতগুলো ছিল অসাধারণ। রাতের ক্যাম্পাসে কখনো কখনো চাঁদের আলোতে, কখনো বসন্তসমীরণে সেই ত্রিভুবনজয়ী, অপার রহস্যময়ী আনন্দ-মুরতি জেগে উঠত মনে। প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে আমরা হারিয়ে যেতে চাই, জীবনকে প্রকৃতির রং, রূপ ও গন্ধে মাতিয়ে নিতে চাই। বসন্তের রংয়ে পৃথিবীকে ভালোবাসতে চাই, সুন্দর পৃথিবী দেখতে চাই।

ঋতুরাজ বসন্তের সূচনায় প্রকৃতি বাসন্তী সাজে মনোলোভা হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি এখন নতুন সাজে প্রেমোন্মুখ, মানবমনে ফাগুন এসে রঙিন রং ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফাগুনে পুরনো পৃথিবী হয়ে ওঠে শ্যামল-বরণী, যেন যৌবন-প্রবাহ ছুটে চলে দিগি¦দিক। কখনো কখনো পুরনো স্মৃতি বিরহ নিয়ে আসে, আবার নতুন মিলনের হাতছানি থাকে।

আসলে নতুন বসন্ত আসে নতুন জীবনের বারতা নিয়ে। ‘বসন্ত উৎসব’ নামকরণের পিছনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা আছে। তাঁর সঙ্গীত, নাটক ও কবিতায় এই ঋতুর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে অবারিত উৎসুকে। শান্তিনিকেতনে তিনি বসন্ত উৎসব শুরু করেন ফাগুনের প্রথমদিনে।

তবে দোল উৎসব হিসেবে দিনটিকে আখ্যা দেননি তিনি। ঋতু উৎসবের সার্বজনীনতাকে বেশি প্রাধান্য দেয়ার জন্য কবি এটির নামকরণ করেন ‘বসন্ত উৎসব’। বর্তমানে ১ ফাগুন শান্তিনিকেতনের অন্যতম উৎসবে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় উদযাপিত ‘বসন্ত উৎসব’ আমাদের আঙিনার অন্যতম অনুষ্ঠান নতুন রং নিয়ে উপস্থাপিত হচ্ছে। একইভাবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ ফাগুনের বৈচিত্র্য শিক্ষার্থীদের আনন্দযাত্রায় পরিণত হয়েছে। সেই স্মৃতিই এখানে বর্ণনা করছি আমি।

দেখতে দেখতে শীতের আবহ পাল্টে গেল। কি অদ্ভুত সৌন্দর্যে ক্যাম্পাসের চারপাশ জেগে উঠল। ফাগুনের মোহনায় মনমাতানো মহুয়া ফুলের গন্ধ ঢেউ খেলে আমাকে মোহিত করল। রঙিন পাখিদের আলাপন আর সুখ মেখে থাকা ঠোঁটে পাতার সৌন্দর্য আমাকে টেনে নিয়ে গেল অজানা প্রান্তরে।

আমার প্রিয় জারুলতলা, কাটা পাহাড়ের নির্জন পথ আর পাহাড়ে হেলান দিয়ে থাকা বৌদ্ধবিহারের পাশে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ কিংবা আইন অনুষদের সোনালুর ফুলঝুরি- প্রকৃতির এই ঐশ্বর্য ফাগুনের স্বতন্ত্র রূপ নিয়ে আমাকে আলোড়িত করে। কাটা পাহাড়ের গায়ে লুকিয়ে থাকা আবাবিল পাখির কলতানের কথা মনে পড়ে।

এই ক্যাম্পাসে আমি ছিলাম দীর্ঘদিন। প্রকৃতি যেমন পাল্টে যায় জীবনও তেমনি বদলে যায়। আজকের ফাগুনের আনন্দ, উৎসাহ, উদ্দীপনা ক্যাম্পাস জীবন থেকে ভিন্ন। সেই জীবনটা ছিল স্বপ্নময়, আলোড়িত, কচিপাতার মায়ায় জড়ানো। হয়তো তখন আমার চিন্তার জগৎ ততটা প্রসারিত হয়নি।

সবকিছুই দেখছি সহজ চোখে, মধুর হয়ে উঠছে যা দেখছি; যা ভাবছি তাই করছি। নিজের অনুভূতি অন্যের কাছে শেয়ার করে খুশি হচ্ছি। ক্যাম্পাসের জীবন স্মৃতিময়, সুখের কলাপাতা যেন, যার কোনায় লেগে থাকে স্বচ্ছ জলের ধারা।

ফাগুনের সকাল ছিল উত্তেজনার, বিপুল উদ্যমের। ঘুম ভাঙতেই শুভেচ্ছা জানানো শুরু হতো। তারপর নিজেকে প্রস্তুত করে হলের বাইরে চলে আসা। বের হওয়ার আগেই সতীর্থদের সাজসজ্জা দেখে প্রাণের আবেগ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। এক একজনের শাড়ি দেখে আমি নিজেই মোহিত হতাম।

ফাগুনের রং কত সুন্দর হয়ে মেখে থাকত সবার চোখে-মুখে। হলুদের বৈচিত্র্য সত্যিই দেখার মতো ছিল। কেউ কেউ আবার গামছা দিয়ে নিজেকে গ্রামীণ জীবনের মোড়কে তুলে ধরত। আমরা যারা আদিবাসী ছিলাম তারা নিজেদের পোশাককে ফাগুনের সঙ্গে মিলিয়ে পরতাম।

কখনো থামি আর নিজস্ব তাঁতে বোনা বাহারি আচ্ছাদনে সাজাতাম। দুরন্তপনা সে দিন ভেতরে ভেতরে তাড়িয়ে নিয়ে যেত আমাকে। হয়তো হলের বাইরে এসে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে হেঁটে যাচ্ছি, হয়তো কলাভবনের শেষ দিকের গলি দিয়ে ঝরনা দেখতে ছুটে চলেছি কিংবা লাইব্রেরির সামনে রক্তকরবী গাছের লালফুলের দিকে তাকিয়ে আছি। অথবা ছুটে উঠতে চাইছি উপাচার্য ভবনের বাংলোর ঢাল পথ ধরে। এভাবে মেতে উঠতাম সে দিনের বসন্ত দিনে।

ছিল শাটল ট্রেনে চড়ে শহরে যাওয়ার উদ্দীপনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে ক্যাম্পাস থেকে প্রতিদিন কয়েকবার চট্টগ্রাম শহরে ট্রেন আসা-যাওয়া করে। ফাগুনের প্রথম দিন চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা রংয়ের খেলায় মেতে ওঠে। তারা পুরো ট্রেনকে বর্ণিল সাজে দৃষ্টিনন্দন করে তোলে।

বিকেল হলেই স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, দেখতাম বসন্ত উৎসবে যারা বিচিত্র সাজসজ্জায় এসেছিল তারা সবাই বিদায় নিচ্ছে। তবে কেউ ক্লান্ত নয়। সবাই উচ্ছ্বসিত। ট্রেন ছাড়ার আগে সিটে বসে বগিভিত্তিক গানের দল পরিবেশনা শুরু করেছে। শহরের বন্ধুদের বিদায় দিয়ে ফিরে আসতাম বুদ্ধিজীবী চত্বরে।

সবুজ ঘাস আর মেহগনি গাছের বেষ্টনী ঘেরা চত্বরটি আমার খুব প্রিয় ছিল। প্রায় প্রতিদিন ক্লাস শেষ করেই সেখানে চলে আসি আমি। আড্ডা চলত সন্ধ্যা অবধি। কোনো কোনো সন্ধ্যায় চাঁদের আলো সঙ্গে নিয়ে ফিরতাম। বসন্ত ঋতু সেরকম আনন্দ নিয়ে এসেছিল আমার জীবনে।

ক্যাম্পাসে সে দিন যখন দখিন দুয়ার খুলে গেছে তখন নিজেকে বাতাবী নেবুর ঘ্রাণে আর আমের মুকুলের গন্ধে ছড়িয়ে দিয়েছি। মাঝে মাঝে উন্মনা হয়েছি। বন্ধু আসবে বলেও যখন আসে না তখন নতুন প্রকৃতির পুষ্পসাজ বিষণ্ন হয়ে ওঠে। মনের আকাশে ফাগুনের আগুন জ্বলে; পিয়াসী পাখি উড়ে চলে সুদূরে।

নিজের পাখনায় ভর করে ছুটে চলতে ইচ্ছে জাগে। কারণ আমি তো হৃদয়ের ডাক শুনতে পাই এই ফাগুনে। ‘ফাগুনে আমার ফিরেছে আবার হিমেল বায়, আলোর পিছনে লুকানো ছায়ায় মায়া জড়ায়। কবে চলে গেছো সে কথা কবে ভুলেছি, ভুল করে কেবল সুখের মালা গেঁথেছি।’

এই গানের মর্মভেদী সুর বিরহের যন্ত্রণা নিয়ে আসে সংগোপনে। তবু আমি বসন্তে দেখি বনভূমি ফুলবনে সাজে, চরণে তার পায়েল রুনুঝুনু বাজে। ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় আত্মহারা হই। বনবীথিতে কোকিলের কলগীতি, আর বকুলের গন্ধে উজ্জীবিত থাকি। ক্যাম্পাসের বসন্ত রাতগুলো ছিল অসাধারণ।

রাতের ক্যাম্পাসে কখনো কখনো চাঁদের আলোতে, কখনো বসন্তসমীরণে সেই ত্রিভুবনজয়ী, অপার রহস্যময়ী আনন্দ-মুরতি জেগে উঠত মনে। প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে আমরা হারিয়ে যেতে চাই, জীবনকে প্রকৃতির রং, রূপ ও গন্ধে মাতিয়ে নিতে চাই। বসন্তের রংয়ে পৃথিবীকে ভালোবাসতে চাই, সুন্দর পৃথিবী দেখতে চাই।

জ্যোৎস্না তঞ্চঙ্গ্যা : সহকারী কর্মকর্তা, সিলেট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App