×

মুক্তচিন্তা

বিএনপির সংসদে যোগদান কিংবা বয়কট প্রসঙ্গ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:৫৯ পিএম

বিএনপি দলটির এখন তাই সংশোধন-সংস্কার করা ভিন্ন অগ্রসর হওয়ার আর কোনো পথ নেই। সংসদে যোগদান হবে এই পথের প্রথম পদক্ষেপ। মির্জা ফখরুল-মনসুর যদি ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংসদে যান এবং বিশেষজ্ঞ আইনজীবী-রাজনীতিক ড. কামালকে নিয়ে চলতে পারেন, তবে বাংলাদেশে পুনরায় জাতীয় চার নীতির এক নীতি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার পথে বাধাবিঘ্ণ এড়িয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হতে পারে। ধানের শীষের আবার যেমন গতি পেতে পারে, তেমনি গণতন্ত্র অগ্রসর হওয়ার সুযোগ-সম্ভাবনা সৃষ্টি হতেও পারে!

খবরে প্রকাশ, বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সংসদে যেতে চাচ্ছেন। সম্প্রতি এক ফোরামে নির্বাচিত ৬ জনই এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। দলের মধ্যেও হয়ে গেছে দুই ভাগ। নির্বাচনে বিজয়ী মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সংসদে যোগ দেয়ার পক্ষে।

সম্প্রতি বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা সত্ত্বেও বিএনপির সংসদে যোগদানের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। কারণ সংসদে গেলে সেখানে দলীয় অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি সরকারের অনিয়ম সামনে আনা যাবে এবং বিএনপির রাজনীতিকে দেশবাসী ইতিবাচক মনে করবে।

এই পরিস্থিতিতে সাজাপ্রাপ্ত লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া শনিবার সন্ধ্যায় একাদশ জাতীয় সংসদে অংশ নেয়া বিএনপির নেতাদের সঙ্গে স্কাইপিতে বৈঠক করেছেন। জানা যায়, তিনি বিএনপির বিজয়ী নেতাদের সংসদে যোগদানের বিরুদ্ধে এবং ক্ষুব্ধ মতামত প্রকাশ করেছেন। মহাসচিব মির্জা ফখরুলের ওপর তিনি নাখোশ বলেও পত্রপত্রিকায় খবর বের হয়েছে।

সিনিয়র নেতারা সবাই হেরেছেন। তাই দলের সিনিয়র নেতারা স্বাভাবিভাবেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এদিকে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী গণফোরাম সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর সংসদের যোগ দিতে একপা বাড়িয়ে দিয়েছেন।

তারেক জিয়ার বয়কট অবস্থান সত্ত্বেও জানা যাচ্ছে, বিগত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী যারা জিতেছিলেন এবং যাদের জয়লাভের সম্ভাবনা আছে, তারা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছেন।

প্রসঙ্গত এবারে বিএনপির সিনিয়র এক নেতাই জিতেছেন এবং আর সবাই হেরেছেন। এবারের মতো এতটা না হোক অতীতে কতক নির্বাচনের পর দেখা গেছে, বিভিন্ন দল সিনিয়র নেতাদের একাংশ জিতেছেন আর অপর অংশ হেরেছেন।

তেমন অবস্থায় দল ‘জিতু পার্টি’ ও ‘হারু পার্টি’-তে বিভক্ত হয়ে যায়। জিতুরা চায় সংসদে যোগ দিতে আর হারুরা চায় বয়কট করতে। জিতু পার্টি বলে, জনগণ ভোট দিয়েছে সংসদে গিয়ে তাদের কথা বলার জন্য। বয়কট মানে ভোটারদের বঞ্চিত বা অপমান করা।

সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলন ছাড়া নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি করা যায় না। অপরদিকে হারু পার্টিরা বলতে থাকেন, সংসদে যোগ দিলে নির্বাচন ও সরকার বৈধতা পেয়ে যাবে। জনগণ বিভ্রান্ত হবে। আন্দোলন দানা বাঁধবে না। এই অবস্থা কেবল বড় দলগুলোতেই নয়, ছোট দলগুলোতেও হয়ে থাকে। অভিজ্ঞতা থেকে কেবল একটা সময়ের ঘটনাই বলি।

১৯৮৬ সালে মিডিয়া ক্যু করে জাতীয় পার্টি যখন নির্বাচন জিতে তখন নৌকা প্রতীক নিয়ে সিপিবির ৫ জন সদস্য নির্বাচিত হয়। নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে বিবৃতি প্রকাশ ও কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সংসদে যোগদান নিয়ে আলোচনার সময় জিতু পার্টি ও হারু পার্টির অবস্থান সুস্পষ্ট হয়েছিল। সিপিবি তখন অবশ্য ভুল করেনি; ভেতরে-বাইরে সংগ্রামের তত্ত্ব সামনে রেখে সংসদে যোগদানেরই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

বলাই বাহুল্য অতীতের যে কোনো সময়ের যে কোরো চাইতে বিএনপির বর্তমান অবস্থা ভিন্ন; বিধ্বস্ত ও শোচনীয়। প্রসঙ্গত তীব্র ও ব্যাপক আন্দোলনে সরকারের আশু পতনের কোনো সম্ভাবনা থাকলে বয়কটের লাইনে যাওয়া চলে। কিন্তু আশু পতনের পরিস্থিতি না থাকলে নির্বাচন বা সংসদ বয়কটের লাইন আত্মহত্যারই নামান্তর।

২০১৪ সালে বিএনপির বয়কট এবং তারই অনুষঙ্গ গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর লাইন কতটা আত্মঘাতী হয়েছে, তা নিতান্ত অন্ধ না হলে বিএনপির নেতাকর্মীরাও বুঝবে। যদি ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিত তবে খালেদা জিয়া সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিরোধীদলীয় নেতা থাকতেন। তখন তার ভাগ্য নিঃসন্দেহে হতো অন্য রকম।

বিএনপিও এতটা জনবিচ্ছিন্ন বিভক্ত ও বিধ্বস্ত হতো না। প্রকৃত বিচারে আইনি ও সংসদীয় সুযোগ না নিয়ে পরাজিত-বিধ্বস্ত কোনো দলই আবারো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। বর্তমানে সরকার পতনের আশু কোনো সম্ভাবনা নেই। বিএনপির পক্ষের মানুষ এখন রাস্তায় নামবে বলে পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় না।

খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপি কাণ্ডারিবিহীন নৌকার মতো। তার আশু মুক্তির কোনো লক্ষণ নেই। আর তারেক রহমানের প্রভাব নেতাদের মধ্যে থাকলেও বিএনপির তৃণমূলে তারেকের প্রভাব নেই বললেই চলে। বিএনপি মহলে কান পাতলেই শোনা যায়, খালেদা জিয়া ছাড়া তারেক জিয়া দলের মধ্যে হিরো থেকে জিরোতে নেমে আসবেন।

অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, নির্বাচনের পর বিএনপির জমায়েতে ক্রমেই মানুষ কমছে। খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা কেবল সরকারের গ্রেপ্তারের ভয় পেয়ে রাস্তায় নামে না এমন নয়, রাস্তায় নামলে আগের মতো অগ্নিসন্ত্রাস হতে পারে মনে করে ভয়ে রাস্তায় নামে না। মজার ব্যাপার হলো, বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচনে অনিয়মের প্রমাণ নির্বাচন কমিশনে জমা দেবে এবং মামলা করবে।

নির্বাচনের পর এক মাসের বেশি পার হলেও সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। অভিজ্ঞতা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, আমাদের দেশে সরকারবিরোধী স্ট্রাইকিং ফোর্স হচ্ছে দুটো : ছাত্র ও আর্মি। যতটুকু জানা যায়, বিএনপি সমর্থক ছাত্ররা এখন আন্দোলন মাথা থেকে দূর করে যাচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দিকে। আর নির্বাচন দেখিয়ে দিচ্ছে আর্মি এখন ক্ষমতার প্রশ্নে অবৈধ কোনো পদক্ষেপ নিবে না।

প্রসঙ্গত বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশের মানুষ রাজনীতির গতি-প্রকৃতি অনুধাবন করতে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর হাবভাব পর্যবেক্ষণ করে। এখন পর্যন্ত বিশ্ব রাজনীতিতে ফ্যাক্টর সব বড় দেশ নতুন নির্বাচিত সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে এবং সরকারের সঙ্গে কাজ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা ম্যানেজ করা, অব্যাহত উন্নয়নের ধারা বজায় রাখা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার বিষয়ে সজাগ থাকা, উগ্রজঙ্গি নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা, অরাজকতার বিপরীতে দেশকে স্থিতিশীল রাখা ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলা প্রভৃতির জন্য শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি বিশ্বে এখন উজ্জ্বল।

সর্বোপরি বিএনপির আন্তর্জাতিক খুঁটি প্রথম থেকেই ছিল পাকিস্তান ও সঙ্গে চীন। পাকিস্তানের প্রভাব উপমহাদেশীয় বিশেষত আমাদের দেশে ক্রমাগত কমছে। দেশটি নিজেই রয়েছে সমস্যা ও সংকটে নিমজ্জিত। ঠিক মুক্তিযুদ্ধের আগের মতো রয়েছে অস্তিত্বের সংকটে, ভাঙনের মুখে।

বলাই বাহুল্য দেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানের প্রভাব এবং দেশটির সাহায্য-সহযোগিতা আগের মতো নেই বলেই বিএনপি এখন ভারতবিরোধী ইস্যু সামনে আনছে না। আর চীন ইতোমধ্যে প্রকাশ্য-বাস্তব তথা অর্থনৈতিক কূটনীতিতে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক দুই ব্যাপার। বাংলাদেশের জন্য অতীতের মতো চীন-পাকিস্তান এক্সিস (অক্ষ) সৃষ্টি করতে চীন আদৌ উৎসাহী নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

এটাই চীনের জন্য স্বাভাবিক। কেননা চীন আমেরিকার ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের তালে পড়ে এখন নিজের পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত থাকছে। রয়েছে উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে নানা সমস্যায়। এই অবস্থায় বিএনপির বয়কটের লাইন অন্য কোনো দেশের প্রকাশ্য সমর্থন পাচ্ছে না, এটা বিএনপি সমর্থকদের কাছে সুস্পষ্ট।

এই অবস্থায় যদি সংসদে না যায়, তবে বিএনপির অবস্থা দাঁড়াবে না ঘরকা না ঘাটকা। দুই নৌকার এক নৌকায়ও পা থাকবে না। কেবল ডুবতেই থাকবে বিএনপি। আর যত নিচে নামতে থাকবে বিএনপি ততই গণতন্ত্র নির্বাচন ও সংসদ বিষয়ে অতীত অপকর্ম-দুষ্কর্ম আলোচনায় সামনে আসবে এবং দলটি অক্টোপাসের জালে আটকা পড়বে। কারণ এ বিষয়ে বিএনপির ট্রেক রেকর্ড কলঙ্কের কালিমায় লিপ্ত।

বিএনপি দলটির জন্ম গণতন্ত্রের আন্দোলনের ভেতর দিয়ে হয়নি। হত্যা-ক্যু-পাল্টা ক্যুয়ের ভেতর দিয়ে সেনাশাসক জিয়ার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে দলটির জন্ম। ক্যান্টনম্যান্ট হচ্ছে বিএনপির সূতিকাগার। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সামরিক আইনের মধ্যে রাজনৈতিক দলবিধি জারি করে রাজনৈতিক দলের ছাড়পত্র দিয়েছিল।

তিনিই আইয়ুব খানের মতো দেশে প্রথম সামরিক আইনের মধ্যে উর্দি পরে নির্বাচন করেন এবং ‘হুকুমের নির্বাচনে’ রাবার স্টাম্প পার্লামেন্ট তিনিই প্রথম আমদানি করেন। যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হয় জিয়া হত্যা এবং আরো একটি ক্যু ও সামরিক আইনের শাসন। জিয়ার ব্যবস্থার ধারাবাহিকতারই ফলাফল হচ্ছে সেনাশাসক এরশাদ।

বেশি কথায় না গিয়েও বলা চলে, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যা ও সামরিক আইনের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় দেশের রাজনীতির পটপরিবর্তন। রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সবকিছু যায় পাল্টে; জাতিসত্তা, জাতীয় চার নীতি, শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতি সব কিছু। কিন্তু জিয়া-সাত্তারের পর এরশাদের ক্ষমতায় আসাটা রাজনীতির পটপরিবর্তন নয়।

রাজনীতির ধারাবাহিকতার ফলাফল; যা কলঙ্কের কালিমায় লিপ্ত। বলাই বাহুল্য বিএনপির রাজনীতির একমাত্র উজ্জ্বল জায়গাটা হচ্ছে ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দলের যুগপৎ আন্দোলন। বিএনপি তখন নিজেকে সংশোধন-সংস্কারের সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। অবশ্য এই ব্যর্থতা ছিল ললাটেরই লিখন। সোনার তো আর পাথর বাটি হয় না।

একানব্বই সালে সরকার গঠনে বিএনপি যখন জামায়াতের সাহায্য নেয়, তখনই দলটির বারোটা বাজে। জিয়া ক্ষমতা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারসাম্যমূলক নীতি কার্যকর করতে সচেষ্ট ছিলেন, কিন্তু তখন ওই অবস্থান থেকে একেবারেই সরে আসে বিএনপি। জিয়া আমলের চাইতেও মূলগতভাবে জাতির জন্মের উৎস থেকে সরে পড়ে এবং বিপথগামী হয়।

বিপথগামী হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো জিয়া হত্যার বিচার না করা। কেননা সেটা করলে তো কেঁচো খুঁড়তে বের হয়ে আসবে সাপ। আর এর পরিণতিতেই প্রথমে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় গঠিত হয়। এসবই হয়েছে যখন যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের গাড়িতে-বাড়িতে পতাকা ওঠে এবং তারেক রহমান প্রজেক্টেড প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবস্থান নেয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, নব্বইয়ের নির্বাচনে বিএনপি সংবিধান পরিবর্তন করে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু সংসদীয় রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সংসদে অনুপস্থিত থাকেন, সংসদীয় কমিটিগুলোকে অচল রাখেন এবং অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করেন। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে মাগুরা নির্বাচনের ভেতর দিয়ে।

এসব কিছুই দেশবাসী ভুলে যায়নি। ছিয়ানব্বইয়ের তথাকথিত নির্বাচন করে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয় বটে কিন্তু সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যুক্ত করে পালিয়ে বাঁচে। দেশে গণতন্ত্রের শুভ সূচনা হয়েছিল যখন দেশের ইতিহাসে প্রথম সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করে ২০০১ সালের নির্বাচন সামনে আসে।

কিন্তু ‘প্রথম রাতে বিড়াল মেরে’ সা-ল-শা সরকার গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় পথে প্রথম পেরেকটি বসায়। গণতন্ত্রের কফিনে দ্বিতীয় পেরেক হলো শেখ হাসিনার কোটালীপাড়ার জনসভায় বোমা পুঁতে রাখা। হাসানউল্লাহ মাস্টার, এ এস এম কিবরিয়া, মনজুরুল ইমাম প্রমুখ নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা হচ্ছে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় এক একটি পেরেক।

সবেচেয়ে বড় পেরেকটি পোঁতা হয়, যে দিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিউনিউর জনসভায় গ্রেনেড নিক্ষিপ্ত হয়। আরো একটি বড় পেরেক ছিল ইয়াজউদ্দিনের টু ইন ওয়ান তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আর সর্বশেষ পেরেক হলো আগুন সন্ত্রাস।

নির্বাচনের আগে-পরে বিএনপি এবং এমনকি ড. কামাল এখনো ভাঙা কলের গানের মতো বলে যাচ্ছেন, জাতীয় চার নীতির এক নীতি গণতন্ত্রের নাকি সর্বনাশ হচ্ছে এবং আওয়ামী লীগ নাকি তা করছে। হঠাৎ করে তো আর কিছু হয়নি। যেমন ‘হঠাৎ বাংলাদেশ’ হয়নি মেজর জিয়ার ২৬ ডিসেম্বরের বঙ্গবন্ধুর নামে ভাষণে।

‘স্বাধীনতার ঘোষক’ ‘দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট’ ইত্যাদি বলে জাতির পিতাকে কতই না অবমাননা ও ইতিহাস বিকৃত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে সঠিক পথে আনতে হলে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে, জাতিসত্তাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় প্রতিষ্ঠিত করা ভিন্ন বিকল্প নেই। কেননা ওটা হচ্ছে জাতি তথা জাতি-রাষ্ট্রের ভিত্তি। ভিত্তি দুর্বল কিংবা বিনষ্ট করে গণতন্ত্র ও নির্বাচন সব ঠিকমতো সামনের দিকে অগ্রসর হবে, এটা যারা ভবেন তারা কোন স্বর্গে বসবাস করেন জানি না!

বিএনপি দলটির এখন তাই সংশোধন-সংস্কার করা ভিন্ন অগ্রসর হওয়ার আর কোনো পথ নেই। সংসদে যোগদান হবে এই পথের প্রথম পদক্ষেপ। দুই নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া বর্তমানে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে নেই। পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।

এই বাস্তবতায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল হচ্ছেন বিএনপির প্রধান নেতা। তিনি নির্বাচনে জিতেছেন। ভদ্র, বিনয়ী বিশেষত বক্তব্য সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার ব্যাপারে মির্জা ফখরুলের ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতার জায়গা রয়েছে। আর ডিগবাজি দিলেও বঙ্গবন্ধুকে মর্যাদা দিয়ে যথাস্থানে রাখায় এবং জামায়াত নিয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান থাকায় ড. কামাল ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের ইমেজ এখনো একেবারে নস্যাৎ হয়নি।

মির্জা ফখরুল-মনসুর যদি ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংসদে যান এবং বিশেষজ্ঞ আইনজীবী-রাজনীতিক ড. কামালকে নিয়ে চলতে পারেন, তবে বাংলাদেশে পুনরায় জাতীয় চার নীতির এক নীতি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার পথে বাধাবিঘ্ণ এড়িয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হতে পারে। ড. কামাল-মির্জা ফখরুল-সুলতান মনসুর এই প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারলে ধানের শীষের আবার যেমন গতি পেতে পারে, তেমনি গণতন্ত্র অগ্রসর হওয়ার সুযোগ-সম্ভাবনা সৃষ্টি হতেও পারে!

শেখর দত্ত : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App