×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:১৬ পিএম

এবার শেখ হাসিনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এতসব প্রার্থীর মধ্য থেকে কাদের তিনি রাখবেন কাদের বাদ দিবেন। কিন্তু তিনি দলীয় রাজনীতি ও আদর্শের ফর্মুলাতে অবিচল থাকলেন- যার ফলে বেশকিছু ত্যাগী নারী নেত্রীর সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ ঘটেছে যারা যুগ যুগ ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত থেকেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অথচ অনেকেই তাদের কথা খুব বেশি জানতেন না। এরা নিজ নিজ এলাকায় হয়তো দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতেন। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা এদেরই নিরঙ্কুশভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের ৫০টির ৪৩টি আওয়ামী লীগ পেতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ৪১টি আসনের মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে। এবার আওয়ামী লীগের নারী সংসদ সদস্য হতে ১৫০০-এর বেশি নারী দলীয় মনোনয়ন ফরম ক্রয় করেছেন। দলের ধানমন্ডির রাজনৈতিক অফিসে এ নিয়ে বেশ সরগরম ছিল।

ফরম কিনেছিলেন অনেক নারী- যাদের অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। আবার কেউ কেউ সবেমাত্র আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় দেশের চিত্রজগৎ, শিল্পজগৎ, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন মহলে পরিচিত বেশ অনেকেই ছিলেন।

মিডিয়াগুলোয় এই নিয়ে ক’দিন বেশ রং চং মাখানো আলোচনা চলেছিল। সাধারণ অনেকেই মনে করেছিলেন যে আওয়ামী লীগ হয়তো নামি-দামি, প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয়তা রয়েছে এমনদেরই মনোনয়নে প্রাধান্য দিবে। বিষয়টি নিয়ে নানারকম ভাবনাচিন্তা ছিল, আওয়ামী লীগ নারী সদস্য মনোনয়নে কোনদিকে হেলে পড়ছে সেটিও অনেকে পর্যবেক্ষণে রাখছিলেন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ রাজনীতির প্রজ্ঞার কাজটি করেছে। এর জন্য দলীয় সভানেত্রী বিভিন্ন মহলের প্রশংসা পাচ্ছেন। আবার যারা এতদিন ভিন্ন কিছু ভাবছিলেন তারা অনেকটাই চুপসে গেছেন। এখানেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির বোঝাপড়া এবং সামনে চলার প্রজ্ঞানতা।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দলের মনোনয়নে দল এবং দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে এবার যেভাবে দেখেছেন সেটি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের মনে হচ্ছে।

আমাদের সংবিধানে একসময় ১৫টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এ নিয়ে নানা ধরনের মত রয়েছে। তবে নারীদের ক্ষমতায়নে আমাদের সমাজে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে ১৯৭৩ সাল থেকে অনেকেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

আবার পরবর্তী সময়ে রাজনীতির বিপদগামিতার কারণে সংসদ যেমনিভাবে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি একইভাবে নারী সংসদ সদস্য হিসেবে সংবিধানের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যে ধরনের নারী সদস্যদের সুযোগ দেয়া দরকার ছিল তাদের বাদ রেখে অভিজাত, প্রভাবশালী, বিত্তশালী ও সুবিধাবাদীদের সুযোগ দেয়ার ফলে সংরক্ষিত আসনের মর্যাদাও সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

এরশাদ আমলে নারী সদস্যদের নিয়ে মিডিয়াতে অলঙ্কার শব্দের মাধ্যমে যে বিদ্রƒপটি বেশ ছড়িয়েছিল সেটি কোনো অর্থেই কাম্য ছিল না। কিন্তু দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সংসদ যখন অবহেলিত হয় শাসকগোষ্ঠীর হীনস্বার্থ যখন প্রতিফলিত হয় তখন গোটা সংসদই সমালোচনার ঊর্ধ্বে ওঠা খুব কঠিন ব্যাপার।

১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের ধারায় দেশ উন্নীত হলেও সংসদে প্রধান দলগুলো মনোনয়নে নারী প্রার্থীদের অবস্থান খুব বেশি এগোয়নি। মূল দলের মাথায় সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়টি থাকত বিধায় পুরুষ সদস্যদেরই মনোনয়ন দানে প্রাধান্য দেয়া হতো। সেটি বড় দল হিসেবে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগ অনেক বেশি নারীদের প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করেছে।

আগের সংসদ নির্বাচনগুলোতেও কয়েকটি আসনে কয়েকজন নারী সদস্য জয়লাভ করে এসেছেন। তারপরও সংখ্যাটি খুব বেশি বলা যাবে না। তবে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সাল থেকে দলীয় সংরক্ষিত নারী আসনে অপেক্ষাকৃত ত্যাগী মহিলা নারীদের সদস্য করে সংসদে মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা করেছে।

বিএনপিও তাদের মতো করে তাদের দলের প্রতি ত্যাগীদের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছে। জাতীয় পার্টি এ ক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নিজস্ব বিবেচনার বাইরে খুব বেশি কাউকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলে মনে হয় না। এবার শেখ হাসিনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এতসব প্রার্থীর মধ্য থেকে কাদের তিনি রাখবেন কাদের বাদ দিবেন।

কিন্তু তিনি দলীয় রাজনীতি ও আদর্শের ফর্মুলাতে অবিচল থাকলেন- যার ফলে বেশকিছু ত্যাগী নারী নেত্রীর সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ ঘটেছে যারা যুগ যুগ ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত থেকেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অথচ অনেকেই তাদের কথা খুব বেশি জানতেন না। এরা নিজ নিজ এলাকায় হয়তো দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতেন।

কিছু চাওয়া-পাওয়ার বিষয় নিয়ে কখনো বিরোধে জড়িয়ে কিছু করেছেন এমন কোনো খবর জানা নেই। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা এদেরই নিরঙ্কুশভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন। এরা প্রায় সবাই বয়সে অনেক প্রবীণ হলেও দলের সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ এই প্রথম পেয়েছেন। অথচ আগে অনেকেই কম সময়ের রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে সংসদ সদস্য হতে পেরেছেন।

এবার সেইরকম ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। জানা গেছে মাত্র দুজন সদস্য আগের সংসদে ছিলেন। এক অর্থে মনে হতে পারে প্রায় সবাই সংসদ সদস্য হিসেবে নতুন হওয়ায় অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকতে পারে। কিন্তু সেটি একান্তই অনুমান নির্ভর। অনেকেই রাজনীতির পোড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুনভাবে সংসদে বসে অনেক ভালো ভূমিকা রাখার নজির সৃষ্টি হয়তো করতেও পারেন। সেটি আমাদের প্রত্যাশার বিষয়।

আমরা আশা করব যারা এই সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে আওয়ামী লীগের এবারের সংসদ সদস্য হতে যাচ্ছেন তারা দলীয় প্রধানের যে আশা আকাক্সক্ষা ও শ্রদ্ধা তাদের প্রতি দেখিয়েছেন সেটি তারা উপলব্ধি করবেন এবং সেভাবেই সংসদে ও নিজ নিজ এলাকায় ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবেন।

সংসদ অধিবেশন যখন চলবে তখন হয়তো তারা ঢাকায় থাকবেন কিন্তু বাকি সময়টি যদি তারা আগের মতোই নিজ নিজ এলাকায় কাজে সময় দেন, অবহেলিত নারী-পুরুষসহ সবার কাজে সময় দেন তাহলেই তাদের এই সুযোগটি বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির কর্মকাণ্ডের ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হয়ে উঠতে পারে।

সেটি নির্ভর করবে সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে তাদের আগামী পাঁচ বছর কাজ করার মধ্য দিয়ে। সে ক্ষেত্রে দল হিসেবে আওয়ামী লীগও দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন সংযোজন ঘটানোর দাবি করতে পারবে। এখন বিষয়টি নির্ভর করছে নতুন সদস্যদের সংসদ সদস্য হিসেবে প্রভাব রাখার মতন কাজ করার দৃষ্টান্ত থেকে।

দলের প্রতি দীর্ঘদিনের ত্যাগ এবং নিষ্ঠার বিবেচনায় এত ব্যাপক সংখ্যক নারী সদস্যের সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ ঘটায় আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিতেও যে বার্তাটি ছড়িয়ে পড়েছে সেটি হলো- যতদিন শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্বে আছেন, ততদিন তিনি দলের আদর্শে নিষ্ঠাবানদের মূল্যায়ন সর্বাগ্রে করবেন।

কার কি অর্থবিত্ত, গ্রুপিং, সামাজিক ও অন্যান্য প্রভাব রয়েছে সেটি সম্ভবত খুব বেশি প্রশয় পাওয়ার সুযোগ ঘটবে না। এই বার্তাটি নারীদের প্রতি নয়, পুরুষ নেতাকর্মীদের প্রতিও ঘটছে বলে আমার বিশ্বাস।

শেখ হাসিনা দীর্ঘ প্রায় ৪ দশক ধরে দলের দায়িত্বে থেকে দল এবং দলের নেতাকর্মীদের সাধারণ প্রবণতা বুঝতে পেরেছেন তা থেকে তিনি দলকে মুক্ত করার জন্য কয়েক বছর থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, সততা, ন্যায়-নীতি ও দুর্নীতিমুক্ত থাকার যে আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন সেটি ক্রমেই তিনি দলের নেতাদের মনোনয়ন দানে অনেক বেশি বিবেচনায় নিয়ে আসছেন।

গত নির্বাচনেও এর বেশকিছু লক্ষণ দেখা গেছে। তবে তখন নানাকিছু বিবেচনা করে তিনি একটা মধ্যম অবস্থানে থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভা গঠনে তিনি অনেক বেশি দলীয় ভাবাদর্শ ধারণ, বহন ও অবগাহনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

তিনি মূলত সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন সেটি বাস্তবায়নে তার আদর্শ নির্ভর রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দেয়া ছাড়া আর কোনো সুযোগ নেই- সেটি তিনি বুঝাতে চেয়েছেন। সর্বশেষ সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দানে তিনি সেই বার্তাটিকে নিরঙ্কুশ করেছেন।

এর ফলে শুধু আওয়ামী লীগই নয় সরকার ও জনগণ শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও চিন্তা-ভাবনার মূল ধারণাটি পেয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যে অভিযান শুরু হয়েছে সেটি নিয়ে সুধী মহলে যে আশাবাদ রয়েছে আবার সুবিধাবাদী মহলে যে ধরনের চুপসে যাওয়ার অবস্থান রয়েছে সেই অবস্থায় শেখ হাসিনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আদর্শবাদীদের সঙ্গে পাওয়ার ইচ্ছাশক্তিরও প্রকাশ ঘটছে বলে মনে হয়।

এখন বৃহত্তর সমাজের উচিত বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখা। আওয়ামী লীগ এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের কাজ হবে দলের আদর্শকে ধারণ, নিজেদের প্রস্তুতকরণ এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এখন থেকেই কাজ করার চিন্তা-ভাবনা ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা- কোনো অবস্থাতেই ভিন্ন কোনো পথে নয়। তাহলেই তারা ভবিষ্যতে শেখ হাসিনার কাছ থেকে মূল্যায়িত হতে পারেন।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App