×

মুক্তচিন্তা

দুর্নীতির সঙ্গে নো টলারেন্স ঋণখেলাপির সঙ্গে কেন নয়?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:২১ পিএম

খেলাপিদের সম্পত্তির অভাব, সরকারি সম্পত্তি তৃতীয় নামের শত্রু সম্পত্তি, মামলার অধীন সম্পত্তির নানা ধরনের ভেজাল বা অসঙ্গতি দেখানোতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ঘটনা দিনে দিনে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সমস্যা প্রকটতর হচ্ছে। সুতরাং এক শ্রেণির ব্যাংক মালিক, ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারি দিব্যি ভদ্রবেশে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে মেরে দিচ্ছে, আদৌ ফেরতও দিচ্ছে না বরং রাজনৈতিক আশ্রয়ে ফুলে ফেঁপে দিব্যি কলাগাছে পরিণত হচ্ছে। ব্যাংকে সাধারণ মানুষ যারা হিসাব খুলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা।

প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, দুর্নীতির সঙ্গে ‘নো কম্প্রোমাইজ’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তার কথার পুনরুক্তি করে বলছেন ‘দুর্নীতির সঙ্গে নো কম্প্রোমাইজ’। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান অহরই দেশবাসীকে শোনাচ্ছেন ‘দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে দুর্নীতির সঙ্গে আদৌ কোনো আপস নেই- তা সে যেকোনো দলমতেরই হোক না কেন’।

প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় সন্দেহ নেই সামান্যতম। আসলেই তিনি চান দেশটি দুর্নীতিমুক্ত হোক এবং তার উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সাফল্যের মুখ দেখুক। কিন্তু তা কার্যকর করবেন কার মাধ্যমে? যাদের মাধ্যমে দুর্নীতির উচ্ছেদ ঘটাবেন, দুর্নীতির প্রতি হাজারোবার ‘নো টলারেন্স’ উচ্চারণ করা সত্ত্বেও বস্তুতই কি তারা তাই? যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথা বলি- তাহলে তার জবাব না। তাদের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ।

অভিযোগগুলো অর্ধেকও যদি সত্য হয় এবং সেই অভিযোগকারীরা তার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেন তবে হয়তো রামায়ণ মহাভারতের মতো বিশালাকায় গ্রন্থ কয়েক খ-ে প্রকাশ করা যায়। সেই ছোটবেলা থেকে পুলিশ সম্পর্কে এমনই কথা গুনে আসছি। পাকিস্তান আমলের ২৩টি বছর গেল, বাংলাদেশের ৪৭টি বছর অতিক্রান্ত।

দীর্ঘ এই ৭০ বছরের পথ পরিক্রমায় আসলে কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে? পুলিশের নিয়োগে জনপ্রতি যে পরিমাণ টাকা লাগে বলে শুনি তাতে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হয়। তবে পুলিশ বিভাগের সবাই দুর্নীতিবাজ- এমন অভিযোগ আনছি না এমন অভিযোগ সত্যও না। যথেষ্ট পরিমাণ ভালো কর্মকর্তা আছেন বলেই ডিপার্টমেন্টটি এখনো টিকে আছে তবে খারাপ অংশ যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিসাধন করছে তা ভয়াবহ। ‘পুলিশকে জনগণের বন্ধু’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় এখনো কথার কথাই রয়ে গেছে মূলত। আর ওই খারাপ অংশের কাজকর্মের ফলে গোটা সরকারকে তার দায়িত্ব বহন করতে হচ্ছে।

ক’দিন স্বাস্থ্য বিভাগের কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য রকমের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলো। কোথায় তাদের কয়টা বাড়ি, কয়টা ফ্ল্যাট, কী কী ব্যবসা, বাড়ি, গাড়ি- সব কিছুর তথ্যসহ। দুর্নীতি দমন কমিশন তখন তাদের তথ্য প্রমাণাদিসহ তলব করলেন। তদন্ত শুরু হলো।

একটি দৈনিক পত্রিকায় দুর্নীতির মামলা সম্পর্কে প্রথম পৃষ্ঠায় খবর বেরিয়েছিল তদন্ত হয়, চার্জশিট হয় না। বস্তুত ওই শিরোনামটি যথার্থ। বহুকাল ধরেই দেখে আসছি দুর্নীতির বড় বড় মামলায় শুধু আসামিকে তলব ও তদন্ত হয় দীর্ঘকাল ধরে- তারপর কোনো চার্জশিট আদালতে দাখিল না করে তারা চুপচাপ থাকেন। ফলে আমরা সাধারণ মানুষরা হই বিভ্রান্ত। ধরে নিতেই হয় আসামি নিরপরাধ বলেই হয়তো তার বিরুদ্ধে কোনো চার্জশিট দেয়া হয় না। কিন্তু ঘটনা কি সত্যই তাই।

অতএব অনার্জিত সম্পদ যার পাওয়া গেল- তাকে কীভাবে নির্দোষ ভাবা যাবে? তাহলে কোথাও কোনো গলদ আছে। গলদটি চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব তো দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের। তিনি চুপ করে থাকেন কোনো জাদুমন্ত্র বলে? বস্তুত সর্বত্র স্বচ্ছতা কাম্য। সরকার জনগণের- তাই যেখানে যাই ঘটুক ভালো অথবা মন্দ সরকারিভাবেই জনগণ তা জানতে অধিকারী। কিন্তু সে অধিকারের স্বীকৃতি আমাদের ভাগ্যে আজো জুটল না।

২১ জানুয়ারির ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকাটি লাল কালি দিয়ে চার কলামব্যাপী ব্যানার হেডলাইন দিয়েছে এই মর্মে ‘বেপরোয়া খেলাপি ঋণ’ লিখেছে কর্পোরেট গ্যারান্টারের অশুভ সংস্কৃতি। ব্যাংকের এক মালিক কর্পোরেট গ্যারান্টিতে ঋণ নেন অন্য ব্যাংক থেকে। টাকা নিয়ে ফেরত দিতে চান না কেউই।

খবরে বলা হয়েছে কর্পোরেট গ্যারান্টির নামে ব্যাংকিং খাতে চলছে প্রতারণা। আইনের কঠোরতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এক ব্যাংকের পরিচালকরা কর্পোরেট ঋণ গ্রহণ করেছেন অন্য ব্যাংক থেকে। যার কারণে ভুয়া মানুষের নামে ব্যাংক ঋণ বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণও। আদালতে মামলা গড়ালেও তা স্থগিত করে প্রভাবশালীরা এ সুবিধা নিয়ে থাকেন। এতে খেলাপির পরিমাণ আরো বাড়তে থাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ব্যাংক ঋণের নামে অনেক সময় জনগণের জামানত নিয়ে যা খুশি তাই করা হয়। গরিব মানুষের প্রদত্ত অর্থ ঋণ দিয়ে রাখা হয় না কোনো রকমের সম্পদ বন্ধক। আবার ভুয়া নামে-বেনামে ঋণ প্রমাণের অভিযোগ রয়েছে অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অনিয়মগুলো হতে থাকে। খেলাপিরা আদালতে আশ্রয় নিয়ে সব কিছু থামিয়ে রাখে। ফলে ঋণ আদায় বন্ধ থাকে আদালতের হস্তক্ষেপে।

আবার কোনো কোনো ঋণখেলাপি পালিয়ে যান বিদেশে। এতে সত্যিকারের বিনিয়োগকারীরা বঞ্চিত হয়। দেশের টাকা বাইরে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হয়। এ সব খেলাপি অনিয়ম রোধে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে সম্পদের নিরাপত্তার জন্য সম্প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তারা মনে করেন জবাবদিহিতা এ ব্যাপারে অপরিহার্য। ব্যাংকের মালিক ও কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা প্রয়োজন।

পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদেরও রাখতে হবে কঠোর নজরদারিতে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক চাপ যাতে ঋণ প্রদানের বা ঋণ ফেরত দানের সময়সীমা বৃদ্ধিতে যেন কোনো ভূমিকা না রাখতে পারে তাই জরুরিভিত্তিতে নিশ্চিত করা দরকার। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ঋণ প্রদাননীতি মালিকদের স্বার্থে নয়- ব্যাংকে যারা টাকা রাখেন তাদের স্বার্থে অবিলম্বে সংস্কার করা অপরিহার্য।

ওই পত্রিকাতে অপর এক শিরোনাম ‘মামলা হলেও আদায় হয় না’ তে বলা হয়েছে খেলাপি এক লাখ বার হাজার কোটি টাকা। খেলাপিদের ব্যবসা সচল। এতে বলা হয়েছে, ‘ব্যাংকিং খাতে যাতে রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ। জানা যায় দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর এই টাকা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এর মধ্যে আবার ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। অর্থাৎ পাঁচ বছরেও আদায় না হওয়া ওই সব ঋণ ‘মন্দ’ ঋণ হিসেবে ব্যাংকের হিসাব থেকে বাদ দিয়ে আলাদা খাতায় নেয়া হয়েছে। সরকারের দুর্বলতা, রাজনৈতিক রক্ষা বেষ্টনী ও আইনি বাধা ফাঁকফোকরের মাধ্যমে খেলাপিরা পার পেয়ে যাচ্ছে।

খেলাপি ঋণ পরিশোধে কাউকে কাউকে আটক করে জেলে নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের ছেড়ে দিতেই হয় তাদের উপযুক্ত জামানত-সম্পত্তি প্রভৃতি আইনের চোখে খুঁজে না পাওয়ার কারণে। আর এ সব মামলায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের এক অংশের যোগসাজশও প্রকট। খেলাপিদের সম্পত্তির অভাব, সরকারি সম্পত্তি তৃতীয় নামের শত্রু সম্পত্তি, মামলার অধীন সম্পত্তির নানা ধরনের ভেজাল বা অসঙ্গতি দেখানোতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ঘটনা দিনে দিনে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সমস্যা প্রকটতর হচ্ছে। সুতরাং এক শ্রেণির ব্যাংক মালিক, ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারি দিব্যি ভদ্রবেশে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে মেরে দিচ্ছে, আদৌ ফেরতও দিচ্ছে না বরং রাজনৈতিক আশ্রয়ে ফুলে ফেঁপে দিব্যি কলাগাছে পরিণত হচ্ছে। ব্যাংকে সাধারণ মানুষ যারা হিসাব খুলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা।

ঢাকাসহ জেলা, উপজেলা শহরগুলোতে প্রকৃতি অনুসন্ধান চালালে যে বিপুলসংখ্যক বহুতল বিশিষ্ট দালানকোঠা দেখা যায় তার বেশির ভাগেরই উৎস খেলাপি ঋণ। এ ক্ষেত্রে ঋণখেরাপি দূর করতে হলে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে; এক. কোনো ব্যাংক মালিক বা তার পরিবার পরিজন কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন না উপযুক্ত জামানত ব্যতিরেকে। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জামানতের সম্পত্তি ব্যাংকের সম্পত্তিতে আফসে আপ পরিণত হবে;

দুই. কোনো কর্পোরেট ঋণ নয়।

তিন. আদালত কদাপি ব্যাংকের টাকা আদায় সংক্রান্ত মামলা তিন মাসের বেশি স্থগিতাদেশ দিতে পারবেন না। শুনানি কার্য তার মধ্যে বাধ্যতামূলক করার জন্য প্রয়োজনে আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তিন মাসের শুনানি শেষ না হলে ব্যাংকের প্রাপ্য টাকা শর্তানুযায়ী ব্যাংক নিয়ে নেবে। এর বিরুদ্ধে কোনো আপিল চলবে না।

চার. যেসব ঋণখেলাপিরা ভুয়া সম্পত্তি সরকারি সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি জাতীয় সম্পত্তি অবৈধভাবে জামানত হিসেবে দেখিয়েছেন এবং যেসব কর্মকর্তা, ব্যাংকের আইনজীবী সেগুলো বৈধ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন বা স্বাক্ষর করেছেন তাদের প্রত্যেককে ২০ লাখ টাকা করে জরিমানা এবং ২০ বছর কারাবাস বাধ্যতামূলক করে আইন করতে হবে।

নতুন সংসদ এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ভেবে অচিরেই সিদ্ধান্ত নিন যাতে ঋণখেলাপি শব্দটাই আমরা ডিকশনারি থেকে তুলে দিতে পারি। এতে জনগণ উপকৃত হবে দেশের উন্নয়ন বেগবান হবে।

রণেশ মৈত্র: রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App