×

জাতীয়

কারাগারে খালেদার ৩৬৫ দিন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:৫০ এএম

কারাগারে খালেদার ৩৬৫ দিন

জীবনধারাই বদলে গেছে

রুমানা জামান : দিন-মাসের হিসাব পেরিয়ে কারাগারে বন্দি জীবনের এক বছরে বদলে গেছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জীবনধারা। রাত জাগার পুরনো অভ্যাস ত্যাগ করেছেন তিনি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার কক্ষের বাতি রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যেই নিভে যায়। পত্রিকা পড়া, কারারক্ষীদের সঙ্গে আড্ডা আর গৃহপরিচারিকা ফাতেমার সঙ্গেই কাটে তার দিবানিশি। আর কঠোরভাবে মেনে চলেন কারাবিধি। এভাবে ৮ ফেব্রুয়ারি কারাজীবনের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে তার। এবারই প্রথম কারাজীবন নয় খালেদা জিয়ার। এর আগে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি রাজনীতিতে যোগ দেয়ার পর তিনি মোট চারবার গ্রেপ্তার হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি গ্রেপ্তার হন। তবে তখন তাকে বেশি দিন আটক থাকতে হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ৩৭২ দিন জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার স্থাপিত বিশেষ সাব জেলে এক বছরেরও বেশি সময় ছিলেন তিনি। সর্বশেষ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিশেষ আদালতের রায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে ঢুকেন খালেদা জিয়া। ওই দিন থেকে পুরনো ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে শুরু হয় তার কারাজীবন। তার বিরুদ্ধে ৩৫ মামলার মধ্যে একটিতে জামিন হলে, অন্য মামলা সামনে আসছে। এভাবেই চলছে জামিনের সংগ্রাম। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি সাধারণ কারাবন্দি হিসেবে নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে খালেদা জিয়াকে রাখা হয়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, নামাজ আদায় ও পত্রিকা পড়ে ওই দিনটি কাটিয়েছেন খালেদা জিয়া। ওই দিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পরিবারের চার সদস্য তার সঙ্গে দেখা করেন। টানা চার দিন সাধারণ কয়েদির মতো জীবনযাপনের পর ১১ ফেব্রুয়ারি ডিভিশন পাওয়ার পর সেখান থেকে খালেদা জিয়াকে বন্দিদের সন্তান রাখার স্থান ডে-কেয়ার সেন্টারে নেয়া হয়। এরপর থেকে তাকে পড়ার জন্য একটি দৈনিক পত্রিকা দেয়া হয়। একজন ডিভিশনপ্রাপ্ত প্রথম শ্রেণির বন্দি হিসেবে সেখানেই কারাবাস করছেন তিনি। তার দেখাশোনার জন্য প্রথম দিন থেকে স্বেচ্ছায় কারাগারে রয়েছেন গৃহপরিচারিকা ফাতেমা। এ নিয়ে বিতর্কও হয়। পরে খালেদা জিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত খালেদা জিয়াকে দেখাশোনার জন্য ফাতেমাকে কারাগারে রাখার নির্দেশ দেন। পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে তার খাবার রান্না করা হয়। ওই খাবার প্রথমে উপকারাধ্যক্ষ ও কারাধ্যক্ষ খান। পরে চিকিৎসকের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর খালেদা জিয়াকে দেয়া হয়। তিন বেলাই এসব নিয়ম মানা হয়। কেন্দ্রীয় কারাগারে অধিকাংশ সময় চুপচাপই থাকেন খালেদা জিয়া। সময় কাটে ইবাদত বন্দেগি আর বই ও পত্রিকা পড়ে। এ ছাড়া গৃহকর্মী ফাতেমাসহ সেখানে দায়িত্বরত কারা মহিলা স্টাফদের সঙ্গে আলাপচারিতায় সময় কাটে তার। সূত্র জানায়, কারাগারের সব নিয়মই মেনে চলছেন খালেদা জিয়া। তাকে কোনো বিষয় নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের অনুরোধও করতে হয় না। ২৮ মার্চ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করার কথা থাকলেও তা করেনি কারা কর্তৃপক্ষ। অনাকাক্সিক্ষত কারণে খালেদা জিয়াকে কারা কর্তৃপক্ষ আদালতে হাজির করেনি দাবি করে শুনানির পরবর্তী তারিখ চান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। গত ৭ এপ্রিল সকালে হঠাৎ করেই হাঁটু ও হাতের এক্স-রে করাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেয়া হয় খালেদা জিয়াকে। এ সময় পরিবারের সদস্যরা, দলের সিনিয়র নেতারা তার সঙ্গে দেখা করেন। তখন বিএনপি দাবি করেছিল খালেদা জিয়াকে জোর করে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। চিকিৎসার কিছুই হয়নি। শুধু হেনস্থা ও হয়রানি করা হয়েছে। মেডিকেল চেকআপ শেষে দুপুরে তাকে ফের কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর থেকেই অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বিভিন্ন মামলার হাজিরা দিতে আদালতে যাননি খালেদা জিয়া। যার কারণে পুরনো কারাগারের একটি কক্ষে খালেদা জিয়ার বিচারের জন্য অস্থায়ী এজলাস বসানো হয়। সূত্র জানায়, কারাগারে খালেদা জিয়া শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট, চোখ ও হাঁটুর সমস্যায় ভুগছেন। সেই সঙ্গে ডায়াবেটিসের কারণে তার চোখের সমস্যা হচ্ছে। গত বছরের ৫ জুন কারাগারে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এমন অবস্থায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করাতে সরকারের কাছে একাধিকবার দাবিও জানায় বিএনপি। কিন্তু সে দাবি পূরণ হয়নি। অন্যদিকে ধীরে ধীরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরিবার ও দলের নেতাদের দেখা পাওয়ার অনুমতি কমে আসে। বিএনপির অভিযোগ, বন্দিদের আইনসম্মত অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি। গত ১৬ জুন রোজার ঈদের দিন দলের সিনিয়র নেতারা কারাগারে তার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করার অনুমতি না পেয়ে কারাফটক থেকে ফিরে আসেন। ৫ সেপ্টেম্বর কারাগারের ভেতরে অস্থায়ী আদালতে হাজিরা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, আপনাদের যত দিন ইচ্ছা, যত ইচ্ছা সাজা দেন। আমি বার বার আসতে পারব না। আমি অসুস্থ। আমি পা নাড়াতে পারি না। ডাক্তার আমাকে বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। ৬ অক্টোবর হাইকোর্টের নির্দেশে খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে ফের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালেই সাব জেল ঘোষণা করে তাকে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করানো হয়। এক মাস দুই দিন পরে শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল জানিয়ে খালেদা জিয়াকে আবারো কারাগারে নেয়া হয়। এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে কয়েকটি সমমনা দলকে সঙ্গে নিয়ে ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি। ওই দিন সংবাদ সম্মেলন করে সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দিয়ে সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্য সরকার গঠনসহ ৭ দফা দাবি জানায় ঐক্যফ্রন্ট। এসব দাবি সরকার আমলে না নেয়ায় খালেদা জিয়াকে ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে বিএনপির হাইকমান্ড। এ নিয়ে তারা দফায় দফায় বৈঠক করে। এই ইস্যুতে দুটি পক্ষ সরব হয়ে ওঠে দলের ভেতরে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একান্তে দেখা করেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। তার অনুমতি নিয়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ১১ নভেম্বর নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় বিএনপি। এরপর ১২ নভেম্বর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির পাঁচ সিনিয়র নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। খালেদা জিয়াও তাদের দিকনির্দেশনা দেন। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় নির্বাচনের মাঠে নামে দলটি। কারাগারে থেকেই ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৭ এই তিনটি আসনে নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেন খালেদা জিয়া। কিন্তু দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় নির্বাচন কমিশন তিন আসনেই তার মনোনয়ন বাতিল করে। সূত্র জানায়, বিশাল আয়তনের কারাগারে অধিকাংশ সময় খালেদা জিয়া শান্ত ও চুপচাপ থাকেন। কারা কর্মকর্তাদের কাছে তিনি কোনো চাহিদার কথা জানান না। কিছু লাগবে কিনা এ বিষয়ে কারা কর্মকর্তারা খোঁজ নিতে গেলে তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে জানাব। প্রথম শ্রেণির একজন বন্দি ১৫ দিনের পরিবর্তে ৭ দিনে একবার চিঠি লেখার সুযোগ রয়েছে। তবে গত এক বছরে তিনি কাউকে কোনো চিঠি লেখেননি। এক বছরের কারাজীবনে পরিবারের স্বজনরা কয়েক দফা তার সঙ্গে দেখা করেছেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এককভাবে সাক্ষাৎ করেছেন। এ ছাড়া তার আইনজীবীরা কারাগারে কখনো দেখা করেছেন, কখনো দেখা পাননি। তার মুক্তির বিষয়ে বর্তমানে দলীয় নেতাকর্মীরা রয়েছেন ধোঁয়াশায়। কেউ বলছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি পাবেন তিনি। আবার কেউ বলছেন, মুক্তির জন্য গড়ে তুলতে হবে দুর্বার আন্দোলন।

২ মামলায় সাজা, ঝুলছে আরো ৩৫টি

এস এম মিজান : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সামনে আরো ৩৫টি মামলা রয়েছে। দুর্নীতি, যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, সহিংসতা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কট‚ক্তির অভিযোগে দায়ের করা পৃথক ২১টি মামলার মধ্যে ১৯টি বর্তমানে বিচারাধীন আছে। এই ১৯টির মধ্যে গত বছরের ৪ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৪টি মামলা বিচারের জন্য ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে তদন্তাধীন আছে বেশ কিছু মামলা। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও কুমিল্লার একটি হত্যা মামলা ছাড়া বাকি সব মামলায় তিনি জামিনে রয়েছেন। বকশীবাজারে স্থানান্তর হওয়া বাকি মামলাগুলোর মধ্যে তিনটি নাইকো, গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতির মামলা। তিনটি মামলায়ই সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (এক-এগারোর সময়) দায়ের করা। অন্য ৩২টি মামলা ২০১৪ সালের পর বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। মূলত রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যা, ইতিহাস বিকৃতি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কট‚ক্তি, ভুয়া জন্মদিন পালনের অভিযোগে এসব মামলা হয়। পুলিশ, সরকারি দলের নেতাকর্মী ও আইনজীবীরা এসব মামলা করেছেন। এর মধ্যে ২৫টি মামলা হয়েছে ঢাকায়। কুমিল্লায় তিনটি এবং পঞ্চগড় ও নড়াইলে একটি করে মামলা রয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি করে দুদক। বিচারিক কার্যক্রম শেষে গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত রায়ে এ মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর ও অন্য আসামিদের ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। পাশাপাশি অর্থদণ্ড দেয়া হয়। পরে এ মামলায় খালেদা জিয়া ও অপর আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করলে শুনানি শেষে গত বছরের ৩০ অক্টোবর রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে খালেদা জিয়ার দণ্ড বাড়িয়ে ১০ বছর করা হয়। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা : ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলাটি করে দুদক। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। বিচারিক কার্যক্রম শেষে বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক আখতারুজ্জামান গত বছরের ২৯ অক্টোবর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে খালেদা জিয়াসহ অপর আসামিদের সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৯ নভেম্বর উচ্চ আদালতে আপিল করেন খালেদা জিয়া। এ মামলার আপিলের শুনানি এখনো শুরু হয়নি। গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা : ১৪ কোটি ৫৬ লাখ ৩৭ হাজার ৬১৬ টাকা দুর্নীতির অভিযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর দুদকের উপপরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী গ্যাটকো দুর্নীতি মামলাটি করেন। এজাহারে খালেদা জিয়া, তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়। মামলা হওয়ার পরদিনই খালেদা ও কোকোকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর মামলাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয় জরুরি ক্ষমতা আইনে। পরের বছর ১৩ মে খালেদা জিয়াসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়। উচ্চ আদালতে স্থগিত থাকার পর ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে বিচারিক আদালতে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতি মামলা : চীনা প্রতিষ্ঠান কনসোর্টিয়াম অব চায়না ন্যাশনাল মেশিনারিজ ইম্পোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সঙ্গে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রায় ১৫৮ কোটি ৭১ লাখ টাকার ক্ষতির অভিযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া এবং তার মন্ত্রিসভার ১০ সদস্যসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে এ দুর্নীতি মামলা করা হয়। ওই বছরের ৫ অক্টোবর ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে দুদক। মামলাটির কার্যক্রম দীর্ঘদিন উচ্চ আদালতে স্থগিত থাকলেও ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ স্থগিতাদেশ তুলে নেন উচ্চ আদালত। তবে এই মামলাটির অভিযোগ গঠন হয়নি এখনো। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। নাইকো দুর্নীতি মামলা : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় এই মামলা করে দুদক। পরের বছর ৫ মে খালেদা জিয়া ও মওদুদ আহমদসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে তুলে দেয়ার মাধ্যমে আসামিরা রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন। দীর্ঘ স্থগিতাদেশ শেষে ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ মামলাটির বিচার শুরুর আদেশ দেন উচ্চ আদালত। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি মামলাটির চার্জ গঠনের শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। নাশকতা ও বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগে কুমিল্লার আদালতে থাকা দুটি মামলার মধ্যে একটি উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে। অন্যটিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানহানির অভিযোগে করা একটি মামলা বর্তমানে স্থগিত। নড়াইলে মানহানির অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মানচিত্র ও জাতীয় পতাকাকে অবমাননার অভিযোগে ঢাকার আদালতে ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর মানহানির মামলা করেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী। বিশেষ এজলাসে বিচারাধীন এ মামলায় গত ১২ অক্টোবর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ১৫ আগস্ট ভুয়া জন্মদিন পালনের অভিযোগে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন সাংবাদিক গাজী জহিরুল ইসলাম। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আছে। এ ছাড়া ঋণ খেলাপির অভিযোগে সোনালী ব্যাংক খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ও ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে মামলা করে। আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর ওই মামলায় খালেদা জিয়াকে পক্ষ করা হয়। মামলাটি ঢাকার অর্থঋণ আদালতে সাক্ষ্য পর্যায়ে আছে। হত্যা ও নাশকতার ১৩ মামলা : ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপিসহ ২০ দলের ডাকা হরতাল-অবরোধের সময় বাসে আগুন, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, মানুষ হত্যাসহ বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় ঢাকায় ১০টি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এসব মামলায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হয়। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানায় ২টি ও দারুস সালাম থানায় ৮টি মামলা রয়েছে। এই ১০টি মামলার মধ্যে ৮টি ঢাকার বিশেষ আদালতে, অন্য ২টি মহানগর দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানি পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধ চলাকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি বাসে পেট্রলবোমা ছোড়া হয়। এতে বাসে আগুন ধরে আটজন যাত্রী পুড়ে মারা যায়। এ ঘটনায় ২টি মামলা হয়। ২টিতে খালেদা জিয়া হুকুমের আসামি। ২টি মামলায় ২০১৭ সালের ৯ অক্টোবর খালেদা জিয়াসহ বিএনপি-জামায়াতের ৭৮ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর মধ্যে ১টি মামলা স্থগিত আছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে গুলশানে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের মিছিলে পেট্রলবোমা হামলার অভিযোগে করা ১টি মামলায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আছে।

সময় কাটে বই-পত্রিকা পড়ে

ইমরান রহমান : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে পুরনো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কারাগারে পত্রিকা ও বই পড়ে বেশিরভাগ সময় কাটান তিনি। মাঝে মধ্যে বিটিভি দেখেন। কারাজীবনের আগের মতো বেলা করে ঘুম থেকে ওঠেন। আবার অনেক রাতে ঘুমাতে যান বলে জানিয়েছে সেখানে কর্তব্যরত একাধিক সূত্র। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি কারা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা। কারাসূত্র জানায়, সকাল ১০ থেকে ১১টার মধ্যে ঘুম ভাঙে খালেদা জিয়ার। ঘুম থেকে উঠেই তিনি গোসল করতে যান। এরপর ফজরের নামাজ পড়েন। ফলে বেশিরভাগ দিন তিনি সকালের খাবার খান না। নামাজ পড়া শেষে তিনি ২টি পত্রিকা পড়েন। এরই মধ্যে তার দুপুরের খাবার মেন্যু জানতে চাওয়া হয়। বেশিরভাগ দিন দুপুরে তিনি মাছ অথবা মুরগির মাংস খেতে চান। খাবার রান্না হতে হতে তিনি জোহরের নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে তিনি অজিফা পড়েন। এরপরেই তাকে খাবার খেতে দেয়া হয়। খাবার খাওয়া শেষে বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ড (ডিশ লাইন নেই) দেখেন। এরইমধ্যে বিকেল হয়ে যায়। আসরের নামাজ পড়ে বিকেলে তিনি গৃহকর্মী ফাতেমাকে নিয়ে ডে কেয়ার সেন্টারের বারান্দায় পায়চারী করতে করতে গল্প করেন। যদিও অসুস্থতার কারণে তিনি এখন ভালো মতো হাঁটতে পারেন না। এভাবেই সন্ধ্যা হয়। পরে রাতের মেন্যু জানতে চাওয়া হয়। মাগরিবের নামাজ শেষে আবার বিটিভি দেখেন তিনি। পরে এশার নামাজ পড়ে বিভিন্ন বই পড়তে বসেন। কারা অধিদপ্তরও তার চাহিদা অনুযায়ী বই সরবরাহ করে। বই পড়তে পড়তে গভীর রাতে ঘুমাতে যান তিনি। সারাদিনের এই সময়ের মধ্যে বেশির ভাগ সময় তিনি শান্ত ও চুপচাপ থাকেন। বই ছাড়া কারা কর্মকর্তাদের কাছে তিনি কোনো চাহিদার কথা জানান না। কিছু লাগবে কি না কারা কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় খোঁজ নিতে গেলে খালেদা জিয়া বলেন, প্রয়োজন হলে তিনিই জানাবেন। কারা অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নামপ্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেদিন আদালতে হাজিরার জন্য যেতে হয় শুধু সেদিন দ্রুত ঘুম থেকে ওঠেন তিনি। বাকি দিনগুলো তিনি দেরিতে ঘুমিয়ে বেলা করে ওঠেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক বজলুল রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, একজন ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি হিসেবে সব সুবিধাই তিনি পাচ্ছেন। এর বেশি কিছু জানি না। উল্লেখ্য, গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। ওই দিনই নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারকে বিশেষ কারাগার ঘোষণা দিয়ে রাখা হয় তাকে। এরপর ১১ ফেব্রুয়ারি ডিভিশন পাওয়ার পর সেখান থেকে খালেদা জিয়াকে বন্দিদের সন্তান রাখার স্থান ডে-কেয়ার সেন্টারে নেয়া হয়। ডে কেয়ার সেন্টারের ২য় তলার একটি কক্ষেই কারাবাস করছেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App