×

মুক্তচিন্তা

জঙ্গিবাদের ভয়: রাজনীতি ও সমাজের দায়িত্ব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:২২ পিএম

আমাদের দেশ মা ও মাটি নরম প্রকৃতির। এর সঙ্গে আর যাই যাক উগ্রবাদ যায় না। সে পাপ সে কলঙ্কমুক্ত হতে পারলে বাংলাদেশের উন্নতি আরো বেগবান আরো দৃঢ় হবে। এটাই চরম সত্য। অগ্রগামী মানুষ আজ হয় নীরব নয়তো সস্তা কোনো বন্দনায় মুখর। তাদের যথাযথ ভূমিকায় দেশ জাতি জঙ্গির মতো উটকো আর ভয়াবহ সমস্যার কবল থেকে বেরিয়ে আসুক।

ক’দিন আগে আমরা একটি ভয়াবহ খবর দেখেছি। দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে গা সওয়া মনে হলেও বিষয় সাংঘাতিক। জঙ্গি দমনে সরকার কঠোর হলেও তারা আছে। আমি আমাদের বাহিনীর প্রশংসা করবই। তারা জান কবুল রেখে কাজ করে চলেছে। অথচ আমাদের মনোজগতে এখনো নানা ধরনের অন্ধকার।

বহু মানুষকে আমি দেখি যারা ধর্মের নামে উদ্ভট কিছু বইপত্রসহ কাউকে গ্রেপ্তার হতে দেখলেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। মধ্যপন্থি বিএনপি মার্কা লোকগুলো ওপরে আধুনিক হলেও অন্তরে বিষ। এরা বাইরে ভুলেও বলে না যে তারা জাতীয়তাবাদের নামে উগ্রতার ঘোর সমর্থক। বললে পরে তাদের উদার জীবনযাত্রা কথিত আধুনিকতা থাকবে না। তাই তারা মুখে এক মনে আরেক।

এদের ধারণা সরকার যেনতেন প্রকারে জঙ্গির নামে ধার্মিকদের নাকি অপমান করছে। হেনস্থা করছে। বটে। এই যে ভয়াবহ খবরটি দেখলাম তাতে আর কেউ জানুক বা না জানুক আমরা তো জানি কোন সম্পাদককে টার্গেট করা হয়েছিল। এবং এই পরিকল্পনা যে কত ভয়াবহ আর বাস্তব সেটা ঘটে যাওয়ার আগে অনেকে জেনেও মানবে না।

কথা হচ্ছে এরা এখনো সক্রিয়। আগেই বলে রাখি দেশের যত উন্নয়ন আর অগ্রগতি হোক সাম্প্রদায়িকতাসহ বহু পুরনো রোগ যায়নি। বরং দিন দিন গেড়ে বসছে। যে সম্পাদককে তারা টার্গেট করেছিল তার অপরাধ কি বা কতটা তার চেয়ে বড় তার ধর্মীয় পরিচয়। স্পর্শকাতর বিষয়ের নামে এভাবে সম্প্রদায়গত বিভেদ আর উসকানি আমাদের মিডিয়াকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করবে কেউ ভেবেছেন?

এদের ভয়ে বা এদের হুমকিতে এক সময় আমাদের সমাজে অন্ধকার নেমে এসেছিল। বহু গুণী মানুষ বহু নামি মানুষ হারিয়েছি আমরা। নতুনভাবে এমন ঘটনা আর না ঘটুক এটাই সবার চাওয়া। কিন্তু চাওয়া তো চাইলেই পূর্ণ হবে না। কি দেখছি আমরা? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কারো আন্তরিকতা দেখছি?

তিনি যখন যেখানে সুযোগ পাচ্ছেন গলা ফাটিয়ে বলছেন এদের দমন করতে। বাকিরা মুখে কুলুপ আঁটা। একমাত্র নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তারা ছাড়া আর কেউ মুখ খোলেন না। নেতাদের ভয় আমরা বুঝি। তাদের জঙ্গি দমনে ইচ্ছা থাকলেও তাদের হাত-পা অচল রাজনীতির শিকলে বাঁধা। তাই তারা মুখে প্রগতির কথা বললেও দৌড়ে যান হুজুরের দরবারে। যাওয়াটা অপরাধ না।

যা করবেন বা করতে চান তা মুখে বললেই হয়। মুখে প্রগতি আর আচরণে প্রতিক্রিয়া আমাদের ভীত করে। আমরা এমনিতেই ভয়ে আছি। সমাজের চারদিকে অন্ধকার ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। আর্থিক প্রগতির পাশাপাশি সমাজ প্রগতি যদি সমানতালে না এগোয় আমরা এসব সমস্যার সমাধান পাব না।

বাংলাদেশ যতদিন মৌলিক সমস্যাগুলোর দিকে মনোযোগী না হবে ততদিন এসব ঝামেলা চলবেই। ক’দিন আগে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল সামাজিক মিডিয়ায়। পাকিস্তানি একটি টিভি শো শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাদের স্বভাবসুলভ হঠকারী মনোভাবে আমাদের ব্যঙ্গ করতে না ছাড়লেও বারবার বলছিল বাংলা মুলুক আজ পাকিস্তানকে ফেলে কতটা এগিয়ে গেছে।

তাদের পরিসংখ্যান আর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন আজ বিস্ময়ের। এরপর এই সরকারের আর কি চাওয়ার আছে? যে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকার শেখ হাসিনার প্রাণনাশের ব্যাপারে কৌতূহলী তারা আজ নত। তারা এও বলছে বাংলাদেশ ভারত ও চীন উভয়কে সমানভাবে ম্যানেজ করে এগুচ্ছে। যা তারা পারেনি।

তাদের প্রতিবেদন সত্যি দেখার মতো। তাদের বিশ্লেষণ ও চমৎকার। নারী জাগরণের অভাব আর নিজেদের দেশে জঙ্গিবাদ পাশের দেশের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ মনোভাব যে তাদের পিছিয়ে দিয়েছে সেটাই বলছিল তারা। আমরা এত কিছুর পরও সেই নারী জাগরণকে সম্মান করতে শিখিনি। আমাদের মা-বোনেরা কতটা সাহসী আর অকুতোভয় তা যুদ্ধাপরাধীরা জানে।

জানে ঘাতক-দালালরা। দেশের পোশাক শিল্পের নারীরা যে পরিবর্তন এনেছে তাকে অপমান করার কত অপকৌশল যে এখনো চলছে বলে শেষ করা যাবে না। সবার ওপর আছে সমাজে অশান্তি আর অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা। খালেদা জিয়ার আমলে আমরা হবো তালেবান/বাংলা হবে আফগান স্লোগান দেয়া হতো। মনে করা হতো এটাই নিয়তি। শেখ হাসিনা সে অপকৌশল ব্যর্থ করে দিয়েছেন প্রায়।

এখনো যারা এসব উসকে দিচ্ছে তাদের রাজনীতি একা আওয়ামী লীগ সাইজ করতে পারবে না। তাদের তৃণমূলেও আছে নানা ধরনের ভেজাল। আদর্শহীন রাজনীতিই বড় সমস্যা। সেদিকে নজর দেয়ার সময় আছে তাদের? তারা ছায়া শত্রু নিয়ে ব্যস্ত। অগোচরে বেড়ে ওঠা জঙ্গিবাদ যখন ঘাড়ে চেপে বসবে তখন হয়তো সময়ও থাকবে না আর। তাই সমাজকে শুদ্ধ করা জরুরি।

বাংলাদেশের সৌভাগ্য আমাদের প্রতিবেশী দেশ দুটির সঙ্গে নানা সমস্যা থাকলেও জঙ্গিবাদের সমস্যা নেই। বরং একে ঠেকানোয় সবাই একমত। কিন্তু সমাজের ভেতরেই বসবাস করছে আমাদের দুশমনরা। প্রলোভন উসকানি আর অর্থের অবৈধ জোগান বড় সমস্যা। তারপর আছে প্রশ্রয়। যারা এসব লালন করে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি।

আর কেউ জানুক বা না জানুক আমাদের ওপর মহল সব জানে। তাই তাদের দায়িত্ব বেশি। তারা শক্ত হলে বা কঠোর হলে যে কিছু হতে পারে না সেটা আমরা দেখেছি। এই যে এবার ষড়যন্ত্র আঁতুড় ঘরে মারা পড়ল এটা তাদের শুভবোধের পরিচায়ক। এমন করে তারা যদি কাজ করতে পারেন তাহলে আমরা মিডিয়া যেমন মুক্ত দেখব তেমনি নির্ভয়ে মানুষ বসবাস করতে পারবে।

নতুন তথ্যমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুজনেই ঝানু। তাদের রাজনৈতিক মেধা আর অভিজ্ঞতা যদি কাজে লাগে তাহলে সমাজ নিরাপদ হবে। এখন সেটা প্রমাণ করার সময়।

সাধারণ মানুষ কোনো ধরনের অশান্তি ঝামেলা কিংবা হানাহানি চায় না। চায় না বলেই এখনো শান্তি বজায় আছে। উসকে না দিলে মানুষ পাশাপাশি শান্তিতে বসবাস করে। তাদের সমস্যা ভিন্ন। এখন উন্নত জীবন আর রোজগারই মূল বিষয়। মানুষ এটুকু জানে শান্তির শর্ত হচ্ছে নিরাপত্তা।

তাই আজ হরতাল জাদুঘরে। অবরোধ বা আগুন সন্ত্রাস অকার্যকর। এমন পরিবেশে সরকারের কঠিন হওয়ার ওপর অনেক কিছুই নির্ভরশীল। উন্নয়ন মুখে মুখে যতটা চাউর ততটা কাজে না হলে মানুষ বুঝে নিতে বিলম্ব করবে না। সেটাই কিন্তু যে কোনো দেশের গতিপথ নির্ণয় করে।

শেখ হাসিনা তা জানেন। তার হাত কতটা শক্তিশালী সেটাও পাকিস্তানি মিডিয়া বলে দিয়েছে। তারা স্বীকার করেছে যত ধরনের অভিযোগই থাকুক নির্বাচনে আওয়ামী লীগই জিতে আসত। এই বিশ্বাস বা প্রত্যয় দুশমন ব্যক্ত করতে পারলে আমরা কেন তাতে আস্থা রাখতে পারব না?

জঙ্গিবাদের কবলে পড়ে আমাদের বন্ধু অগ্রজ বা পরিচিতজনদের আমরা আর হারাতে চাই না। চাই না অশান্ত হয়ে উঠুক পরিবেশ। মানুষের দায়িত্ব অপরিসীম। সরকার বিরোধিতা বা তাদের কাজের বিরোধিতার জবাব হবে সমালোচনা আর প্রতিকার। হত্যা বা অরাজকতায় কোনো সমাধান নেই।

আবারো নিরাপত্তা বাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলি, আমাদের দেশ মা ও মাটি নরম প্রকৃতির। এর সঙ্গে আর যাই যাক উগ্রবাদ যায় না। সে পাপ সে কলঙ্কমুক্ত হতে পারলে বাংলাদেশের উন্নতি আরো বেগবান আরো দৃঢ় হবে। এটাই চরম সত্য। মনের কোণে কোণে জমে থাকা ভয় আর ভুল ধারণা যাদের প্ররোচিত করে তাদের আলোর পথ দেখানো সমাজ আর জাতির কর্তব্য।

অগ্রগামী মানুষ আজ হয় নীরব নয়তো সস্তা কোনো বন্দনায় মুখর। তাদের যথাযথ ভূমিকায় দেশ জাতি জঙ্গির মতো উটকো আর ভয়াবহ সমস্যার কবল থেকে বেরিয়ে আসুক। তবেই আমাদের ভবিষ্যৎ হবে আন্তর্জাতিক ও গৌবরমণ্ডিত।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App