×

মুক্তচিন্তা

জাতীয় ঐকমত্যের আহ্বান এবং বিদ্যমান রাজনীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:১৫ পিএম

রাষ্ট্রপতির ভাষণে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে জাতীয় ঐকমত্যের কথা। বলাই বাহুল্য জাতীয় ঐক্য হয় জাতীয় দুর্যোগের সময়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও চেতনা, যা আমাদের জাতিসত্তার ভিত্তি, তা নিয়ে রাজনীতিতে বিতর্ক ও বিভক্তি জাতির জন্য দুর্যোগের সমতুল্য। কেননা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাতিসত্তা পড়ে দুর্যোগের কবলে; সবকিছু তথা গণেশ উল্টানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সেই সম্ভাবনার কথা মনে রেখে আমাদের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে দেয়া ভাষণে ‘গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আর্থসামাজিক উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে সবার ঐকমত্য গড়ে তুলতে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের’ আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া সমৃদ্ধি স্থায়ী হবে না।’ এই সঙ্গে তিনি বলেছেন যে, ‘স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসঙ্গতকরণ এবং জাতীর অগ্রযাত্রা ও স্বপ্ন আকাক্সক্ষা সফল বাস্তবায়নে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।’ তিনি ‘গঠনমূলক সমালোচনায় এই সংসদ কার্যকার ও প্রাণবন্ত’ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।

যথাসময়ে রাষ্ট্রপতির যথাযথ এই আহ্বান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বলাই বাহুল্য নির্বাচন ও নতুন সরকার গঠনের পর বর্তমান দিনগুলোতে জাতি এই বিশেষ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। উন্নয়নে গতিসঞ্চারের জন্য অবকাঠামো রূপান্তরে বৃহৎ প্রকল্পগুলো দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সম্ভবমতো আরো বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।

দুর্নীতি চাঁদাবাজি সন্ত্রাস উগ্রজঙ্গিবাদ মাদক প্রভৃতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়নের যে অঙ্গীকার করেছে সরকার তা বাস্তবায়িত হলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অভিষ্ঠ লক্ষ্য অতিক্রম করা কঠিন কিছু নয়। উন্নয়নের অভিযাত্রায় জাতি এমন একটি সুযোগ ও সম্ভাবনার সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান করছে, যাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার লক্ষ্য অর্জন কোনো দিবাস্বপ্ন নয়।

প্রকৃত বিচারে সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারা যাবে কিনা এটাই আজ জাতির সামনে মস্ত চ্যালেঞ্জ। এটা বোধকরি নিতান্ত রাতকানা বা অন্ধ কিংবা বিশেষ উদ্দেশ্যে রঙিন চশমা পরা ব্যক্তি গোষ্ঠী মহল দল ছাড়া সবাই স্বীকার করবেন যে, ওপর থেকে রাজনৈতিক দল গঠন ও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার স্বার্থে যেভাবে ‘উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ ধরনের তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মসূচি বাস্তবায়নের কালচার চালু হয়েছিল, তা থেকে জাতি বিগত ১০ বছরে বের হয়ে এসেছে।

এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে বর্তমান, মধ্য ও সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন পরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রাকে সমন্বয় ও কার্যকর করার ধারা ক্রমেই শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো ক্ষমতাসীন দলের অর্থনৈতিক-সামাজিক অঙ্গীকার সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে জাতির কাছে তুলে ধরে রায়ও নেয়া হয়েছে। এর ফলে দেশবাসীর জীবন ও জীবিকায় উন্নতি শান্তি ও স্বস্তি ক্রমেই আরো বেশি বেশি করে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

এ কথা রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন যে, গণতন্ত্রের রয়েছে দুটো দিক। একটা রাজনৈতিক অপরটা অর্থনৈতিক-সামাজিক। কথা না বাড়িয়ে বলা যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির যথাযথ পথ ও গতি নিয়েই আমরা অগ্রসর হচ্ছি। কিন্তু রাজনীতির দিক বিচারে আমাদের সমস্যা ও সংকট সার্বিক বিবেচনায় পর্বতপ্রমাণ।

বলাই বাহুল্য গণতন্ত্রের রাজনৈতিক দিক সুষ্ঠু-অবাধ-গ্রহণযোগ্য ভোট, কার্যকর ও প্রাণবন্ত সংসদ, সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের যথেচ্ছ কর্মকাণ্ড দমন, সেবামুখী ও দক্ষ প্রশাসন, আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া, বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সমঅধিকার সুরক্ষা প্রভৃতির ভেতর দিয়ে প্রকাশিত ও বিকশিত হয়।

এসব ক্ষেত্রে আমরা আছি পিছিয়ে, সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার মধ্যে। উল্লিখিত সমস্যাগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, অতীতের জের। এই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমান সময়কালের বিশ্ব পরিস্থিতি। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, দেশে দেশে উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা ও অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, জোর যার মুল্লুক তার নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, আইন ও নৈতিকতার অধঃপতন হচ্ছে।

এক দেশ আরেক দেশের মধ্যে প্রকাশ্যে নাক গলাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ধরনের বিশ্ব পরিস্থিতিতে অতীতের এসব অশুভ জেরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক দিক থেকে গণতন্ত্রের সমস্যা আরো জটিল বিস্তৃত ও কঠিন হওয়াটাই স্বাভাবিক।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এই পর্বতপ্রমাণ সমস্যার দিকটি বিবেচনায় নিয়েই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ উল্লিখিত কথাগুলো বলেছেন। আমাদের এটা জানার মধ্যেই রয়েছে যে, সংসদীয় পদ্ধতিতে সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণ হচ্ছে সরকারেরই বক্তব্য। রাষ্ট্রপতির সংসদের এই ভাষণও তাই মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে।

তাই বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমান সরকার জাতীয় ঐকমত্যের কথা তুলে ধরে গণতন্ত্রের রাজনৈতিক দিক নিয়ে চলমান সমস্যাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছে। করণীয় বিষয়েও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা গণতন্ত্রের রাজনৈতিক দিককে বাধামুক্ত করে অগ্রসর করার পথে সরকারের ইতিবাচক অবস্থান।

এটা সবাই জানা আছে যে, অর্থনীতি যদি হয় বুনিয়াদি কাঠামো (বেসিক স্ট্রাকচার) তবে রাজনীতি হচ্ছে উপরি কাঠামো (সুপার স্ট্রাকচার)। দুটোই চলমান। তাই অর্থনীতি ও রাজনীতি পারস্পরিক জটিলতম ক্রিয়া প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। একটা অপরটার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে ধস অনিবার্য। এই দিক বিচারে সরকারের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি সঠিকভবেই বলেছেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া সমৃদ্ধি স্থায়ী হবে না।’

রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ইশতেহারে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় ঐকমত্য বিষয়ে কি লেখা রয়েছে, তা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। ‘আমরা বিভেদ, হানাহানি, জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাস, অবরোধ ও বিশৃঙ্খলার রাজনীতি চাই না’ কথাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করে ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।

উন্নতি ও সমৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় চারনীতির ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য সুনিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।’ ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠার গুরুত্বও যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐক্য চায়, কিন্তু রাষ্ট্রপতির ভাষণে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে জাতীয় ঐকমত্যের কথা। বলাই বাহুল্য জাতীয় ঐক্য হয় জাতীয় দুর্যোগের সময়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও চেতনা, যা আমাদের জাতিসত্তার ভিত্তি, তা নিয়ে রাজনীতিতে বিতর্ক ও বিভক্তি জাতির জন্য দুর্যোগের সমতুল্য।

কেননা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাতিসত্তা পড়ে দুর্যোগের কবলে; সবকিছু তথা গণেশ উল্টানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সেই সম্ভাবনার কথা মনে রেখে আমাদের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু হত্যা-ক্যু ও প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সামরিক শাসন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের নেতৃত্ব ও গণশক্তির দুর্বলতা- সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষাপটে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজমান, তাতে একদিনে বা এক ধাক্কায় ওই ধরনের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ।

উল্লিখিত ধরনের পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে এটাই বাস্তব সত্য। কিন্তু এর জন্য তো বসে থাকা চলে না। রাজনৈতিকভাবে যে ধরনের সমস্যা রয়েছে, যা অর্থনীতিকে এক সময় আঘাত হানবে বলেই মনে করা হচ্ছে। তাই উল্লিখিত ভিন্নতা নিয়েই অগ্রসর হতে হবে। প্রসঙ্গত, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি মানে সবারই উন্নতি।

সুখ-সমৃদ্ধির স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার ভেতর দিয়েই প্রকৃত বিচারে দল মত নির্বিশেষে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের মর্ম উপলব্ধি করানো সম্ভব এবং তাতেই ভবিষ্যতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করবে। তাই এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য।

যেসব রাজনৈতিক ইস্যু আমাদের চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করছে বা করতে পারে, তা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা আজ সময়ের দাবি এবং তা জরুরি। এই দিকটির প্রতি লক্ষ্য রেখেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ উল্লিখিতভাবে ‘বিরোধী দলকে গঠনমূলক ভূমিকা’ পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বলতেই হয় যে, বর্তমান সংসদে সংখ্যার দিক থেকে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল। কিন্তু এটাই বাস্তব, জনগণের চিন্তা-ভাবনায় বিরোধী দল এখনো বিএনপি। জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশী হয়ে নির্বাচন করায় সংসদে যত বিরোধিতাই করুক না কেন, ওই দলকে বিরোধী দল হিসেবে জনগণকে গ্রহণ করানো কঠিন হবে।

এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, যদি রাষ্ট্রপতির ভাষণ অনুযায়ী সংসদকে ‘কার্যকর ও প্রাণবন্ত’ করতে হয়, তবে বিএনপি ও গণফোরামের সদস্যদের শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপি এখনো আছে বিগত সময়ের মতো বয়কটের মধ্যে। আর গণফোরামের নির্বাচিতরা সংসদে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও নেতৃত্বের বাধায় তারা সংসদ যোগদানের পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।

তাই সংসদে বিরোধী দল বিষয়টা সমস্যা- সংকটের মধ্যেই থেকে যাচ্ছে। এখানে বলতেই হয় যে, বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে তীব্র অভিযোগ রয়েছে। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর যতটি নির্বাচন হয়েছে, সব নির্বাচনেই এ ধরনের অভিযোগ ছিল। ওই অভিযোগ নিয়েই বিরোধী দল প্রতিটি সংসদে যোগ দিয়েছে।

ইতোমধ্যে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে, সংসদ অধিবেশন চলছে। সর্বোপরি বিশ্বের সব দেশ বর্তমান সরকারকে অভিনন্দিত করেছে এবং সরকারের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। বিএনপি দলটি অতীতে এই সমালোচনার মধ্যে থেকে যেমন সরকার পরিচালনা করেছে, তেমনি অভিযোগ নিয়ে সংসদে গিয়ে বিরোধী দলে বসেছে।

ওইসব দিনগুলোর অভিজ্ঞতা বিএনপিকে কি পরামর্শ দিবে? সংসদ বয়কটের নাকি সংসদে যোগদানের? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতেই হয় যে, সাংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত কোনো সরকার বিশেষত উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম ও আওয়ামী লীগের মতো গণসমর্থিত দলের সরকারকে সরানো প্রায় অসম্ভব। এ বিষয়টা বিএনপির বোঝার কথা।

তাই যদি বিএনপি বয়কটের ধারা অব্যাহত রাখে, তবে আম ছালা দুই-ই হারানোর সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ দাঁড়াবে। আর ঘটনাচক্রে জাতীয় পার্টি যদি বিরোধী দল হিসেবে জনগণের আকাক্সক্ষা ও ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে, তবে বিএনপির জন্য তা চরম সর্বনাশের কারণ হবে।

এটা তো ঠিক যে, নির্বাচনে ভূমিধস পরাজয়টাই কেবল বিএনপির সমস্যা নয়। এই নির্বাচনে বিএনপির পরাজয় নির্ধারিত হয়েই ছিল। আসলে বিএনপির সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। সাংগঠনিক দিক থেকে দুর্নীতির রায়ে প্রধান নেতা খালেদা জিয়া জেলে, দ্বিতীয় নেতা ও কার্যকরী চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিচারে দণ্ডিত এবং প্রবাসে। এদিকে ‘হাওয়া ভবন’ খ্যাত এই ব্যক্তিটি মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগে অভিযুক্ত।

যদি প্রধান নেতার অপকর্মের জন্য অফিস আক্রমণ হয়, সেই নেতা কি কোনো সময় দলকে নেতৃত্ব দিতে পারে! নাকি ওই দল অগ্রসর হতে পারে! এই অবস্থায়ও বিএনপি দলটি হয়তো তারেককে পাল্টিয়ে সামাল দিতে পারত। কিন্তু বিএনপির রাজনৈতিক সমস্যা সাংগঠনিক সমস্যার চাইতে আরো গভীর ও জটিল।

বিএনপির একদিকে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত আর অন্যদিকে ড. কামালের গণফোরাম। যে ইতিহাস নিয়ে জিয়াকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বানিয়ে বিএনপি জনগণকে বিভ্রান্ত করে সঙ্গে রাখতে পেরেছিল, সেই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির এখন আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বস্তুতপক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও প্রেসিডেন্ট জিয়া নিয়ে বিএনপি বর্তমানে আছে শাখের করাতের মধ্যে।

সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত বিরোধিতার কার্ডও বাস্তবে অচল মালে পর্যবসিত হয়েছে। বিএনপি জামায়াতকে বাদ দিয়ে রাজনীতিতে যথাসম্ভব সংস্কার করে এবং সাংগঠনে তারেককে সরিয়ে সংসদে গিয়ে বিরোধী দল হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রেখে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।

সংসদে যোগ দিলে আইনি সুযোগ নিয়ে বিএনপি নির্বাচনের অভিযোগ কিংবা খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যু নিয়ে আন্দোলনে মাঠেও নামতে পারে। সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলনের সমন্বয় করা ছাড়া বিএনপির সামনে এখন আর অন্য কোনো বিকল্প নেই।

অতীতে হত্যা-ক্যুয়ের ফলে নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় এবং বাকশাল ও রুশ-ভারতের দালাল নিয়ে অপপ্রচারের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে বিপদে পড়া আওয়ামী লীগ কীভাবে উঠে দাঁড়িয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি শিক্ষা নিতে পারে। বিএনপি অতীত থেকে শিক্ষা নিবে নাকি বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিবে, এটাই এখন রাজনীতির সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

যদি নিজের পাকানো জট নিজে খুলে অগ্রসর হতে পারে বিএনপি তবেই কেবল দলটির ভাগ্য পরিবর্তিত হতে পারে। দলটি নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাইলে সংসদ কার্যকর ও প্রাণবন্ত হতে পারে। দেশবাসী চায় অর্থনীতির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজনীতির অগ্রগতি। চায় রাজনীতির সংকটের নিরসন। আর এই জন্য চায় জাতীয় ঐকমত্য।

‘বিরোধী দলকে সমালোচনায় বাধা দেব না’ বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলন কারার সর্বৈব সুযোগ করে দিয়েছেন। মানুষ তো অন্ধ বা রাতকানা নয়। নির্বাচনও প্রত্যক্ষ করেছে, এখনো সবকিছুই প্রত্যক্ষ করবে। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি জনগণের এই প্রত্যাশাকে পুঁজি করে আবারো মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা নিতে পারে। তাতে গণতন্ত্রের যেমন তেমনি বিএনপিরও লাভ। সেই কাজটা করতে কি পারবে বিএনপি, এটাই আজ জাতীয় রাজনীতির জ¦লন্ত প্রশ্ন।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App