×

জাতীয়

ভোগ্যপণ্যে ভেজালের মচ্ছব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৩:৫০ পিএম

ভোগ্যপণ্যে ভেজালের মচ্ছব
দেশে ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার কমতি নেই। অভাব নেই এ সংক্রান্ত আইনেরও। প্রতিনিয়ত ভেজালবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে র‌্যাব, বিএসটিআই কিংবা ভোক্তা অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবুও এখন পর্যন্ত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হয়নি কোথাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল খাদ্যের কারণে ক্রমাগতভাবে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন দেশের মানুষ। এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও সীমাহীন। ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবই এ অবস্থার কারণ বলে মনে করছেন তারা। গবেষণায় দেখা গেছে, জ্যাম-জেলি, দই-চিড়া থেকে শুরু করে মাছ-মাংস, মসলা, ফলমূল, শাক-সবজি সবখানেই ভেজালের ছড়াছড়ি। অন্যদিকে হোটেল-রেস্তোরাঁয় চলছে পচা, বাসি, অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশনের মচ্ছব। মুনাফার লোভে নীতি নৈতিকতার সবকিছুই উপেক্ষা করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। ২০১৭ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বিভিন্ন স্থান থেকে ৫ হাজার ১৪৬টি নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সংগৃহীত নমুনার ১ হাজার ৩৩৫টিতেই ভেজাল পাওয়া যায়। ওই পরীক্ষায় মিষ্টির ২২৪টি নমুনার মধ্যে ২২৩টিতেই ভেজাল শনাক্ত হয়। এ ছাড়া ডালডার ৮টি নমুনার সবই ছিল ভেজাল। শতভাগ ভেজাল পাওয়া যায় জ্যাম-জেলি, দই-লাচ্ছি, সন্দেশ, পাউরুটি, খেজুর এবং ছানাতেও। সয়াবিন তেলের মোট ১০৬টি নমুনা পরীক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে খাঁটি পাওয়া যায় মাত্র ৩২ শতাংশ নমুনা। এ ছাড়া গুড়ের ৭২, ঘিয়ের ৫০, চকোলেটের ৬৩ ও সেমাইয়ের ৬৮ শতাংশই ভেজাল প্রমাণ হয় পরীক্ষায়। দেখা গেছে, এসব নমুনার অনেকগুলোতেই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) মানচিহ্ন ছিল। মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমোদিত পণ্যে ভেজাল কীভাবে এলো এ প্রসঙ্গে বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) প্রকৌশলী এস এম ইছহাক আলী বলেন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট যেভাবে পরীক্ষা করেছে, বিএসটিআই সে পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে না। তাই ভিন্ন প্রতিবেদন আসতেই পারে। বিএসটিআইয়ের ল্যাবটি অ্যাক্রেডিটেশন সনদপ্রাপ্ত। এর প্রতিবেদনই সঠিক বলে দাবি করেন তিনি। তবে ল্যাবের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ল্যাবটি ১৯৫৩ সাল থেকে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থায়নে ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। ল্যাবটি অ্যাক্রেডিটেশন পাওয়ার অপেক্ষায় আছে বলে জানান তিনি। এর আগে এই ল্যাব থেকে ২০১৪ সালে ৩ হাজার ২৪৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ২ হাজার ১৪৭টিতেই ভেজাল পাওয়া যায়। ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৭৬টির মধ্যে ভেজাল পাওয়া যায় ২ হাজার ৩৭০টি নমুনায়। এ ল্যাবের প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই ভেজালের ভয়াবহতা আলোচনায় আসে বলে দাবি করেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুনিরুজ্জামান বলেন, সরকার খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ রহিত করে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ, পয়জনস অ্যাক্ট-১৯১৯, ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯ ইত্যাদি আইন রয়েছে। অন্যদিকে ভেজালমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিএসটিআই, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও ভেজাল খাদ্য বিক্রি বন্ধ হচ্ছে না কেন তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে ভেজাল বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন অনেকে। এ ক্ষেত্রে ভোক্তাদের সচেতনতাও জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, বিএসটিআইয়ের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। আবার এখানে দুর্নীতিও ভেজাল বন্ধের অন্যতম একটি প্রতিবন্ধকতা। তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে খাদ্যে ভেজাল রোধে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষগুলোকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। এখানে কর্তৃপক্ষের অভাব নেই। তবে কোন কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রকের ভ‚মিকা পালন করবে, সেটি আগে নির্বাচন করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল সে অনুযায়ী তারা কাজ করতে পারছে না বলে মন্তব্য করে এই পুষ্টিবিদ বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটি শুধু সচেতনতা নিয়ে কাজ করছে। এদিকে ভেজালবিরোধী অভিযানের মধ্যে সমন্ব^য় না থাকাও ভেজাল বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, অভিজ্ঞতা ছাড়া বা নিজস্ব ধারণার ভিত্তিতে অভিযান চালালে এ কাজের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। উদাহরণ দেখিয়ে তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে ফরমালিন ও কার্বাইডের অভিযোগ তুলে হাজার হাজার মণ আম ধ্বংস করেছিল একটি বাহিনী। কিন্তু আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি প্রাকৃতিকভাবেই আমে ফরমালিনের উপস্থিতি থাকতে পারে। আর কার্বাইড দিয়ে আম পাকানো হলেও তা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। বিশ্বের উন্নত দেশেও ফল পাকাতে কার্বাইড ব্যবহার করা হয়। ফলে এসব অভিযানে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অন্যদিকে অভিযানের কাজে ব্যবহৃত শক্তি মূলত অপচয় হয়েছে। ভেজাল খাদ্য বন্ধ করতে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ড. সরোয়ার হোসেন বলেন, ক্রমাগত ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে আমরা নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। এর মধ্যে সাময়িক মেয়াদে পেটের পীড়া, বমি ইত্যাদি হলেও দীর্ঘমেয়াদে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খাদ্যে ব্যবহৃত কেমিক্যাল ও ডায়িং রংয়ের কারণে আমাদের কিডনি ও লিভার স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক খাদ্যের মধ্যে ভারী উপাদান যেমন সীসা, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি থাকে, যা ক্যান্সারের উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এসব রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দেশে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আর্থিকভাবেও এর ক্ষতিকর দিক রয়েছে। কেননা, রোগীর চিকিৎসা ব্যয়ের পাশাপাশি মানুষের উপার্জন ক্ষমতাও এতে কমে যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App