×

জাতীয়

শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:৪২ এএম

শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে
টানা ১৮ দিন ধরে বিশেষ অভিযান চালানোর পরও রাজধানীর সড়কে কার্যত কোনো শৃঙ্খলা ফেরেনি। শুধুমাত্র কয়েক কোটি টাকা জরিমানা ও প্রায় এক লাখ মামলা দায়ের ছাড়া এই অভিযানে কোনো অর্জন নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ বলছে, পুরোপুরি না হলেও কিছু সাফল্য রয়েছে এই অভিযানে। এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবীব ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের সড়কে অব্যবস্থাপনা ও অরাজকতার কারণ হচ্ছে লাইসেন্সবিহীন চালক, লক্কড়-ঝক্কড় ফিটনেসবিহীন গাড়ি, নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস না থামানো বা বাসের জন্য নির্দিষ্ট স্টপেজ তৈরি না করা, বাসের জন্য আলাদা লেন না থাকা এবং চুক্তিভিত্তিক চালক নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক অব্যবস্থা তৈরি করা। যার ফলে একটি নির্দিষ্ট টাকা কামানোর জন্য ওই ব্যক্তি যাত্রীদের টানাহেঁচড়া করে বাসে উঠাচ্ছে। কিন্তু সম্পতি একটি দৈনিকে পড়লাম, ট্রাফিক আইন না মানায় এক দিনে ২৪ লাখ টাকা জরিমানা ও ৫ সহস্রাধিক মামলা করেছে। এর বেশির ভাগ জরিমানা ছিল উল্টোপথে গাড়ি চালানোর দায়ে। আসলে সড়ক শৃঙ্খলার মূল বিধি-বিধানগুলোতে গুরুত্ব না দেয়ায় অরাজকতা থামছে না। এটি করতে গেলে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হবে, তাই কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অর্থাৎ পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ না নেয়ায় সড়ক ব্যবস্থাপনায় যথার্থ ফল আসছে না। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের উদ্যোগে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ’র কার্যক্রম শুরু হয়। ট্রাফিক আইন অম্যান্যকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান, গুরুত্বপূর্ণ ৩০টি ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে পথচারীদের উদ্বুদ্ধ করা, নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া বাস না থামানো, চলন্ত বাসের দরজা বন্ধ রাখাসহ ১৩ ধরনের কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা দেয়া হয় ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষে। এই কার্যক্রম ৩১ জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরে তা বাড়িয়ে ২ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত করা হয়। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানায়, গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৬ দিনে ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ চলাকালে মামলা হয়েছে ৯৫ হাজার ৮৩৫টি। জরিমানা করা হয়েছে ৪ কোটি ৯২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫০ টাকা। অভিযান চলাকালে গত দুদিন মালিবাগ, মগবাজার, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মহাখালী, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, কাকরাইল, পল্টনমোড়সহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ডিএমপির চিহ্নিত করে দেয়া নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামেনি, যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো ও নামানো হয়। চলাচলের সময় অধিকাংশ বাসের দরজা খোলা থাকে। যাত্রী ওঠাতে কে কার আগে যাবে এ নিয়ে বাস চালকদের বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। চলন্ত বাসে চালককে মোবাইল ব্যবহার করতেও দেখা যায়। অন্যদিকে জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার না করে পথচারীদের যত্রতত্র রাস্তা পারাপার হতে দেখা যায়। ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও পথচারীদের দেখা যাচ্ছে নিচ দিয়ে রাস্তা পার হতে। এ ছাড়া সড়কে রংচটা লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি, থ্রিহুইলার, ব্যাটারি চালিত রিকশা আগের মতই চলতে দেখা যায়। আবার ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়তে দেখা যায়। সড়কে যানজট সৃষ্টি হলে ফুটপাত চলে যায় মোটরসাইকেল চালকদের দখলে। সব মিলিয়ে সড়কে নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা চলছে আগের মতই। ট্রাফিক বিভাগের ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ’ সড়ক পরিস্থিতি উন্নয়নে অবদান রেখেছে সামান্যই। এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, অভিযানে কিছু কিছু সাফল্য এসেছে। তবে চালকসহ সাধারণ মানুষ অভ্যাস পরিবর্তন না হলে সড়কে পুরোপুরি শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়। তবে নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার কারণে মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে সচেতনতা বাড়ছে। মোটরসাইকেল চালকসহ আরোহীরা এখন সবাই হেলমেট ব্যবহার করছেন। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারও অনেকগুণ বেড়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) এ এম মুরাদ আলী ভোরের কাগজকে বলেন, সড়কে পুরোপুরি শৃঙ্খলা আসেনি। তবে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। মোটরসাইকেলের আরোহীরা এখন হেলমেট ব্যবহার করছে। চলাচলের সময় বেশিরভাগ গাড়িতে লক থাকে। আবার কিছু কিছু চালক আছে যারা ট্রাফিক পুলিশের চোখের আড়াল হলেই লক খুলে যত্রতত্র যাত্রী তুলছে। পথচারীরা জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করতেই চান না, ঠেলে পাঠাতে হয়। ফুটওভার ব্রিজে উঠতে চান না, পথচারীদের বাধ্য করতে হয়। মূলকথা হচ্ছে, মানুষের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতা বেশি। চালকসহ সাধারণ মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন না হলে সড়কে পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। আমরা অনেক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। কিছুটা হলেও মানুষ সচেতন হয়েছে, দিন দিন এটা বাড়বে। ওই কর্মকর্তা বলেন, কিন্তু এবার সড়কে যানজটের কারণটা ভিন্ন। ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের সোনারগাঁও থেকে মেট্রোরেলের কাজ চলছে। মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের জন্য মূল সড়কের প্রায় ৩৬ ফিট জায়গায় গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। এ কারণে যানজট বেড়েছে। যে গাড়িগুলো গাবতলী হয়ে ফার্মগেটে আসত কিংবা উত্তরা থেকে ফার্মগেট হয়ে আসত, সেই গাড়িগুলোর রুট পরিবর্তন করে কোনোটা মহাখালী হয়ে মগবাজার দিয়ে আবার কোনোটা মিরপুর হয়ে নিউমার্কেট দিয়ে যাতায়াত করছে। উন্নয়ন কাজের কারণে কোনো কোনো সড়কে চাপ বেড়েছে। এ ছাড়া রাস্তার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেশি আছে। অন্যদিকে ফিটনেস বিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান ও ডাম্পিং চলছে। যাত্রী ও চালকরা যা বললেন : ঢাকা কলেজের ছাত্র বাসযাত্রী মুহম্মদ রাইয়ান বলেন, ঢাকার যাত্রীবাহী বাসগুলোর কন্ডিশন খুবই খারাপ। ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতার মধ্যেই রঙচটা ও লক্করঝক্কর গাড়ি চলছেই। যত্রতত্র যাত্রী উঠানো হচ্ছে। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনের ব্যবহার না করার কথা থাকলেও চালক তা করছে। কে কার আগে যাবে, পাল্লা দিয়ে প্রতিনিয়তই চালকদের বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে দেখা যায়। যার ফলে দুর্ঘটনাও ঘটছে। বলা যায়, সবকিছু আগের মতই আছে। তবে মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু পাঠাও, উবার, ওভাইসহ বিভিন্ন রাইড শেয়ারিংয়ের কারণে রাস্তার মোটরসাইকেলের মাত্রা বেড়েছে। বাইকচালকদের বেপরোয়ার চালনার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এখনই এদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে প্রাইভেটকার চালক মো. রশীদ বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাস চালকদের নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ কার্যক্রমের মধ্যে বাস চালকদের বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে দেখি। কে কার আগে যাবে এমন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো আগের মতই আছে। গুলশান-২ ছাড়া রাজধানীর সকল গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে যানজট আছেই। এ ছাড়া পথচারীরা জেব্রা ক্রসিং মানছে না। সব কিছু আগের মতই আছে। শুধু মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এখন সবাই হেলমেট পড়ছে। আরেক প্রাইভেটকার চালক মো. মিরাজ বলেন, বেপরোয়া বাস চালকদের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে সড়কে শৃঙ্খলা আসবে না। বাস চালকদের কারণে সড়কে যানজট কমছে না। অবৈধ রিকশাও যানজটের অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ কার্যক্রমের মধ্যেও মগবাজার, বাংলামটর, কারওয়ান বাজার, রামপুরা রোড, এয়ারপোর্ট থেকে খিলক্ষেত, ফার্মগেট, কাকরাইল, বিজয়নগর রোডসহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট যানজট লেগে থাকে। আজ (শনিবার) এফডিসি থেকে বসুন্ধরা পর্যন্ত যেতেই আড়াই ঘণ্টা লেগেছে। এভাবে প্রতিদিন সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে সময় অপচয় করতে হয়। রাব্বী আহমেদ নামের আরেক যাত্রী বলেন, দুএকটি ছাড়া বেশির ভাগ ফুটওভার ব্রিজে ময়লা, আবর্জনা ও নেশাখোরদের আখড়া। আবার যেগুলো উপযোগী রাতে সেগুলোতে আলো না থাকায় পথচারীরা ছিনতাইয়ের ভয়ে উঠতে চান না। এগুলো ঠিক হওয়া উচিত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App