×

জাতীয়

আত্মসমর্পণের নামে আইওয়াশ?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:৫৫ এএম

আত্মসমর্পণের নামে আইওয়াশ?
দেশে যতই ইয়াবার প্রসার ঘটতে থাকে; ততই ধনীর সংখ্যা বাড়তে থাকে টেকনাফে। কে কত ধনী হবেন এমন প্রতিযোগিতাও হয়তো চলে। আর ধনী হওয়ার নেশায় অনেকে সপরিবারেই যুক্ত হন মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আনার কাজে। কিন্তু গত ৪ মে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর পাল্টে যায় সব হিসাব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে গা ঢাকা দেন অনেকেই। এই সুযোগে ভেঙে দেয়া হয় অর্ধশত ইয়াবা ব্যবসায়ীর প্রাসাদতুল্য বাড়ি। এরপর থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে থাকেন তারা। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবুজ সংকেতে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন শতাধিক ইয়াবা গডফাদার। এদের মধ্যে ৭৫ জন বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে আছেন বলে একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু শীর্ষ ৭৫ জন গডফাদার পুলিশ হেফাজতে থাকার পরও বন্ধ হয়নি টেকনাফের ইয়াবার চালান। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, টেকনাফের বেশ কয়েকটি পরিবারের প্রায় সব সদস্যই এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ওইসব পরিবার থেকে এক অথবা দুইজন সদস্য আত্মসমর্পণ করছেন। এতে সবাই ভাবছেন, পরিবারের যে সদস্য ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত তিনিই হয়তো আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশ হেফাজতে গেছেন। এই সুযোগে বাকিরা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছেন ইয়াবা ব্যবসা। কেউ কেউ নিজের সিন্ডিকেট অন্যকে বুঝিয়ে দিয়ে আত্মসমর্পণের নামে আইওয়াশ করছেন। আবার তালিকায় নাম থাকার পরও অনেকে সবদিক ‘ম্যানেজ’ করে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে এখনো বন্ধ হচ্ছে না ইয়াবার চালান। এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, টেকনাফের ৮০ শতাংশ মানুষই ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে গেছে। এদের মধ্যে ২০-২৫টি পরিবার একেবারেই বেপরোয়া। শিশু ছাড়া ওইসব পরিবারের প্রায় সব সদস্যই ইয়াবার চালান আনার সঙ্গে জড়িত। পুলিশের তালিকাতেও নাম আছে সবার। ওইসব পরিবারের মাত্র দুয়েকজন সদস্য আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেও অধিকাংশই এখনো পলাতক রয়েছে। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শেষে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেই তারা এলাকায় ফিরে আবারো নেমে পড়বে পুরনো ব্যবসায়। কারণ অল্পতে কোটি কোটি টাকা কামানোর পথটা তাদের জানাই রয়েছে। এ অবস্থায় তালিকায় থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সপরিবারে আত্মসমর্পণের দাবি তুলেছেন স্থানীয় সুধীসমাজ। সেই সঙ্গে পুরো পরিবারের যে সম্পদগুলো ইয়াবার টাকায় গড়ে উঠেছে সেগুলো দ্রুত জব্দ করারও দাবি জানিয়েছেন তারা। বিশেজ্ঞরা বলছেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এখনো তৎপর থাকায় দেশে ইয়াবা প্রবেশ করছে। এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্য অভিযুক্ত পরিবারগুলোর এক বা একাধিক সদস্য আত্মসমর্পণ করে আইওয়াশের আশ্রয় নিতে পারে। তবে পুলিশ বলছে, কোনো ধরনের ছলনায় কাজ হবে না। আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। করলে ভালো কথা। না করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সর্বশেষ ১ হাজার ১৫১ জনের যে তালিকা করা হয়েছে তার মধ্যে ৯ শতাধিক ব্যবসায়ীই টেকনাফের। সেই তালিকা অনুযায়ী, ইয়াবা ব্যবসায় সাবেক এমপি আবদুর রহমানের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। তার ৫ ভাইসহ মোট ২৬ জন নিকটাত্মীয়ের নাম রয়েছে তালিকায়। কিন্তু আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশের হেফাজতে গেছেন মাত্র ৫ জন। তারা হলেন বদির তিন ভাই যথাক্রমে শফিকুল ইসলাম প্রকাশ শফিক, আবদুল আমিন, ফয়সাল রহমান ও বদির ভাগিনা সাহেদ রহমান নিপু এবং বেয়াই শাহেদ কামাল। বাকিরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারাও আত্মসমর্পণ করবেন কিনা এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দেননি বদি। তালিকায় অন্যতম গডফাদার হিসেবে নাম রয়েছে টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ ও তার ছেলে মোস্তাক মিয়া, দিদার মিয়া এবং সদর ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি শাহজাহান মিয়ার। এদের মধ্যে মোস্তাক ২০১২ সাল থেকে নিখোঁজ। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় রয়েছেন শুধুমাত্র দিদার। আত্মগোপনে রয়েছেন শাহজাহান মিয়া। আর টেকনাফে প্রকাশ্যে ঘুরছেন জাফর আহমেদ। গত ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় টেকনাফে আওয়ামী লীগের সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। আরেক পৃষ্ঠপোষক শীলবনিয়ার হাজি সাইফুল করিম (৩৮)। তার ভাই রেজাউল করিম ও তাদের ভগ্নিপতি সাইফুল ইসলামেরও (৪২) নাম আছে তালিকায়। রেজাউল করিম পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলেও দুবাই পালিয়ে গেছে সাইফুল করিম। তার আত্মসমর্পণের কথা থাকলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে সাইফুল ইসলাম। এ ছাড়াও মিঠাছড়ির ইউনুচ ভুট্টো (৪২) ও তার ছোট ভাই নুরুল আজিম (২৬), বাজারপাড়ার সাবেক পুলিশ ইন্সপেক্টর আবদুর রহমানের ছেলে সায়েদুর রহমান নিপু, নিপুর মা শামছুন্নারও রয়েছেন ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায়। তাদের মধ্যে থেকেও একজন করে আত্মসমর্পণ করতে পারেন বলে জানা গেছে। এ ধরনের আরো বেশ কয়েকটি পরিবারের এক বা দুইজন করে কারবারি কৌশল হিসেবে আত্মসমর্পণের আওতায় আসতে পারেন। এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, সংশোধনকে মাথায় রেখে সরকার আত্মসমর্পণের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অবশ্যই ভালো দিক। তবে, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তাদের সিন্ডিকেটে বা পরিবারের এক বা দুইজনের আত্মসমর্পণের নামে আইওয়াশের আশ্রয় নিতে পারে। তাই ইয়াবাকে কেন্দ্র করে পরিবারকেন্দ্রিক বা সিন্ডিকেট কেন্দ্রিক যে বাণিজ্যিক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে তাদের সবাইকেই আইনের আওতায় আনতে হবে। না হলে ইয়াবার চালান সহজে বন্ধ হবে না। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ভোরের কাগজকে বলেন, এভাবে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সবাইকে আইনের আওতায় আসতে হবে। সরকার আত্মসমর্পণের সুযোগ করে দিচ্ছে। এখন আত্মসমর্পণ করলে মোস্ট ওয়েলকাম। না করলে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App