×

মুক্তচিন্তা

ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি আদায় করার সক্ষমতা বিএনপির নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:০৩ পিএম

বিরোধী রাজনৈতিক দল জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যুতেই আন্দোলনের কর্মসূচি না দেয়ায় তাদের প্রতি মানুষের সমর্থন নেই। বিরোধী দলকে দেশের রাজনীতিতে দৃশ্যমান অবস্থান তৈরি করতে হলে বাস্তবায়নযোগ্য দাবি-দাওয়া নিয়েই অগ্রসর হতে হবে। নির্বাচন বাতিল বা নতুন নির্বাচনের দাবিতে যতই শোরগোল করা হোক না কেন, এখনকার জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আদায় করা যাবে না। ভবিষ্যতে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক কীভাবে দূর করা যাবে সে পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করাই হওয়া উচিত এখনকার রাজনীতি।

প্রধানমন্ত্রীর চায়ের দাওয়াতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ছয় মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে তারা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির নতুন নির্বাচনের দাবিকে হাস্যকর বলে নাকচ করে দিয়েছেন। নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হয়েছে।

নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক ও প্রশ্ন থাকলেও সরকারকে ‘অবৈধ’ হিসেবে অগ্রহণযোগ্য বলে দেশের সাধারণ মানুষ কিংবা দেশের বাইরে কেউ খারিজ করে দিচ্ছে না। কিন্তু বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এবং বিএনপিমনা বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচনকে তামাশা হিসেবে উল্লেখ করে প্রচারণা চালিয়ে নতুন নির্বাচনের দাবি তুলছেন। এই দাবি আদৌ আদায়যোগ্য কিনা সেটা তারা বিবেচনায় নিয়েছেন কিনা সে প্রশ্নটা সামনে আসছে। বিএনপি অতীতে কখনোই কোনো দাবি আদায় করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ তারা দাবি তুলেছে, কিন্তু দাবিটা আদায় করার সক্ষমতা তাদের আছে কিনা সেটা ভেবে দেখেনি।

এবারো নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবির পর দিশেহারা বিএনপি আন্দোলনের কথা বলে কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করতে চাইছে ঠিকই কিন্তু আন্দোলনের বাস্তবতা দেশে না থাকায় কেউই উৎসাহবোধ করছে না। এ অবস্থায় সরকারের সঙ্গে এক ধরনের ‘সমঝোতা’ করে অগ্রসর হওয়াই কৌশল হিসেবে উত্তম হতো বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখালেও বিএনপি নিয়েছে অনমনীয় মনোভাব। বিএনপি কি অনমনীয় থেকে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারবে?

নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কিনা তা নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনও একমত হতে পারছে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা নির্বাচন সুন্দর, সার্থক ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে মনে করলেও আরেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলছেন ভিন্ন কথা।

মাহবুব তালকদার বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কিনা সেটা নিয়ে পাবলিক পারসেপশন কী তা নিজেদের কাছেই জিজ্ঞেস করতে হবে। মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছেন বলে অনেকের কাছে মনে হচ্ছে। তিনি প্রায়ই প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে কথা বলেন তার উল্টোটা বলেন। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের যারা প্রধান ব্যক্তি তাদের মধ্যে মতের অমিল হওয়ার খবর আগে কখনো শোনা যায়নি। সব নির্বাচন কমিশনার সব ইস্যুতে একমত হবেন তা কেউ আশা করেন না। কিন্তু ভিন্ন মতের কথাটি বাইরে প্রকাশ করার ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।

নির্বাচন কমিশনের এই মতবিরোধ বা মতপার্থক্য সাধারণ মানুষের কাছেও অস্বস্তিকর মনে হলেও নির্বাচন কমিশন নির্বিকার বলে মনে হচ্ছে। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এভাবে চলতে পারে কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সে কমিশনেই যদি মতবিরোধ বা মতপার্থক্য থাকে তাহলে সেটা কি মানুষের মধ্যে খুব ভালো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে? মাহবুব তালুকদার যদি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনো ইস্যুতেই একমত হতে না পারেন তাহলে তিনি পদ আঁকড়ে আছেন কেন?

দুই. গণফোরাম তাদের দুই সংসদ সদস্য নিয়ে বড় ঝামেলায় আছে। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত গণফোরাম দুটি আসন লাভ করে। গণফোরামের প্রতিষ্ঠার পর একাদশ সংসদে তাদের দুটি আসনলাভ সবচেয়ে বড় অর্জন। কিন্তু নির্বাচিত দুজন সংসদ সদস্য নিয়ে গণফোরাম ঝামেলায় আছে। বিএনপি তাদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথগ্রহণের বিরুদ্ধে। তারা সংসদেও যোগদান করতে চায় না। কামাল হোসেন ব্যক্তিগতভাবে তাদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথগ্রহণের পক্ষে থাকলেও বিএনপির চাপে তাকেও সংসদে না যাওয়ার পক্ষেই মত দিতে হচ্ছে। কিন্তু গণফোরামের নির্বাচিত দুই এমপি, সংসদে যেতে চান, শপথও গ্রহণ করতে চান। এ নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম বিরোধ।

গণফোরামের দুই এমপির একজন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। তিনি বলেছেন, দল বিরোধিতা করলেও তিনি সংসদে যাবেন। তিনি বলেছেন, সারা দেশে কি হয়েছে তা না দেখে আমি আমার নিজের এলাকায় যে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে সেটা স্বীকার করতে চাই। আমার ভোটারদের আমি বঞ্চিত করতে পারব না। তারা আমাকে ভোট দিয়েছে সংসদে যাওয়ার জন্য, না যাওয়ার জন্য নয়। এখন নির্বাচিত হয়ে সংসদে না যাওয়াটা ভোটারদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণার শামিল। গণফোরাম সংসদের না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও সুলতান মনসুর সংসদে যাবেন।

গণফোরাম সুলতান মনসুরকে নিজেদের সদস্য হিসেবে দাবি করলেও সুলতান মনসুর বলছেন, তিনি ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী’। গণফোরামের অরেক এমপি মোকাব্বির খানও সংসদে যেতে আগ্রহী। তবে দলের সিদ্ধান্তও তিনি অমান্য করতে চান না। তাহলে এ দুই সংসদ সদস্য নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি গণফোরাম কীভাবে করবে? গণফোরাম থেকে কি এ দুজন বেরিয়ে যাবে? বেরিয়ে গেলে কি তাদের সংসদ সদস্য পথ বহাল থাকবে? নাকি আবার নির্বাচিত হয়ে আসার ঝুঁকি তাদের নিতে হবে?

তিন. দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন আওয়ামী লীগের হাতে। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ যে অবস্থায় গিয়েছে তাতে বিরোধী দল কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু এটা গণতন্ত্রের জন্য কোনোভাবেই স্বস্তিদায়ক নয়। সংসদে এক দলের আধিপত্য থাকলে সংসদ কার্যকর হয় না। সে জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইছেন, বিএনপি ও গণফোরামের সদস্যরা সংসদে গিয়ে কথা বলুক। প্রধানমন্ত্রী তাদের সমালোচনায় বাধা না দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। সংখ্যায় কম হলেও বিরোধী দলের ন্যায্য সমালোচনার মূল্যায়ন করা হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। আমাদের দেশে বিরোধী দল গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে সরকারের সমালোচনা করতেই বেশি পছন্দ করে।

ভালো কাজের পক্ষে, মন্দ কাজের বিরুদ্ধে- এই নীতিতে বিরোধী দল চলতে চায় না। দেশের মানুষের মধ্যেও সরকারবিরোধিতার প্রবণতা প্রবল। তবে বিরোধী দলের প্রতি আস্থা না থাকার কারণেই মানুষ কিছুটা নিস্পৃহ হয়ে আছে। অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ থাকলেও তার কোনো বহিঃপ্রকাশ নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দল জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যুতেই আন্দোলনের কর্মসূচি না দেয়ায় তাদের প্রতি মানুষের সমর্থন নেই। বিরোধী দলকে দেশের রাজনীতিতে দৃশ্যমান অবস্থান তৈরি করতে হলে বাস্তবায়নযোগ্য দাবি-দাওয়া নিয়েই অগ্রসর হতে হবে।

নির্বাচন বাতিল বা নতুন নির্বাচনের দাবিতে যতই শোরগোল করা হোক না কেন, এখনকার জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আদায় করা যাবে না। ভবিষ্যতে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক কীভাবে দূর করা যাবে সে পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করাই হওয়া উচিত এখনকার রাজনীতি।

বিভুরঞ্জন সরকার: কলাম লেখক ও সাংবাদিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App