×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতির রিকনসিলিয়েশন প্রস্তাবনা ও বাস্তবতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:৩২ পিএম

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীপক্ষকে শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারলে রিকনসিলিয়েশন সম্ভব। আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বিরাজমান বিভাজন যেমন, দুই তিনটি শিক্ষাব্যবস্থা, এগুলো আধুনিকায়ন করা, মুক্তিযুদ্ধ চেতনামুখী করা। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক পরিম-ল আরো উদার করা। গণমাধ্যম, গণতন্ত্র চর্চা, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের চর্চা বাড়ানো।

রিকনসিলিয়েশন শব্দটি একটি বিজনেস টার্ম। অ্যাকাউন্টিং বিভাগে ব্যাংক রিকনসিলিয়েশন নামে একটি অ্যাকাউন্ট করা হয়। অর্থাৎ কোম্পানিতে যেসব খাতাপত্র রেকর্ড রাখা হয় এবং টাকাপয়সা লেনদেন করা হয়, সেগুলো এক পর্যায়ে ব্যাংকের স্টেটমেন্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। এটাকে বলা হয় ব্যাংক রিকনসিলিয়েশন।

রিকনসিলিয়েশন শব্দটির দুটি অর্থ। প্রথমত, মিলিয়ে দেখা, আরেকটি হচ্ছে মিটমাট বা মীমাংসা করা। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী গত ২৫ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে ভাষণে রাজনীতিতে যে রিকনসিলিয়েশনের কথা বলেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে কিংবা গুরুত্ব দিতে হবে।

এক. আমাদের রাজনীতিতে আলোচ্য বিষয়গুলো মিলিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিষয়গুলো কিসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে? ১৯৭১ সালে আমরা যেসব লক্ষ্য এবং আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সেসব লক্ষ্য এবং আদর্শ থেকে আমাদের রাজনীতি বা সমাজ আজ কোথায় অবস্থান করছে? এগুলো মিলিয়ে দেখতে হবে।

অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য এবং আদর্শ থেকে বর্তমান রাজনীতি বা সমাজের ব্যবধান খুঁজে বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের সামনে অনেক বিরোধপূর্ণ বিষয় সামনে আসবে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময়, মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নানা ইস্যু, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ের রাজনীতি, সংবিধানের মৌলিক বা প্রধান স্তম্ভ যেমন- ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, আমাদের বাঙালিত্ব এবং জাতীয়তাবাদসহ অনেক কিছু।

এসব বিষয়ে রাজনীতিতে যে ব্যবধান রয়েছে, তা মিটিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভাবনার বিষয় হলো, এই মিটমাট বা মীমাংসা কীভাবে হবে? অনেকে মনে করেন, আমাদের রাজনীতিতে এই ব্যবধান ১৯৭৫ সালের পর থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, রাজনীতিতে এই বিভাজন ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু হয়নি। বরং ভারত বিভাগের আগেও এসব ব্যবধান ছিল।

আমাদের রাজনীতিতে দুটি ধারা ব্যাপকহারে পরিলক্ষিত। একটি হচ্ছে ধর্মাশ্রয়ী ভাবধারার রাজনীতি। অর্থাৎ ধর্মকে আশ্রয় করে রাজনীতি করা। যতই বলি না কেন, আমরা এক সময় অসাম্প্রদায়িক ছিলাম। কিন্তু বিষয়টি সত্য বলি না। কারণ সাম্প্রদায়িকতাকে কেন্দ্র করে আমাদের পূর্ব পুরুষরা ভারতকে ভাগ করেছে। ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দু এবং মুসলমান নামে দুটি স্বতন্ত্র জাতি সৃষ্টি করা হয়েছে।

পরবর্তী পর্যায়ে যা আমরা মেনে নিয়েছি। পূর্ব পুরুষরা অনেক অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, যা আমি বিশ্বাস করি না। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি, পরবর্তী পর্যায়ে ধীরে ধীরে ধর্ম বড় রূপ ধারণ করে। যা পাকিস্তান আমলেও ছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও একই রাজনীতি ছিল।

১৯৭১-এর আগ পর্যন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিরোধিতা থেকে শুরু করে ছয় দফা, এমনকি ভাষা আন্দোলনেরও বিরোধিতা ছিল। আর এই বিরোধী শক্তি পুরোটাই ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। রাজনীতিতে তাদের প্লাটফর্মই হচ্ছে ধর্ম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রগতিশীল সবকিছুর বিরোধীতা করা।

বর্তমানে বলা হচ্ছে দেশের শক্তিশালী একটি বিরোধী দল হচ্ছে বিএনপি। কিন্তু সেই বিএনপি নামক দলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মাশ্রয়ী ভাবধারার লোকজন এবং মুসলিম লীগ ঘরানার মতাদর্শের সমন্বয়ে। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভারত বিরোধিতা। তবে এবার ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি মজার ঘটনা ঘটেছে।

আমাদের ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো সবসময় নির্বাচনের সময় প্রধান ইস্যু হিসেবে ভারত বিরোধিতাকে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে। আমরা যদি ১৯৫৪ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১-পরবর্তী সব নির্বাচনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে ধর্ম এবং ভারত বিরোধিতা প্রধান ইস্যু হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

কিন্তু এবার নির্বাচনে এগুলো ইস্যু হিসেবে কাজ করেনি। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, রাজনীতিতে এবার এগুলোর মীমাংসা হয়েছে। বিএনপি যদি রিকনসিলিয়েশন করে দেখে, বিএনপির নির্বাচনে ভোটে হারার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে ওই বিষয়গুলো ইস্যু হিসেবে না আসা। ভারতবিরোধিতা করা এবং ‘ইসলাম চলে গেল’ না বলাই তাদের পরাজয়ের কারণ।

মূলত এ জন্য তাদের ভোট কমে গেছে। তারা যদি মনে করে ধর্ম এবং ইসলাম ইস্যু না হওয়ায় তাদের ভরাডুবি হয়েছে। তাহলেই সর্বনাশটা হবে। তারা যদি ভাবে এগুলো আর ইস্যু হচ্ছে না, তাহলে রিকনসিলিয়েশন হবে। বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির উৎপত্তি তথা জন্মগতভাবে সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি।

তারা ধর্মকর্ম করুক বা না করুক, তারা ইসলামকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। ধর্ম চলে যাবে, এগুলো ছিল অতীতে তাদের শাশ্বত স্লোগান। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রথম গঠনতন্ত্রে উল্লেখ ছিল, রাষ্ট্র হচ্ছে ইহজাগতিক আর ধর্ম হচ্ছে পরজাগতিক। জন্মগতভাবে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক।

তারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। বলা হয়ে থাকে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা নাকি ভারত থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি নিয়ে এসেছি। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ নিয়ে যাই বলা হোক না কেন, ভারতের আগে আমাদের এখানে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ছিল। ভারতের সংবিধানে বরং আমাদের পরে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করা হয়েছে।

আমরা ১৯৭২ সালের সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করি। অর্থাৎ রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। কোনো ধর্মকে ছোট-বড় করে দেখবে না। পরবর্তী পর্যায়ে সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতায় এসে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন। কাজেই রিকনসিলিয়েশন করতে হলে সব মিটমাট করতে হবে।

আমাদের সংবিধানে মূল চেতনা, ধর্ম হচ্ছে একটি পরজাগতিক বিষয়। কাজেই সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মকে কি নামে আনতে চান, সেই বিষয়ে নাম আগে ভাবতে হবে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে দেশে বিরাট গোষ্ঠীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে দেয়া হয়েছে। বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর মীমাংসায় আসতে হবে।

বিষয়গুলোর মিটমাট না করে রিকনসিলিয়েশন করলে ফাঁকফোকর থেকেই যাবে। আমাদের রাজনীতিতে মীমাংসার তিনটি জায়গা। এক. একাত্তর। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধী ছিল। ইতোমধ্যে আমরা দাগী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করেছি। আর যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করে মানুষের জানমালের ক্ষতি করেছে, এমন বাকিদের বিচার আমাদের করতে হবে।

দ্বিতীয়, ১৯৭৫ সালে যারা জাতির পিতাকে খুন করেছে, তাদের বিচারও হয়েছে। আমাদের রাজনীতিতে তৃতীয় আর বড় একটি ক্ষত হচ্ছে ২০০৪ সালে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা। এ ঘটনারও একটি বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যারা মূলহোতা তাদের শাস্তি দেয়া হলো।

এখন সেই শাস্তি কার্যকর বাকি। এর মাধ্যমে আমাদের রাজনীতিতে তিনটি বড় ক্ষত মীমাংসা করার অর্থাৎ মলয় দেয়ার কাজটি আংশিক সম্পন্ন হয়েছে। সেগুলো ইতোমধ্যে একটি পর্যায়ে চলে এসেছে। এ বিষয়গুলো নিষ্পত্তির মাধ্যমে রিকনসিলিয়েশন হতে পারে। এগুলোর মীমাংসা হলে আমাদের প্রধান ইস্যু হবে উন্নয়ন।

এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন নিয়ে অবশ্যই বিতর্ক থাকবে। বর্তমান সরকার যেভাবে উন্নয়ন করতে চাচ্ছে, সেটাই সবচেয়ে ভালো পন্থা বা ব্যবস্থা, সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন করার পদ্ধতি, মাদক নির্মূল পদ্ধতির অন্যান্য বিকল্প ব্যবস্থাও রয়েছে, এগুলোই যে ভালো পদ্ধতি এমনটি বলা যাবে না।

এর চেয়ে অনেক ভালো পরামর্শ আসতে পারে কিংবা বিকল্প পদ্ধতি আসতে পারে, আরো সহজ পদ্ধতি আসতে পারে। সেগুলো নিয়ে বিতর্ক করা দরকার। পুরনো যে বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক করি, সেগুলোর মীমাংসার পথে। বর্তমানে পৃথিবীর এমন দেশ নেই, যেখানে স্বাধীনতার এত বছর পরও বিরোধী শক্তি সব সময় সক্রিয় আছে, কিংবা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কারণে ওই রকম একটি শক্তি থেকেই যাবে, এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই, জাতির সামনে এরকম একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করার জন্য। এটি বাস্তবায়নের জন্য দুটি পদ্ধতি হতে পারে। একটি হচ্ছে ৮০ শতাংশ সুতা এবং ২০ শতাংশ পলিস্টার মিলিয়ে কাপড় বুনা। এ ক্ষেত্রে একটি হচ্ছে ২০ শতাংশ পলিস্টারকে পুরোটাই সুতার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। এটা দুভাবে হতে পারে।

প্রথম, বিরোধীদের সঙ্গে বসে মিটমাট বা মীমাংস করা। এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এটা করতে হলে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি যেখান থেকে শক্তি অর্জন করেছে, সেগুলো অবরুদ্ধ করতে হবে। অর্থাৎ ৮০ শতাংশ শক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর ২০ শতাংশ শক্তি বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীপক্ষকে শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারলে রিকনসিলিয়েশন সম্ভব।

আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বিরাজমান বিভাজন যেমন, দুই তিনটি শিক্ষাব্যবস্থা, এগুলো আধুনিকায়ন করা, মুক্তিযুদ্ধ চেতনামুখী করা। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক পরিম-ল আরো উদার করা। গণমাধ্যম, গণতন্ত্র চর্চা, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের চর্চা বাড়ানো।

এগুলো অগ্রসরমান চিন্তা নিয়ে জাতির সামনে উপস্থাপন করলে সেই ২০ শতাংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি কমতে কমতে শূন্যে আসবে। তবেই রিকনসিলিয়েশন হবে। আর যদি মনে করা হয় ২০ শতাংশ যেমন আছে, তেমনি থেকে যাবে রিকনসিলিয়েশন সম্ভব হবে না।

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App