×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষার্থীরা আদৌ কি ডাকসু নির্বাচন চায়?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:১২ পিএম

ডাকসুর উদ্দেশ্য যদি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন আর সরকার পতন আন্দোলন ত্বরান্বিত করা; তাহলে প্রতিষ্ঠিত সরকার বা তার নিয়োজিত প্রতিনিধি কি কারণে আত্মোচ্ছেদের ফাঁদে পা দেবে? অতীতের ঘটনাপুঞ্জি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার পেছনে এটা সবচেয়ে বড় কারণ। তাই ডাকসু বা হল সংসদ কিংবা ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতে হবে নেতৃত্ব সৃষ্টি এবং ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এটা ডাকসুর উদ্দেশ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিনা জানি না। তদুপরি, আশা করছি ছাত্রত্বের সংজ্ঞায় কোনোভাবে ‘মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদের’ অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। অতীতে এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থীরা ভোটার হতে পারত, প্রার্থী হতে পারত না। ছাত্রত্বের সংজ্ঞায় অতীতে তারাও অন্তর্ভুক্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধানকে মেনে নিয়েছে।

প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লেখালেখি, আলোচনা, সমালোচনা ও প্রতিবেদন পড়ে এবং দেখে মনে হবে ডাকসু নির্বাচন জমে উঠেছে। আসলে ডাকসু নির্বাচন আদৌ জমে উঠবে কিনা, তাতে আমার প্রচুর সন্দেহ রয়েছে। আমার ধারণা ডাকসু নির্বাচন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং ক্ষেত্রভেদে কাদা ছোড়াছুড়ি জমেছে ঠিকই; কিন্তু তা নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাবে কিনা সন্দেহ।

ইতোমধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্নের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং সিন্ডিকেটের অনুমোদন পেলে কারা ভোট দিতে পারবেন, কোথায় ভোট দিতে পারবেন এবং ডাকসু সভাপতির কি ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকবে তা নিয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা মিলবে।

ইতোমধ্যে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো উপরোক্ত বিষয়ে বৈচিত্র্যময় আচরণ করছে। সংবাদপত্র তাদের সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো যা করছে, তাতে মনে হচ্ছে ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত করা না গেলে ও ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে স্থাপন না করলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। এই আশঙ্কা আমারও রয়েছে। এই স্বল্প সময়ে ক্যাম্পাসে সহাবস্থান এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা হবে একটু দুষ্কর ব্যাপার, আর এই কারণে নির্বাচন করাটাও হবে দুষ্কর। নির্বাচনের সময়ে ওইসব বিষয় ছাড়াও আরো কিছু মীমাংসিত বিষয়ে নতুন বিতর্কের সূচনা হয়েছে যা মূল লক্ষ্যকে ভ-ুল করে দিতে পারে।

অনেক শ্রদ্ধেয় ও বিতর্কিত বিজ্ঞজনের মতে এমনকি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মতে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে রাজনৈতিক নেতা সৃষ্টির আঁতুড় ঘর। ডাকসুর উদ্দেশ্য যদি তা হয় তাহলে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর আকাক্সক্ষার বিপরীতে এই অবস্থান ডাকসু বা হল সংসদ কিংবা যে কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিপরীত বোধ ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা শতকরা ১৪-১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতি সমর্থন করেন।

ডাকসুর উদ্দেশ্য হচ্ছে নেতৃত্ব সৃষ্টি আর নেতৃত্ব বলতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অতি সংকীর্ণ অর্থেই ব্যবহৃত হচ্ছে। নেতৃত্বের সংজ্ঞা, নেতৃত্বের তত্ত্ব, বিকাশ ও উন্নয়ন ধারায় খুব কম ক্ষেত্রেই রাজনীতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, যদিও একই তত্ত্ব দিয়ে সব ধরনের নেতৃত্বকে বিশ্লেষণ, অনুধাবন ও উন্নয়ন সম্ভব। ডাকসুর নেতাদের অনেকেই রাজনীতিবিদ হয়েছেন, কেউ আবার আধা রাজনীতিবিদ হয়েছেন, ডাকসু ও হল সংসদের নেতাদের অনেকেই সিভিল প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গন, শিল্প-বাণিজ্য, সেনাবাহিনীতে উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব প্রদান করেছেন কিংবা করে থাকেন।

ডাকসুর উদ্দেশ্য শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বে শূন্যতা পূরণ নয় কিংবা ঝোপ বুঝে কোপ মেরে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করা নয়, তাহলে ওই নির্বাচন শক্তিমানরা অগ্রাহ্য করতেই পারে। তবুও এমন একটি সুর আমি একাধিক বিশিষ্টজনের কলামে দেখেছি এবং শঙ্কিত হচ্ছি এই ভেবে যে, ডাকসুর উদ্দেশ্য যদি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন আর সরকার পতন আন্দোলন ত্বরান্বিত করা; তাহলে প্রতিষ্ঠিত সরকার বা তার নিয়োজিত প্রতিনিধি কি কারণে আত্মোচ্ছেদের ফাঁদে পা দেবে? অতীতের ঘটনাপুঞ্জি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার পেছনে এটা সবচেয়ে বড় কারণ। তাই ডাকসু বা হল সংসদ কিংবা ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতে হবে নেতৃত্ব সৃষ্টি এবং ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এটা ডাকসুর উদ্দেশ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিনা জানি না।

তদুপরি, আশা করছি ছাত্রত্বের সংজ্ঞায় কোনোভাবে ‘মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদের’ অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। অতীতে এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থীরা ভোটার হতে পারত, প্রার্থী হতে পারত না। ছাত্রত্বের সংজ্ঞায় অতীতে তারাও অন্তর্ভুক্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধানকে মেনে নিয়েছে। এখন তাদের সংখ্যা অধিক এবং তাদের প্রচণ্ড ভিড়। সান্ধ্য প্রোগ্রাম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে।

অতীতে শুধু বাণিজ্য বিভাগের এমকম পাসদের যুগোপযোগী করার মানসে এমবিএ ডিগ্রি প্রদানের জন্য সান্ধ্য এমবিএ প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৬ বছরের পড়াশুনার খাতিরে ১৫ বছর পড়ুয়াদের জন্য এক বছরের এমবিএ চালু করা হয়েছিল কিন্তু এখন প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছর মেয়াদি ডিগ্রি ও ১ বছর মেয়াদি মাস্টার্স ডিগ্রি প্রচলন হওয়ার পর বৈকালিক প্রোগ্রামের যৌক্তিকতা ফুরিয়ে গেছে। তার লক্ষণ দেখা যায় বৈকালিক ছাত্রছাত্রীদের সমাহার বা সমভিহার দেখে।

এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৭ বছর অবধি পড়াশুনা করে লাভের পরও অন্তত অলঙ্কার কিংবা মূল্যবর্ধক হিসেবে ঢাকা কিংবা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসাধারণের টাকায় সান্ধ্যকালীন এমএ, এমবিএ করছে আর নিয়মিত ছাত্রদের অবমূল্যায়নে সহায়তা করছে এসব অনিয়মিত শিক্ষার্থী। এমফিল, পিএইচডির ছাত্রছাত্রী মিলিয়ে তারা এক বিরাট সংখ্যা। তারা ডাকসু নির্বাচনকে মাঠে বসিয়ে দিতে পারে। একটি বহুল প্রচলিত দৈনিকের মতে, এসব এমফিল, পিএইচডি, সান্ধ্য প্রোগ্রামের কোনো ছাত্রকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে সম্পূর্ণ বাদ দেয়া হোক অর্থাৎ তারা ভোটার কিংবা প্রার্থী কোনোটাই হতে পারবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছর মেয়াদি ডিগ্রি প্রোগ্রাম প্রবর্তনের লক্ষ্য ছিল যে এটা হবে সমাপ্তি ডিগ্রি। এই ডিগ্রি অর্জনের পর আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা হবে বিশ্বমানের। ধারণা করা হয়েছিল তারা এই ডিগ্রি নিয়ে শুধু ঊর্ধ্বতন গবেষণা ও শিক্ষকতা ছাড়া অন্য সব জাগতিক কাজ সমাধা করতে পারবে। এটা লক্ষ্যার্জিত হয়নি।

এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা এমন করা হয়েছে, যাতে সবাই মাস্টার ডিগ্রি নিতে উদগ্রীব হচ্ছে এবং ৪ বছরের ডিগ্রিটা নিম্নমানে নেমে গিয়ে আরো এক বা একাধিক বর্ষের ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করছে। আমার ধারণা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৪ বছরের ডিগ্রির পর শুধু মুষ্টিমেয় অতি মেধাবীদের মাস্টার, এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তবে তাদের ডাকসু বা যে কোনো নির্বাচনে ভোটার বা প্রার্থী হওয়ার সুযোগ একেবারে দেয়া উচিত হবে না।

এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। দেখা যাচ্ছে একপক্ষ পূর্বে গেলে অন্যপক্ষ বিচার বিবেচনা ছাড়াই দক্ষিণ বা পশ্চিম বা উত্তরমুখিতায় পা রাখছে। ১৯৮৯ সালে সুদীর্ঘকাল পরে ডাকসুর একটি নির্বাচন হয়েছিল। সে সময় আমরা কিছু বিধি প্রণয়ন করেছিলাম এবং সেসব বিধি বামপন্থি ছাত্রছাত্রীরা বেশি সমর্থন করেছিল।

এগুলোর মধ্যে ছিল- ১. ক্যাম্পাসের সীমারেখায় কোনো সভা করা যাবে না, তবে মলে সভা করা যাবে, ২. ক্যাম্পাসের করিডোরে কিংবা ক্লাসের অভ্যন্তরে কোনো মিটিং করা যাবে না। ৩. ক্যাম্পাসের দেয়ালে পোস্টার মারা বা চিকা মারা যাবে না, ৪. মল এলাকায় উচ্চৈঃস্বরে মাইক্রোফোন ব্যবহার করা যাবে না।

এগুলো ছাত্রলীগ এখনো সমর্থন করছে বলে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো তার বিরোধিতা করছে। বহু আগ থেকে মীমাংসিত এসব বিষয়াদি তর্কের পর্যায়ে এনে নির্বাচনে নতুন সংকট সৃষ্টি কতটা বাঞ্ছনীয়? পৃথিবীর কোনো দেশে ছাত্র সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসের এমন অপব্যবহার সমর্থন করে না। আশা করি এসব মীমাংসিত বিষয়গুলো পুনর্জাগরিত না করে শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটারের সংখ্যা ও ভোটদান কেন্দ্র নিয়ে কথা বলতে পারে।

অছাত্রদের কোনো মতে ছাত্রত্ব দেয়া হলে অনেকে ভাবছেন শিক্ষাঙ্গন হবে সব ধরনের নেতৃত্ব নয়, কেবল রাজনৈতিক সৃষ্টির চারণ ক্ষেত্র। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ ডাকসুর নির্বাচনের ব্যাপারে একটা গণভোট চেয়ে বসতে পারে।

প্রসঙ্গটি হবে শিক্ষার্থীরা ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন চায় কি চায় না? আগেই বলেছি অনেক জরিপে উঠে এসেছে যে মাত্র ১৪-১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চায়, তাহলে কেবল রাজনীতিবিদ তৈরির জন্য আর কতভাগ শিক্ষার্থী ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন চাইছে?

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী: সাবেক প্রক্টর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App