×

মুক্তচিন্তা

উপজেলা নির্বাচন বর্জন কফিনের শেষ পেরেক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:৩৬ পিএম

তৃণমূল পর্যায়ে এখনো এ দেশে বিএনপির সমর্থক আছে- যারা সত্যি সত্যি ২০ দলীয় জোটগত আদর্শের চেয়ে এককভাবে বিএনপির আদর্শে বিশ্বাসী। এরা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে অবস্থান নিয়েও মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে নিজেদের অবস্থান ঘোষণার জন্য সর্বদা প্রস্তুত। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সেরকমভাবে বিএনপিকে সংগঠিত করার লক্ষণই নেই।

সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সভা শেষে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাতির কাছে স্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করে ঘোষণা দিয়েছেন উপজেলা নির্বাচনে তার দল অংশগ্রহণ করবে না।

মির্জা ফখরুলের এই ঘোষণা শুনে আমাদের মনে হলো বিএনপি এখন এক মৃত রাজনৈতিক দল- তাকে সমাধিস্থ করার সব রকমের প্রস্তুতিও সম্পন্নপ্রায়। মহাসচিব মির্জা ফখরুলের এই ঘোষণায় বিএনপির কফিনে সর্বশেষ পেরেক লাগানোর কাজটিও সমাপ্ত হলো।

বিএনপির উপজেলা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় দলটির সঙ্গে সাধারণের বিচ্ছিন্নতা আরো প্রকট হয়ে উঠল। এই জনবিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে দলটির সাংগঠনিক কাঠামোও আরো দুর্বল হয়ে পড়বে সন্দেহ নেই।

আমরা দেখছি ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করাসহ বিএনপির পরবর্তী সব সিদ্ধান্ত গ্রহণই ছিল ভুল, বলা চলে হঠকারিতায় পরিপূর্ণ। ২০১৪ সালের নির্বাচনী ‘ট্রেন মিস’ করার পর থেকে ক্রমে ক্রমে একেবারে দিশাহারা এই দলটি আর কোনো ক্রমেই কোনো গন্তব্যেই পৌঁছতে পারছে না।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী স্বল্পসংখ্যক সংসদ সদস্যকে শপথগ্রহণ ও সংসদ অধিবেশনে যোগ না দেয়ার ঘোষণাও আমাদের কাছে দলটির আরেক ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত বলেই মনে হচ্ছে। পাশাপাশি উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়াও তাদের আরেকটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবেই সবার কাছে বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপি কর্মীদের কাছে প্রতিভাত হবে।

বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে তারা সব প্রকার ‘ট্রেন মিস’ করার ব্যর্থতায় রাজনৈতিক দল হিসেবে অচিরেই যে মুখ থুবড়ে পড়বে সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ইতোমধ্যে ‘ভাবমূর্তি’ সংকটে পড়ে গেছে।

বিএনপির বর্তমান নীতিনির্ধারকদের উচিত দ্রুত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সাংগঠনিকভাবে ও সংঘবদ্ধভাবে কাজ করা। কিন্তু তাদের মধ্যে সাধারণের চাহিদা মতো সমসাময়িক রাজনৈতিক ইস্যু তৈরির কোনো লক্ষণ দেখি না। বরং ক্রমশ দলটির অস্তিত্বহীনতা প্রমাণের লক্ষ্যেই অনেকের উদ্যোগ দেখতে পাই।

নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সাধারণের ‘সাধারণ’ আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি কোনো তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণও আমাদের নজরে আসে না। এককথায় সমসাময়িক সমাজ সচেতনতা দলটির কোনো স্তরের নেতৃত্বের মধ্যেই নেই। এখন এও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে গেছে যে, বিএনপির মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট হলো নেতৃত্বের।

অর্থাৎ নেতৃত্বের অভাবই দলটিকে একেবারে খাদের সর্বশেষ কিনারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। স্থায়ী কমিটি কিংবা অন্যান্য নানা পর্যায়ে আর যারা আছেন তারাও ঠিক করতে পারছেন না দলের নেতৃত্ব। এ ক্ষেত্রে কাজটি যথেষ্ট কঠিনও বটে।

কারাগারের অভ্যন্তরে খালেদা জিয়া আর লন্ডনে পলাতক তারেক রহমানের অভাব পূরণ করা জিয়া পরিবারের কোনো সদস্য ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আপাতত খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি জিয়া পরিবার থেকেও মনোনীত হয়নি- সে সম্ভাবনা কতখানি তাও স্পষ্ট নয়।

ফলে সাধারণের সম্মুখে নেতৃত্বের সংকটই এখন বিএনপির ভেতর-বাইরের অন্যতম এক সমস্যা। কে দলটির হাল ধরবেন? কিংবা কার পেছনে দলটির তৃণমূল পর্যায়ের সমর্থকরা কিংবা বড় করে বললে এ দেশের সাধারণ মানুষ আশা-ভরসা কিংবা আশ্রয়ের প্রত্যাশা নিয়ে দাঁড়াবে?

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই নেতৃত্বহীনতা দলটিকে একেবারে বিপর্যস্ত করে ছেড়েছে। ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগকে ৩০ ডিসেম্বর নীরব ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রছাড়া করার সদম্ভ ঘোষণা দিলেও কার্যত ফল হয়েছে একেবারেই উল্টো।

এ দেশের মানুষ ড. কামাল, রব, জাফরুল্লাহ, মান্না গংদের সামান্য বিশ্বাসও করতে পারেনি। তাই তাদের তর্জন-গর্জনের ফলাফল যা দাঁড়িয়েছে তা অশ্ব-ডিম্ব বৈ তো নয়! এরূপ বিপর্যস্ত ফলাফলের পেছনে নেতৃত্বহীনতাই অন্যতম বড় কারণ।

বিএনপির নেতৃত্বহীনতার কারণেই অনেকটা আশাতীত সাফল্য লাভ করেছে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলগত ও জোটগত উভয়ভাবেই। অপরদিকে জনগণের সম্মুখে বিএনপির প্রধান নেতা হিসেবে এ দেশের মানুষ কাউকে দেখতে পায়নি।

এমনকি যে কোনো ইস্যুতে বিএনপি যাদের কাছে সব সময়ই নানা রকমের অভিযোগ ও নালিশ নিয়ে দেনদরবার করে থাকে সেই বিদেশিরাও যখন জানতে চেয়েছিল ঐক্যফ্রন্ট বিজয়ী হলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তারও কোনো সদুত্তর বিএনপি কিংবা ঐক্যফ্রন্ট নেতারা দিতে পারেননি।

এ দেশের মানুষ শূন্য হাঁড়িতে কি করে ভোট দেবে, কোনো ভরসায় ভোট দেবে? সুতরাং নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবির পশ্চাতে দলের নেতৃত্বের শূন্যতাও প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারসহ অন্যান্য একাধিক মামলায় বিচারিক রায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের শাস্তি হ্রাস বা মওকুফ হওয়ার আপাতত কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

বরং নির্বাচন-পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী তারেক রহমানকে লন্ডন থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতের নির্দেশ কার্যকর করার কথাই সরকারি মহলে উচ্চারিত। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সরকারি এ ঘোষণায় জনগণের মধ্যে কোনো অস্বস্তি তৈরি করেনি।

দলের অন্যান্য নেতাকর্মীও এখন পর্যন্ত তেমনভাবে গর্জে ওঠেনি। তারেক রহমানের জন্য এ দেশের মানুষ ভবিষ্যতে যে গর্জে উঠবে তেমন সম্ভাবনাও খুব একটা যে নেই তাও বেগম জিয়াকে কারাগারে প্রবেশের সময় উপলব্ধি করা গিয়েছিল।

আইনি প্রক্রিয়ায় যেহেতু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের শাস্তি নির্দিষ্ট হয়েছে তাই দল বা দলের কর্মীদের মধ্যে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টি একেবারেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অবশ্য শাস্তি প্রাপ্তির পর কর্মীদের ক্ষোভ থাকলেও রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শনের পথটি সহজ-সুগম নয়।

এ ছাড়া ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দাঁড়ানোর মতো নৈতিক ভিত্তি নেতাকর্মীদের আছে কি না তাও বিবেচনার বিষয়। এমতাবস্থায়, সত্যি সত্যি রাজনীতির মাঠে ময়দানে সক্রিয় থাকতে হলে বিএনপিতে একজন পরিচ্ছন্ন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা প্রয়োজন। বিএনপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইলে প্রথমে নেতা নির্বাচনই জরুরি।

জেলখানা কিংবা লন্ডন থেকে পাওয়া আদেশ-উপদেশ কিংবা জনবিচ্ছিন্ন ভিডিও বার্তা, বক্তব্য, আবেদন, নিবেদনে এ দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা যেমন পূরণ হবে না তেমনি সেরকম নেতৃত্বের পশ্চাতে এ দেশের মানুষ সারিবদ্ধভাবে ভবিষ্যতে আর কখনো দাঁড়াবে কিনা তাও সন্দেহের বিষয়।

আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত থাকলে বিএনপির সামনে আরো দুর্যোগ ও জনবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হবে। তৃণমূল পর্যায়ে এখনো এ দেশে বিএনপির সমর্থক আছে- যারা সত্যি সত্যি ২০ দলীয় জোটগত আদর্শের চেয়ে এককভাবে বিএনপির আদর্শে বিশ্বাসী।

এরা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে অবস্থান নিয়েও মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে নিজেদের অবস্থান ঘোষণার জন্য সর্বদা প্রস্তুত। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সেরকমভাবে বিএনপিকে সংগঠিত করার লক্ষণই নেই। আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কর্মী-সমর্থকদের নিয়েই বিএনপির পুনর্গঠন এখন জরুরি।

মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ, বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে অসংকোচে মেনে নিয়ে একটি নতুন ধারার বিএনপি পুনর্গঠিত হলে নিশ্চিত অপমৃত্যুর কবল থেকে দলটি আত্মরক্ষায় সমর্থ হতে পারে। না হলে ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচন শেষ হতে না হতেই বিএনপির অস্তিত্ব আরো বিপন্নতায় আচ্ছন্ন হবে। ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না।

উপজেলা নির্বাচন বর্জন করলে তাই হবে বিএনপির কফিনে শেষ পেরেক। কিন্তু আমরা তা চাই না। আমরা চাই আধুনিক মননশীলতা নিয়ে নতুন নেতার নতুন নতুন দিকনির্দেশনা নিয়ে বিএনপি রাজনীতির মাঠ ময়দান দাপিয়ে বেড়াক।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App