×

জাতীয়

নদী উদ্ধারে বড় অভিযান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:২৮ এএম

নদী উদ্ধারে বড় অভিযান

দখল-দূষণে বিপর্যস্ত ঢাকার চারপাশের সব নদ-নদী। কেরানীগঞ্জের খোলামোড়া এলাকায় এভাবেই বহু ভবন তুলে দখল করা হয়েছে বুড়িগঙ্গার তীরভভূমি-শাহাদাত হোসেন

বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আগামী মঙ্গলবার থেকে বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত এ অভিযানে ৫৬টি বহুতল ভবনসহ প্রায় ৬শ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হবে। নদীর জায়গায় ভরাট করা মাটিও অপসারণ করা হবে এ সময়। এটি নিকট অতীতের সবচেয়ে বড় অভিযান হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। শিগগিরই ঢাকার চারপাশের সব নদী ও খাল রক্ষায় ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু হবে বলেও জানান তারা। নদীর দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরেই বড় অভিযান পরিচালনার কথা শোনা যাচ্ছিল। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর নদীরক্ষা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্যদের নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে সে সময়ের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, ছোটখাট টংঘর না ভেঙে এবার বড় বড় অবৈধ স্থাপনা ভাঙার মধ্য দিয়ে অভিযান শুরু হবে। তিনি সে সময় বছিলার একটি ৭ তলা ভবনসহ অন্তত ১৩টি স্থাপনা উচ্ছেদের কথা বলেন। কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলেও সে অভিযান শুরু হতে দেখা যায়নি, বরং এরপর নদীর তীরে নতুন করে দখল ও ভরাট হতে দেখা গেছে। এসব দখল থেকে বিআইডবিøউটিএর এক শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়মিত মাসোয়ারা আদায় করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এবারের অভিযান প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর এম মোজাম্মেল হক জানান, নদীর জায়গায় কোনো ধরনের দখল বা স্থাপনা নির্মাণ বেআইনি কাজ। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা বিআইডব্লিউটিএর নিয়মিত কাজের অংশ। তবে আগামী মঙ্গলবার থেকে জেলা প্রসাশন, র‌্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় ব্যাপকভাবে অভিযান পরিচালনার বিষয়টি চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে। উচ্ছেদের পর ফের দখল ঠেকাতে নদীর তীরে ৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বনায়নের একটি প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। উচ্ছেদের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা চেয়ে গত ২০ জানুয়ারি ঢাকা জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেন বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান। এতে এক প্লাটুন র‌্যাব, দুই প্লাটুন নৌপুলিশ, পর্যাপ্ত থানা পুলিশ, দুটি এসকাভেটর, টাগবোটসহ উচ্ছেদের সময় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে তিতাস, ডিপিডিসি ও ওয়াসার লোকবলও চাওয়া হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদীবন্দর সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দিন ২৯ জানুয়ারি সকাল ৯টায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার কালীগঞ্জ তেলঘাট এলাকা থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। চলবে খোলামোড়া এলাকা পর্যন্ত। এ অভিযানে প্রায় অর্ধশত অবৈধ স্থাপনা ভাঙা হবে। খোলামোড়া এলাকায় রফিকুল ইসলামের একটি ৭ তলা ভবনের অংশ বিশেষ ভাঙার কথা রয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় কেরামত আলী মেম্বারের একটি দালানও ভাঙা হবে এ অভিযানে। ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি ওয়াইজঘাট এলাকা থেকে শুরু হয়ে সোয়ারীঘাট ও কামরাঙ্গীর চরের নবাবচর পর্যন্ত অভিযান চলবে। এখানেও ভাঙা পড়বে অনেকগুলো পাকা-আধাপাকা স্থাপনা। কয়েক দিন বিরতি দিয়ে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের মুখে। কামরাঙ্গীর চরের ঠোঁটা নামে পরিচিত এই এলাকা থেকে উচ্ছেদ অভিযানটি চলবে লোহারপুল পর্যন্ত। এতে জুলহাসের রিকশা ভ্যানের গ্যারেজসহ কয়েকটি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। তবে নদীর এ চ্যানেলটি হাজারীবাগ পর্যন্ত উদ্ধার করে মূল নদীর সঙ্গে যুক্ত করার কোনো অভিযান এ পর্যায়ে হচ্ছে না বলে জানা গেছে। আদি চ্যানেলের ওই অংশে পান্না ব্যাটারি, ম্যাটাডোরসহ বেশ কিছু বড় কলকারখানা গড়ে উঠেছে। টাস্কফোর্সের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও এসব প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে অভিযান না চালানোয় দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ রয়েছে পরিবেশবাদীসহ স্থানীয়দের মধ্যে। ২০১৪ সালের ২৫ মে টাস্কফোর্স সদস্যরা বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল পরিদর্শনে গিয়ে দখল-দূষণের চিত্র দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। সে সময়ের টাস্কফোর্সের সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম, ভ‚মিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম ও এডভোকেট সানজিদা খানমসহ উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও পরিবেশবাদী সংগঠনের সদস্যরা বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল সরেজমিন পরিদর্শনে যান। চ্যানেলটির দুরবস্থা দেখে নৌমন্ত্রী পরের দিনই সচিবালয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন। ওই বৈঠকে আদি চ্যানেল উদ্ধারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও পরে আর সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। ৭ ফেব্রুয়ারি উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে মোহাম্মদপুর ও হাজারীবাগ থানা এলাকার বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর তীরে। কাটাসুর আমিন মোমিন হাউজিং এলাকা থেকে শ্রীখণ্ড পর্যন্ত এ অভিযানে ভাঙা পড়বে কয়েকটি বহুতল ভবন। ১২ ফেব্রুয়ারি শ্যামপুর এলাকা থেকে খোলামোড়া লঞ্চঘাট পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি মিরপুর বড়বাজার এলাকা থেকে শুরু করে আবারো কাটাসুর আমিন মোমিন হাউজিং পর্যন্ত অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নির্বাহী সদস্য, নদী গবেষক প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ১৭৮২ সালে জেমস রেনেলের মানচিত্রে বুড়িগঙ্গার যে গতিপথ দেখানো হয়েছিল তাতে নওয়াবগঞ্জ চড়ের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে নৌকা লালবাগ ঘাটে ভিড়ত। ১৮৬৪ সালেও বুড়িগঙ্গা বয়ে যেত লালবাগের কেল্লা, চৌধুরী বাজার, রায়ের বাজার এবং পিলখানার ঘাটের ধার ঘেঁষে। বুড়িগঙ্গা ও এর আদি চ্যানেল বাঁচাতে সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে শুধু অবৈধ স্থাপনা রয়েছে তা নয়। নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় অনেকের বৈধ জমিও এখন নদীর সীমানা হয়ে গেছে। আইন অনুযায়ী নদীর জায়গায় স্থাপনা করা যায় না। তাই অনেক বৈধ মালিকের স্থাপনা উচ্ছেদের প্রয়োজন হবে। একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও সরকারকে ভাবতে হবে। নদী তীরে ধর্মীয় স্থাপনা নিয়ে জটিলতা কাটেনি : ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর তীরে গড়ে ওঠা ধর্মীয় স্থাপনাগুলো অপসারণ বা স্থানান্তর নিয়ে জটিলতা কাটেনি এখনো। নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মসজিদসহ ৪৫টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছে সরকার। ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সমাধানে পৌঁছার কথা নদী রক্ষা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের গত কয়েকটি বৈঠকে আলোচিত হলেও এ পর্যন্ত কোনো আলোচনাই ফলপ্রসূ হয়নি। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প স্থানে সরিয়ে নিতে কমিটির নেতাদের অনুরোধ জানিয়ে আসছে সরকার। এ জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ও লজিস্টিক সহায়তা দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানের জন্যও কোনো উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। শ্যামবাজার মসজিদের জন্য নদীর ওপারে বিকল্প জায়গার প্রস্তাব করা হলে তাতে রাজি হননি কমিটির নেতারা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App