নারী নির্যাতন মামলার কথকতা
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:২৬ পিএম
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যেসব অপরাধের বিচার হয় তার মধ্যে রয়েছে যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত মৃত্যু, নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনা, যৌন নিপীড়ন, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে শিশুর অঙ্গহানি প্রভৃতি। এই নৃশংস চিত্রকে যথেচ্ছ অতিরঞ্জিত বলে মনে হতে পারে। তবু এ কথা সত্যি যে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা আমাদের জন্য চিন্তার একটি নতুন ক্ষেত্র।
আবার এ কথাও সত্য যে, সহিংসতার একটি বিশাল অংশের খবর আমাদের অগোচরেই রয়ে যায়। সমাজ বিজ্ঞানীরা এটি উদঘাটন করেছেন যে, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ব্যাপ্তি এবং সর্বজনীনতা সবচেয়ে অবহিত ধারণাতেও আসে না। ট্রাইব্যুনালে মিথ্যা মামলা দায়ের করার অভিযোগও শুনতে পাওয়া যায়। নিজেদের মধ্যে অন্যকোনো বিরোধকে কেন্দ্র করে যৌতুক, ধর্ষণ ও যৌন পীড়নের অভিযোগে মামলা হচ্ছে, যার সংখ্যা কম নয়।
এখনো নারীকে যৌতুকের টাকার জন্য নিগ্রহ, ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, গালিগালাজ, এমনকি হত্যার শিকার হতে হয়। ঘর ও কর্মক্ষেত্রে, শ্রেণিকক্ষ বা আদালতে উপাসনালয় ও খেলাধুলার মাঠে ক্রমাগত বৈষম্য ও অবমাননার কারণে তাদের দুর্ভোগের পাল্লা আরো ভারী হচ্ছে। খুব কম লোকই অস্বীকার করবেন যে, মানবাধিকারের গুরুতর লংঘনের জন্য নারী ও শিশুদের বেছে নেয়া হয়েছে।
এ রকম একটা শ্রেণি রয়েছে এবং এর সদস্যরা মানব জাতির অর্ধেক। তবু কদাচিত কথাটি স্বীকার করা হয় যে, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাংলাদেশে মানবাধিকারের সবচেয়ে ব্যাপক লংঘন। এই লংঘন নৃশংসতার আকারে অনেকের ওপর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে শুধুমাত্র তাদের নারী হওয়ার কারণে।
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বেরেছে আরো অন্তত ৪১টি। সম্প্রতি ডয়েচে ভেলের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ মামলা। আর সাজা পাচ্ছে হাজারে মাত্র সাড়ে চারজন আসামি। বাংলাদেশে ৪৬ জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা এখন ৫৪টি।
প্রতিটি জেলায় একটি করে ট্রাইব্যুনাল থাকার কথা থাকলেও তা এখনো হয়নি। আর এই ৫৪টি ট্রাইব্যুনালে এখন মামলা জট লেগেছে। এইসব ট্রাইব্যুনালে প্রায় এক লাখ ৪১ হাজার ১৮৭টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর যে সব জেলায় এখনো ট্রাইব্যুনাল নেই সেসব জেলায় এই আইনে দায়ের করা বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৪ হাজার ৮৯৫টি। এই জেলাগুলোতে জেলা জজ অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার বিচার করেন।
ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সারাদেশে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মামলা ঝুলে আছে। গড়ে একটি ট্রাইব্যুনালে এখন ১০ হাজারেরও বেশি মামলা রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কোনো মামলায় প্রথমে বাদী যত উৎসাহের সঙ্গে শুরু করেন অনেক সময়ই সেই উৎসাহ আর শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেন না।
কেননা প্রায়শই দেখা যায় সাক্ষী হাজির হন না। পলাতক থাকেন অনেক আসামি। তাদের গ্রেপ্তারের বিষয় থাকে। মালামাল ক্রোকের বিষয় থাকে। আবার আদালতের বাইরে কেউ কেউ মামলা আপস করে ফেলেন। আর মামলার তদন্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তদন্তে অনেক ত্রুটি থাকে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে দায়ের করা মামলার তদন্ত ঠিকমতো না হলে আদালতে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়। পুলিশকে ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা হয় না। কারণ দেখিয়ে আরো ৩০ দিন এভাবেই মোট ১২০ দিন সময় নেয়ার সুযোগ পায় তারা। তাই মামলার বিচার কাজ শুরু করতেই দেরি হয়। বিচার শুরু হওয়ার পর ছয় মাসে বিচার কাজ শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নতর।
এখনো কোনো কোনো ট্রাইব্যুনালে ২০০৩ সালের মামলার সন্ধান পাওয়া যায়। ট্রাইব্যুনাল সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ মামলা। আর সাজা পাচ্ছে হাজারে সাড়ে মাত্র ৪ জন আসামি। উপযুক্ত সাক্ষী, চার্জশিট জটিলতা এবং প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নির্যাতন বিষয়ে দ্বার অর্গলমুক্ত করার ব্যাপারটি যেন এমন একটি বিশাল কালো প্রকোষ্ঠের চৌকাঠে দাঁড়ানো যার ভেতরটা সম্মিলিত যন্ত্রণায় প্রকম্পিত হচ্ছে, যদিও প্রতিবাদের ধ্বনি রুদ্ধ হতে হতে একটি গুঞ্জনে পরিণত হচ্ছে। যেখানে অসহনীয় স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ধিক্কার থাকা উচিত, সেখানে আসছে বরং অস্বীকৃতি এবং গতানুগতিক ধারাকে বহুলাংশে নিষ্ক্রিয়ভাবে মেনে নেয়ার ব্যাপারটি।
শৈশব থেকে একটি নারী কি করতে পারে এবং কি হতে পারে সে সম্পর্কে তার কল্পনা যখন সহিংসতার ছায়ায় নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে তার এই শিক্ষা তখনই হয়ে যায় এবং এই শিক্ষা সে কখনই বিস্মৃত হয় না। পুরুষের আগ্রাসনের মুখে ভয়ের ফিসফিসানি শোনেনি এবং সে অনুযায়ী নিজের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ করেনি, এমন নারী কোথায় আছে?
জাহাঙ্গীর আলম সরকার: আইনজীবী ও লেখক।