×

মুক্তচিন্তা

কঠিন সময় পার করছে এলোমেলো বিএনপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৩৬ পিএম

সংসদ নির্বাচনে নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো পর্যালোচনা করে সেগুলো শুধরে নিয়ে বিএনপি যদি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে তাদের ফলাফল তো ভালোও হতে পারে। বিএনপিকে বুঝতে হবে যে তারা আন্দোলনের দল নয়। আন্দোলন করে সরকারের কাছ থেকে কোনো দাবি আদায়ের সক্ষমতা তাদের নেই। খুব তাড়াতাড়ি সেটা হবেও না। নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্ন ও বিতর্কই থাক না কেন, এই নির্বাচন বাতিল হওয়ার কোনো সুযোগ, সম্ভাবনা, আশঙ্কা আছে বলে মনে হয় না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উত্তেজনার পারদ নিচে নামতে না নামতেই দেশে আরো একাধিক নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে। এর মধ্যে বেশি উত্তাপ ছড়াবে সম্ভবত উপজেলা নির্বাচন। সংসদে যারা প্রার্থী হতে পারেননি, তারা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করবেন উপজেলায় মনোনয়ন পাওয়ার। নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, মার্চ মাসে পাঁচ দফায় উপজেলা নির্বাচন হবে। তাই এখন তৃণমূলে শুরু হয়েছে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যেই আগ্রহ বেশি। কারণ নৌকার প্রার্থী হলে জয় নিশ্চিত এমন একটি ধারণা প্রায় সবার মনেই দানা বেঁধেছে।

এমন ধারণা তৈরিরও দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়। মনে করা হচ্ছে, সংসদ নির্বাচনের মাত্র দুই মাসের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন হওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বাড়তি সুবিধা পাবেন। দুই মাসের মধ্যে সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নামার কোনো কারণ নেই।

এ ছাড়া বিএনপি সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর সাংগঠনিকভাবে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। উপজেলা নির্বাচনে তাদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো হবে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।

দ্বিতীয়ত, বিএনপি এর মধ্যেই জানিয়েছে যে, তারা বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। যদি বিএনপির এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়, তাহলে উপজেলা নির্বাচনও একতরফা হবে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের তো পোয়াবারো অবস্থা। ফলে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা থেকে সম্ভাব্য কেউ পিছিয়ে থাকবে না। চারদিকে তাই সাজ সাজ রব।

তবে দলের প্রতীক নিয়ে বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে না গেলেও দলের কেউ স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করলে বাধা নাও দিতে পারে দলটি। বিএনপি ধরে নিচ্ছে, সংসদ নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, উপজেলা নির্বাচনও সেভাবেই হবে। তাদের এই ধারণা শতভাগ অভ্রান্ত মনে করার কোনো কারণ নেই।

সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা না থাকার প্রশ্ন জড়িত। উপজেলার সঙ্গে সেটা নয়। সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের জন্য সরকার যতটা মরিয়া ছিল, উপজেলার ক্ষেত্রে ততটা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উপজেলা স্থানীয় সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তবে উপজেলায় জয়লাভ করা বা পরাজিত হওয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ সংসদ নির্বাচনে যেসব বিবেচনা থেকে ভোট দেয়, উপজেলায় ভোট দেয়ার বিবেচনা ভিন্ন। তাই উপজেলা নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিএনপিকে আগে-পিছে অনেক কিছু ভাবতে হবে।

২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। কিন্তু কয়েক মাসের মাথায় উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং সেই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিএনপি প্রার্থীরা জয়লাভ করেছিল। উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপিকে আরো বেশি সাংগঠনিক সংকট মোকাবেলা করতে হতো।

এবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। তবে সংসদ নির্বাচন যে রকম হয়েছে তার জন্য সরকারকে এককভাবে দায়ী করা ঠিক হবে না। এটা মানতে হবে, আওয়ামী লীগ জয়লাভের জন্য নির্বাচন করেছে। জয়ের জন্য যা যা করার দরকার সবই আওয়ামী লীগ করেছে। কিন্তু বিএনপি করেছে দায়সারা নির্বাচন। বিএনপির কোনো সংগঠিত প্রচেষ্টা ছিল না, পরিকল্পনা ছিল না। প্রার্থীরাও সিরিয়াসলি মাঠে ছিলেন না। তাদের মনোযোগ ছিল অভিযোগ করার দিকে। এই কাজটিও তারা ভালোভাবে করতে পারেনি। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া ঢালাও অভিযোগ করে কোনো ফল পাওয়া যায় না।

সংসদ নির্বাচনে নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো পর্যালোচনা করে সেগুলো শুধরে নিয়ে বিএনপি যদি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে তাদের ফলাফল তো ভালোও হতে পারে। বিএনপিকে বুঝতে হবে যে তারা আন্দোলনের দল নয়। আন্দোলন করে সরকারের কাছ থেকে কোনো দাবি আদায়ের সক্ষমতা তাদের নেই। খুব তাড়াতাড়ি সেটা হবেও না। নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্ন ও বিতর্কই থাক না কেন, এই নির্বাচন বাতিল হওয়ার কোনো সুযোগ, সম্ভাবনা, আশঙ্কা আছে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক দলকে রাজনৈতিক বাস্তবতা মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আকাশকুসুম চয়নের সুযোগ রাজনীতিতে নেই।

শুধু উপজেলা নয়, আরো কিছু নির্বাচনও অল্প সময়ের ব্যবধানে হবে। তার মধ্যে একটি হলো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচন। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনও যদি বিএনপি বর্জন করে তাহলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হবে সহজ জয়। আর ঢাকা মহানগরীতে বিএনপি একটি বড় সংকটের মধ্যে পড়বে। বিএনপির বরং এই নির্বাচনে অংশ নেয়া উচিত। বিএনপি যেহেতু কোনো বিপ্লবী দল নয়, তাই বিএনপিকে কোনো কারণেই নির্বাচন থেকে দূরে থাকা চলবে না। নির্বাচন থেকে দূরে থেকে বিএনপি সুবিধা করতে পারবে না। বিএনপি স্বেচ্ছায় নির্বাচন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলে সেটা সরকার পক্ষের কোনো অস্বস্তির কারণ হবে না। বিএনপি নির্বাচনে না এলে সরকার খুব বেকাদায় পড়বে বলে মনে করলে ভুল হবে।

বিএনপি যদি নির্বাচনে না-ই আসে তাহলে আওয়ামী লীগ তথা সরকার হয়তো নতুন কোনো কৌশল গ্রহণ করবে। জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের শরিক দলগুলোকে কিছুটা ‘ছাড়’ দিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নিয়ে আসতে অসুবিধা হবে না। হিরো আলমের মতো প্রার্থীও চাইলে পাওয়া যাবে। একটি বিকল্প বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা অনেকেই অনুভব করছেন। বিএনপি স্বেচ্ছায় মাঠ ছেড়ে দিলে তাদের হতাশ বা আশাহত নেতাকর্মীরা কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? তারা যদি নতুন নাম-পরিচয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে তাহলে সেটা বিএনপির জন্যই সমস্যা সৃষ্টি করবে।

সংরক্ষিত নারী আসনের ৫০ জন সদস্য নির্বাচনেরও প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সংরক্ষিত নারী আসনের জন্যও এবার আওয়ামী লীগে প্রার্থীর ছড়াছড়ি। নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন অথচ তৃতীয় লিঙ্গের আটজনও মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়েছেন। দলের জন্য কাজ করেন এমন প্রার্থীর সঙ্গে কোনো দিন দলের জন্য কিছু না করেও মনোনয়ন প্রার্থী হয়েছেন। হিসাব অনুযায়ী বিএনপিরও একটি নারী আসন পাওয়ার কথা। কিন্তু তারা যদি সংসদে না যায় তাহলে তো আর তাদের নারী সদস্য পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। এভাবে একের পর এক সুযোগ হাতছাড়া করে শেষে বিএনপিকে পস্তাতে হবে।

দীর্ঘদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচনেরও তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আগামী ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচন হবে বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানিয়েছেন। আমাদের দেশের জাতীয় রাজনীতিতেও ডাকসু নির্বাচনের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।

বাংলাদেশকে বলা হয় আন্দোলন-সংগ্রামের দেশ। আর সব আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র গণআন্দোলন সংঘটিত করার ক্ষেত্রে পাইওনিয়রের ভূমিকা পালন করে থাকে ডাকসু। ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতেও পালন করেন উজ্জ্বল ভূমিকা।

দুঃখের বিষয় ১৯৯০ সালের পর আর ডাকসু নির্বাচন হয়নি। ফলে ছাত্র সমাজ একদিকে তাদের নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগবঞ্চিত হয়েছে, অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতিতেও নতুন রক্ত সঞ্চালনের পথ রুদ্ধ থেকেছে। ডাকসু নির্বাচনে কী বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদল অংশ নেবে? নাকি ফলাফল কী হবে তাতো জানি- এই কথা বলে নির্বাচন থেকে দূরে থাকবে? বিএনপি ডাকসু প্রশ্নে কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাও একটি দেখার বিষয়।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর দেশে দোষারোপের রাজনীতি এক নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ প্রত্যাশার চেয়ে বেশি আসন পেয়ে হতভম্ব হয়েছে আর বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছে আশার চেয়ে অনেক কম আসন পেয়ে। আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশে আর সব দল বাস্তবে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।

বিশেষ করে বিএনপির মতো বড় দল প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া অনেকের কাছেই ‘ম্যাজিক’ বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল প্রত্যাশিত। বিএনপি যে ক্ষমতায় ফিরে আসার মতো রাজনৈতিক-সাংগঠনিক অবস্থায় নেই- এটাও কারো অজানা ছিল না। তাহলে আওয়ামী লীগের জয় এবং বিএনপির পরাজয় নিয়ে কেউ কেউ এত বিলাপ করছেন কেন?

বিএনপি মনে করছে, এবার কোনো নির্বাচনই হয়নি। আগের রাতেই নাকি অনেক জায়গায় ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ঢোকানো হয়েছিল। যদি তাই হয়, তাহলে বিএনপি সেটা প্রতিরোধ করতে পারল না কেন? জনসমর্থন যদি তাদেরই বেশি হয়, তাহলে বিএনপির ডাকে কেউ ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে এলো না কেন? মানুষ নিজের পরাজয় কখন চেয়ে চেয়ে দেখে? বিএনপি তার শক্তি-সামর্থ্য পরিমাপ না করেই বড় বড় কথা বলে আনন্দ পায়।

আর এলোমেলো কথা বলে এখন দলটি পড়েছে বড় ধরনের এলোমেলো অবস্থায়। নানাজন বিএনপিকে নানারকম পরামর্শ দিচ্ছেন। দলের নেতারাও মুখ বন্ধ করে থাকতে পারছেন না। নেতৃত্ব পরিবর্তনের দাবি উঠেছে। বিএনপি কী করবে, কোন কৌশল গ্রহণ করবে সেটা ঠিক করার দায়িত্ব বিএনপিরই।

তবে পাঁচমিশালী দলে একবার দমকা বাতাস লাগলে ঐক্য বজায় রাখা খুব সহজ হয় না। সব মিলিয়ে বিএনপি যে এখন একটি কঠিন সময় পার করছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কীভাবে বিএনপি সামলে ওঠে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App