×

মুক্তচিন্তা

বিএনপির রাজনীতি উদ্দেশ্যহীনতার পথ ধরেছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:০১ পিএম

যারা ক্ষমতায় থাকলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সীমা-পরিসীমা থাকে না, জঙ্গি উত্থান হয় দ্রুত সময়ে, বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি তৈরি হতে থাকে। দুর্নীতিতে বারবার বিশ^ চ্যাম্পিয়ন হয় দেশের জনগণ জেনেশুনে তাদের ভোট দেবে কেন? আর যে দল ও জোট উন্নয়নের ধারার দেশকে শোচনীয় দারিদ্র্য ঘুচিয়ে ১০ বছরে বিশে^র ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত করে, তাদের জনগণ ভোট না দিয়ে কি পারবে? বিএনপি শুধু নির্বাচনে নয়, নানা দিকেই হেরেছে।

গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মূলত বিএনপি নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট শোচনীয়ভাবে হেরেছে। মহা বিপর্যয়ে পড়েছে ভিন্ন পন্থা নির্ভর এই দলটি যা আর কখনো পড়েনি। এই বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করাটাই প্রত্যাশিত ছিল দলটির কাছ থেকে। দলের শীর্ষ ও মধ্য সারির নেতারা ইদানীং যা সব বলছেন তাতে মনে হয় না তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা কিছু করছেন।

সাপের বিষ উগরে দেয়ার মতো দলটি এখন তীব্র আক্রোশ ও ক্রোধ প্রকাশ করে চলেছে প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিপক্ষে। নেতারা বলছেন নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হয়েছে। ভোটের আগের রাতেই নাকি নির্বাচন কমিশন, আমলা-প্রশাসক ও পুলিশের সাহায্যে ৪০ ভাগ ব্যালটে নৌকার পক্ষে সিল মারা হয়ে গিয়েছিল। বিএনপির মতে ভোট ডাকাতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নাকি বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করে নিয়েছে।

নির্বাচনে কোনো কোনো কেন্দ্রে অনিয়ম, কারচুপি, ব্যালটে সিল মারা ইত্যাদি হওয়া বিচিত্র নয়। তবে অনেকের প্রশ্ন, বিএনপি যখন জানতেই পারল আগের রাতে ঊনচল্লিশ নয়, একচল্লিশ নয়, ঠিক চল্লিশ ভাগ ব্যালট পেপারে নৌকার সিল দেয়া হয়েছে, তখন তারা মধ্যরাতে কিংবা ভোটের দিন সকালে সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিষয়টি কেন ফাঁস করে দিলেন না? কেন নির্বাচন বয়কট করলেন না? এই প্রশ্নের উত্তর বিএনপিকেই দিতে হবে। আরো বলতে হবে ভোট হয়ে যাওয়ার দশ-বারোদিন পর কেন ভোট ডাকাতির গল্প বলা শুরু হয়েছে? বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নে এই দুটি ‘ধাঁধার’ জবাব বিএনপিকেই দিতে হবে।

বিএনপি নেতারা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার সময় বলেছেন জালিম আওয়ামী লীগ সরকারকে নীরব ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করতে দেশের জনগণ তথা ভোটার সাধারণ মুখিয়ে আছেন? ঐক্যফ্রন্টের মাহমুদুর রহমান মান্না একজন অলৌকিক অঙ্কবিদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নির্বাচনে ৪/৫টার বেশি আসন পাবে না। ঐক্যফ্রন্টের কেউ কেউ নির্বাচনের আগে আওয়ামী নেতাদের জান বাঁচাতে দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন।

আমাদের জানতে ইচ্ছে করে বিএনপি নেতারা কেন এসব কথা বলতেন? জনগণের সঙ্গে তো তাদের যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ ছিল। ভোটের প্রচার-প্রচারণা শিকেয় তুলে রেখে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা তো ভোটের দেন-দরবার করেছেন বিদেশিদের সঙ্গে। বিএনপি নেতাদের কাছে যেনবা ফালতু ছিলেন দেশের জনগণ, ক্ষমতায় বসার ট্রামকার্ড ছিল বিদেশিরা। এই ধরনের রাজনীতি জনগণের কাছে কেন গ্রহণযোগ্যতা পাবে? বিএনপি আগাগোড়া ভুল রাজনীতি করে আসছে। জনগণ কেন, কি কারণে বিএনপিকে ভোট দেবেন?

একই প্রশ্ন আওয়ামী লীগ সম্পর্কেও করা চলে। কেন জনগণ তথা ভোটার সাধারণ আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়ী করলেন? বিএনপির বর্জনের রাজনীতি এবং শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীনে অর্জনের রাজনীতি এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। গত দশ বছরে নানা অর্জনের ধারায় বাংলাদেশ এখন একটি সম্পূর্ণ নতুন দেশ।

২০০৮ সালের আগে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ বৈদেশিক মুদ্রা যেত চাল ও জ্বালানি তেল কিনতে। জ্বালানি তেল এখনো কিনতে হয়। তবে দেশের গ্যাস ও তেলে জ্বালানি তেলের বেশির ভাগ আমদানি কমে গেছে। কমপক্ষে ৬৫ ভাগ থেকে ৭০ ভাগ। বিদেশি মুদ্রার উল্লেখযোগ্য সাশ্রয় ঘটেছে। খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ হওয়াটাই তো অর্থনীতির বিশাল এক অর্জন।

এ ছাড়া মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় দেশ হতে পারা, আগের এক ফসলি জমির বছরে তিন ফসলি জমি হতে পারা, শাক-সবজি উৎদপানে বিশ্বের দ্বাদশ রপ্তানিকারক দেশ হওয়া, খাদ্যশস্যের চাল নির্ভরতা কমিয়ে গম ও ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যবহার উল্লেখযোগ্য রকম বাড়ানো- সবই নীরব কৃষি বিপ্লব সাধিত হওয়ার ঘোষণা দেয়।

উন্নয়নের সব কাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি কৃষি ও শিল্পে বাংলাদেশ গত দশ বছরে যেনবা পঞ্চাশ বছরের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কৃতিত্ব অবশ্যই পাওনা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার। কৃতিত্বের দাবিদার অবশ্যই চৌদ্দ দলীয় জোট সরকার।

টানা দশ বছরে দেশের মানুষ যখন এমন বিশাল উন্নয়ন ও বিপুল অর্থনৈতিক অগ্রগতি দেখে তখন নির্বাচনে তারা বিএনপিকে ভোট দেবে কেন? সতের বছর দেশ শাসন করেছে তারা। তাদের আমলে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার তেমন কোনো অর্জন নেই। তারপরও ভোটে নিজেদের পক্ষে নীরব ভোট বিপ্লব কীভাবে আশা করে বিএনপি।

রাজনীতিতে নানা ভোট ব্যাংক থাকে। সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংক, ধর্মীয় ভোট ব্যাংক, ভাসমান ভোট ব্যাংক। কেউ জাতীয় নির্বাচনে নিজেদের ভোট নষ্ট করতে চায় না। যখন তারা দেখে ভোটে জেতার জন্য দেশের জনগণের দ্বারস্থ হওয়ার বদলে বিএনপি নানা দেশে ধরনা দেয়, কূটনীতিকদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ায় এবং গণতন্ত্র ধ্বংসে আওয়ামী লীগ জোট সরকার কি কি কুকা- করেছে ও করছে সেই বৃত্তান্ত সাতকাহন করে বুঝাতে চেষ্টা করে তখন রাজনীতি সচেতন যে কেউ পরিষ্কার বুঝতে পারে বিএনপির রাজনীতি এখনো বর্জনের রাজনীতি, নালিশের রাজনীতি, ধ্বংসের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব বদলায় কিন্তু বিএনপির জিন্দাবাদের রাজনীতি একবিন্দু বদলায় না। বিএনপি-জামায়াত এই দুটি দল এক পরিবারভুক্ত। কথাটা আমার না, বিএনপির বর্তমান কর্ণধার তারেক রহমানের। ক্ষমতায় থাকতে একবার বগুড়া যাওয়ার পথে জামায়াত নেতা মুজাহিদের কাঁধে হাত রেখে কথাটা তিনি বলেছিলেন। প্রশ্ন হলো দেশের ভোটার সাধারণ স্বাধীন সার্বভৌম দেশের পক্ষে ভোট দেবে না যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক পরিবারকে ভোট দেবে?

বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল বলতে বক্তৃতা-বিবৃতি। জনগণের কাছে ভোট চাইতে যায় খুব কমই। বোধহয় তারা মনে করে দেশের জনগণ। ভোটার সাধারণ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে বিদায় দিতে মুখিয়ে আছে। কেন যে তারা এ রকমটি ভাবে তা তারাই জানে। গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির রাজনীতি সীমিত ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হুমকি-ধমকি এবং আজব ও ভিত্তিহীন এক আশাবাদে।

একই আসনে তিন-চারজনকে মনোনয়ন তালিকায় রেখে বাণিজ্য করার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে আছে। অথচ আওয়ামী লীগ ও তাদের জোট ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গেছে, উঠোন বৈঠক করেছে, পথসভা, জনসভা, মিছিল সবই করেছে তৃণমূল পর্যন্ত। জামায়াতকে বিএনপি এবার ২২টি ধানের শীষ মার্কা উপহার দিয়েছে। সব স্তরের জনগণ বিশেষ করে দেশের নতুন ভোটাধিকার পাওয়া তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের প্রতি বিএনপির এই ভালোবাসা মোটেও ভালো চোখে দেখেনি।

তরুণ প্রজন্ম, মহিলা, সংখ্যালঘু, ভাসমান ভোট ব্যাংকের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ভোট আওয়ামী লীগ পেয়েছে। এমনকি ধর্মীয় ভোট ব্যাংকের বড় বড় অংশের ভোট আওয়ামী লীগ পেয়েছে। গত জাতীয় নির্বাচনে ভোটের ফলাফল যা হওয়ার ঠিক তাই হয়েছে। বিএনপি এতদিন নির্বাচনে ধর্মীয় ভোট ব্যাংক এবং আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটারদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাদের আরো ছিল ভারতবিরোধী লোকদের ভোটের ভরসা।

সত্যি কথা বলতে গেলে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জনের ফলে বিএনপির প্রতি মানুষের এক ধরনের অনাস্থা- তদ্দরুন এক ধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। ভোটের আগের সমীকরণ বহুলাংশে বদলে গেছে। বিপুল ভোটে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় পাওয়া তাই আশ্চর্যের কিছু ছিল না।

বিএনপি নোঙরবিহীন এক দলে পরিণত হয়েছে। এই দলে বর্তমানে এমন কোনো জাতীয় স্তরের নেতা নেই যিনি বা যারা একদিকে দলকে সুসংগঠিত করতে পারেন অন্যদিকে জনগণের রাজনীতি নিয়ে তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন।

সেই ধরনের ক্যারিশমেটিক নেতা আওয়ামী লীগে আছেন শেখ হাসিনা। তার পথসভা পর্যন্ত বিশাল জনসভায় পরিণত হয়। আওয়ামী লীগে আরো আছেন মোহাম্মদ নাসিম, মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের, তোফায়েল আহমেদের মতো সব বড় নেতা। বিএনপিকে নির্বাচনে কেন ভোট দেবে মানুষ? আর নির্বাচনে ৬টা আসন জিতে অবাকই বা হয় কেন বিএনপি।

বিএনপি বলছে ভোটের আগের রাতেই ৪০ ভাগ ব্যালটে সিল মারা হয়ে গিয়েছিল। এটা তো তাদের কল্পনাপ্রসূত ধারণা মাত্র। তথ্যপ্রমাণ কোথায়? যারা ক্ষমতায় থাকলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সীমা-পরিসীমা থাকে না, জঙ্গি উত্থান হয় দ্রুত সময়ে, বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি তৈরি হতে থাকে।

দুর্নীতিতে বারবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় দেশের জনগণ জেনেশুনে তাদের ভোট দেবে কেন? আর যে দল ও জোট উন্নয়নের ধারার দেশকে শোচনীয় দারিদ্র্য ঘুচিয়ে ১০ বছরে বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত করে, তাদের জনগণ ভোট না দিয়ে কি পারবে?

বিএনপি শুধু নির্বাচনে নয়, নানা দিকেই হেরেছে। দলটি ঘুরে দাঁড়াক, সেটা মানুষ চায়। সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে অর্থহীন রাজনৈতিক অহঙ্কার ছাড়তে হবে। দলকে খোলনলচে পাল্টে যুগোপযোগী দলে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।

রাহাত খান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App