×

মুক্তচিন্তা

ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান ও শহীদ আসাদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:৩৯ পিএম

ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান ও শহীদ আসাদ
ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান ও শহীদ আসাদ

গণঅভ্যুত্থানের আত্মদানকারী আসাদকে স্মরণ করি, তখন প্রকৃতপক্ষে আমরা আসাদের চেতনাকে স্মরণ করি। কী ছিল সেই চেতনা! কৃষকের মধ্যে কাজ করে তিনি নিজেকে পরিশোধিত করতে চেয়েছেন। আসাদ বিশ্বাস করতেন, পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির জন্য প্রয়োজন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা।

আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে উত্তাল ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের সূচনালগ্নে স্বৈরাচার আইয়ুবশাহীর পুলিশের গুলিতে আসাদ নিহত হন। আসাদ ছিলেন বাম চিন্তাধারায় বিশ্বাসী একজন সক্রিয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী। ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি কৃষকদের মাঝেও কাজ করতেন।

১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী সারা পূর্ব বাংলায় হাট হরতাল আহ্বান করেন। প্রায় সারা দেশেই হাট হরতাল পালিত হয়। অনেক হাটেই হরতাল পালনকারীদের সঙ্গে পুলিশের কম-বেশি সংঘর্ষ হয়। সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ হয় নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলায় (তখন থানা)।

পুলিশের গুলিতে পাঁচজন আন্দোলনকারী নিহত হন এবং আসাদ মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। পুলিশের হত্যাকাণ্ডের খবর ঢাকার পত্রিকায় পৌঁছানোর জন্য আহত আসাদ সাইকেলে চেপে ঘোড়াশাল পৌঁছান এবং সেখান থেকে ট্রেনে ঢাকা আসেন। শেষ পর্যন্ত আসাদ দৈনিক পাকিস্তানের সাংবাদিক নির্মল সেন ও সাখাওয়াত আলী খানের কাছে হাতিরদিয়ায় পুলিশের নির্মম বর্বরতার ঘটনা তুলে ধরেন।

এই ঘটনার মাত্র ২২ দিন পরে ঢাকায় আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে আসাদ নিহত হন। নির্মল সেন পরবর্তী সময় লিখেছিলেন হত্যাকাণ্ডের সংবাদ দিতে এসে আসাদ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।

আটষট্টির ডিসেম্বর থেকেই তিনটি ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আবদুর রউফ ও খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা আর ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ।

মাহবুব উল্লাহর নামে মামলা থাকায় সে আত্মগোপনে ছিল। ব্যক্তিগতভাবে সেই কমিটির আমি ছিলাম সহসভাপতি ও দীপা দত্ত সহসম্পাদক। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) সঙ্গে আলোচনার সময় ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) পক্ষে মোস্তফা জামাল হায়দারের সঙ্গে দীপা দত্ত ও আমি উপস্থিত থাকতাম। এ ছাড়া ‘ডাকসুর’ পক্ষে উপস্থিত থাকতেন সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ (ছাত্রলীগ) ও সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী (এনএসএফ)।

নাজিম কামরান চৌধুরী যুক্ত থাকলেও এনএসএফ তখনো সাংগঠনিকভাবে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। যৌথ আন্দোলনের দাবি নিয়ে আলোচনার সময় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়, ছাত্রদের কর্মসূচিতে ছয়টা দফা থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য ছিল, ছাত্রদের দাবিও ছয় দফা হলে সবাই ভাববে এটা বুঝি আওয়ামী লীগেরই ছয় দফা। আগে দাবির বিষয়গুলো নির্ধারণ করতে হবে। পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে দফা কয়টা হবে।

দাবি নির্ধারণ করাও খুব সহজ কাজ ছিল না। আলোচনায় বহু বিতর্কিত বিষয় উঠে আসে। প্রথমে প্রস্তাব আসে শুধু ছাত্রদের সমস্যা সংক্রান্ত দাবিই উত্থাপন করা হবে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য ছিল, ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ‘ইস্যু’ যুক্ত করতে হবে দাবিনামায়। শ্রমিক, কৃষকের দাবি এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বক্তব্যও সংযুক্ত করার প্রস্তাব করি আমরা। শ্রমিক কৃষকের দাবির প্রশ্নে তেমন কোনো দ্বিমত দেখা দেয়নি।

কিন্তু প্রশ্ন দেখা দেয় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে। ছাত্রলীগের বক্তব্য ছিল ছাত্রদের দাবিতে সাম্রাজ্যবাদ আসবে কেন? অনেক আলোচনার পর ছাত্রলীগ প্রস্তাব দেয়, আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছাত্রদের দাবির একটা দফা করা হলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী একটা দাবি গ্রহণ করা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত যে এগারো দফা দাবিনামা গৃহীত হয়, তার তিন নম্বর দফাটি ছিল আওয়ামী লীগের ছয় দফা সংক্রান্ত এবং দশ নম্বর দফায় ছিল সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের কথা।

বহু আলোচনার ভিত্তিতে ছাত্রদের এগারো দফা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন তিনটি ছাত্র সংগঠনের নেতারা ডাকসু কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রথম এই এগারো দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। তবে এগারো দফা সংবলিত প্রথম প্রচারপত্রটি ছাপা হয় সংগ্রামী ছাত্র সমাজের নামে ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি। এতে স্বাক্ষর করেন আটজন।

এঁরা হচ্ছেন আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, সাইফুদ্দিন আহমেদ, সামসুদ্দোহা, মোস্তফা জামাল হায়দার, দীপা দত্ত এবং ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন এনএসএফের তেমন কোনো সমর্থন ছাত্রদের মধ্যে ছিল না।

তবে দাঙ্গা-সন্ত্রাসে তারা ছিল বেশ পটু। এনএসএফ প্রথম অবস্থায় এগারো দফা সমর্থন না করলেও পরে উপলব্ধি করে যে এগারো দফার পেছনে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। তখন মাহবুবুল হক দোলনের নেতৃত্বে একটা অংশ সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেয়। যেহেতু এগারো দফা প্রণয়নের সময় তারা উপস্থিত ছিল না, তাই তারা প্রস্তাব দেয় যে এগারো দফা পরিবর্তন করে দশ বা বারো দফা করতে হবে। তবে তাদের এই আবদার গ্রহণ করা হয়নি।

সদ্য প্রণীত এগারো দফার ব্যাখ্যা ও ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৪ জানুয়ারি ত্রিদলীয় ছাত্র কর্মিসভা অনুষ্ঠিত হয় তখনকার কলা ভবনের মধুর ক্যান্টিনের সামনের মাঠে। এই ছাত্র সভাতেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের এগারো দফা কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। সভায় সিদ্ধান্ত হয় এগারো দফা বাস্তবায়নের জন্য প্রথম সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল হবে ১৭ জানুয়ারি। তখন ১৪৪ ধারা জারি ছিল।

আমরা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মিছিল বের করার পক্ষে ছিলাম। ১৭ জানুয়ারি এখনকার কলা ভবনের বটতলায় বেশ বড় একটা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করি। মিছিলটি জগন্নাথ হলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অতর্কিতে পুলিশ মিছিলের ওপর আক্রমণ চালায়। বেশ কিছুক্ষণ পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের খণ্ড খণ্ড সংঘর্ষ চলে। ১৮ জানুয়ারি আবার কলা ভবনে সমাবেশ ও জঙ্গি মিছিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

আরো সিদ্ধান্ত হয় যে, সমাবেশে কোনো বক্তা থাকবে না। শুধুমাত্র ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ সূচনা বক্তব্য দিয়ে সবাইকে মিছিলে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাবেন। ১৯ জানুয়ারি রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। সেদিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা মিছিল বের হয়। মিছিলের ওপর গুলি হলে আবদুল হক নামে একজন নিহত হন। ২০ জানুয়ারি আবার সমাবেশের কর্মসূচি নেয়া হয়।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সূচনালগ্নে এক অবিস্মরণীয় দিন ২০ জানুয়ারি। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে আমরা মিছিল বের করি। মিছিলটা কলা ভবন থেকে বের হয়ে মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে যখন চাঁনখারপুল পার হচ্ছে, তখন হঠাৎ প্রচুর সংখ্যক পুলিশ মিছিলের মাঝখানে আক্রমণ চালায়। ফলে মিছিলটা দুই ভাগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

সামনের অংশ চাঁনখানপুল পার হয়ে নাজিমুদ্দিন রোড ধরে পুরান ঢাকার দিকে এগিয়ে যায়। বাকি অর্ধেক মেডিকেল কলেজের সামনে অবস্থান নেয়। এই অংশেই আসাদ ছিল, আমিও ছিলাম। প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রমণের মুখে ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেও ধীরে ধীরে আবার আমরা সংঘবদ্ধ হতে থাকি। আমরা মেডিকেল কলেজের মধ্যে অবস্থান নিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছুড়তে থাকি এবং আবার মিছিল বের করার চেষ্টা চালাই। পুলিশও পাল্টা ধাওয়া করে।

এইভাবে ঘণ্টাখানেক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। এ অবস্থায় খালেদ মোহাম্মদ আলী ও আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, যে কোনো অবস্থাতেই আমাদের মিছিল বের করতে হবে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সবাইকে জড়ো করে আমরা মেডিকেল কলেজ থেকে বের হয়ে পুলিশের বেষ্টনীর দিকে ধেয়ে যাই। তখন আসাদ আমার পাশেই ছিল। পুলিশের ওপর এই হঠাৎ আক্রমণ আর আক্রমণকারীদের জঙ্গিরূপ দেখে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। আমরা যখন প্রায় পুলিশের কাছাকাছি চলে এসেছি, তখন হঠাৎ কয়েকটা গুলির শব্দ শুনতে পাই।

দৌড়ানো অবস্থায়ই দেখলাম আসাদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। এদিকে পুলিশ ছাত্র-জনতার তাড়া খেয়ে চাঁনখারপুল পর্যন্ত পিছিয়ে গেছে। সেখানে পুলিশের দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকগুলোও রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়নপর। হুড়োহুড়ি করে ট্রাকে উঠতে গিয়ে তিনজন পুলিশ ট্রাক থেকে পড়ে যায়। ছাত্ররা তাদের ঘিরে ফেলে। আমি কিছুটা এগিয়ে আবার ফিরে আসি। দেখলাম চঞ্চল সেনসহ কয়েকজন আসাদের প্রাণহীন দেহটাকে ধরাধরি করে মেডিকেল কলেজের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে।

আসাদের মৃত্যুর খবর বিদ্যুৎ গতিতে সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মেডিকেল কলেজের ভেতরে-বাইরে জনতার ঢল নামে। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) পক্ষ থেকে প্রথম উচ্চারিত হয় এক নতুন স্লোগান- ‘আসাদের মন্ত্র, জনগণতন্ত্র’। আসাদের মৃত্যুর পর আন্দোলন-বিদ্রোহের দাবানলে রূপান্তরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

এক উত্তাল গণঅভ্যুত্থানে শামিল হয় ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতা। এই অভ্যুত্থান যারা প্রত্যক্ষ করেনি, বর্ণনা দিয়ে তাদের এর তীব্রতা আর ব্যাপকতা বোঝানো অসম্ভব। সংগ্রামরত জনতা আইয়ুব নাম ফলক ভেঙে তা শহীদ আসাদের নাম অনুযায়ী আসাদ গেট নামকরণ করে।

২৩ জানুয়ারি বিকেল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ছাত্র-জনতা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হতে থাকে। ঠিক সন্ধ্যার সময় পাঁচ-ছয়শ মশাল জ্বলে ওঠে। জনগণ স্থানীয়ভাবে মশাল জ্বালিয়ে মিছিলে অংশ নেয়। ২৪ জানুয়ারি। সেদিনও ১৪৪ ধারা বলবৎ ছিল। রাস্তায় রাস্তায় মেশিনগান হাতে মিলিটারি টহল দিচ্ছে। কিন্তু সব কিছু উপেক্ষা করে ঢাকা পরিণত হয়েছে মিছিলের শহরে।

আজিমপুরে ইডেন কলেজের হোস্টেলের সামনে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রীদের সংঘর্ষ হয়। সারা শহরে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের অনেকের হাতেই ছিল লাঠি ও অন্যান্য দেশি অস্ত্র। সেদিন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় তেরো বছরের রুস্তম, সতেরো বছরের মতিউর, পনেরো বছরের মকবুলসহ আরো অনেক তরুণ প্রাণ। এসব মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন অফিসের বড়কর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারীরা সবাই রাস্তায় নেমে আসে।

প্রশাসন সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। মনে হলো ক্ষমতা যেন জনতার হাতে চলে এসেছে। ২৪ তারিখ সন্ধ্যার পর থেকে ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় যে গণঅভ্যুত্থান হয়, পরবর্তী সময় তার উত্তাপ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রবল আন্দোলনে উত্তাল পূর্ব বাংলা। চারদিকে বিক্ষোভ আর বিক্ষোভ। ভাসানীর আহ্বানে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাট হরতাল চলছে। গ্রামে সাধারণ মানুষ সংগঠিত হয়ে গরু চোর আর স্থানীয় শোষকদের উচ্ছেদ করছে।

পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের (সভাপতি কাজী জাফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক হায়দার আকবর খান রনো) নেতৃত্বে শ্রমিক এলাকায় চলছে ঘেরাও আন্দোলন। বামদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’, ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েম করো’ স্লোগান। অপরদিকে আওয়ামী লীগ স্লোগান দিচ্ছে ‘জয় বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা’। এ সময় ভাসানী সারা দেশে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি নতুন স্লোগান তুললেন- ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না; তা হবে না, তা হবে না’।

আজ আমরা যখন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আত্মদানকারী আসাদকে স্মরণ করি, তখন প্রকৃতপক্ষে আমরা আসাদের চেতনাকে স্মরণ করি। কী ছিল সেই চেতনা! তিনি বিশ্বাস করতেন, শহরের মধ্যবিত্তের মধ্যে তিনি যত কাজই করুন না কেন, নিজস্ব শ্রেণির দুর্বলতাগুলো রয়ে যায়।

কৃষকের মধ্যে কাজ করে তিনি নিজেকে পরিশোধিত করতে চেয়েছেন। আসাদ বিশ্বাস করতেন, পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির জন্য প্রয়োজন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা।

কিন্তু শুধু বিচ্ছিন্ন হওয়াই যথেষ্ট নয়। জাতীয় মুক্তি ও শোষণমুক্তি- দুটো লক্ষ্যই অর্জন করতে হবে। একমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তা অর্জন করা সম্ভব। সেজন্য গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মাঝে কাজ করতে হবে- গড়ে তুলতে হবে সশস্ত্র গেরিলা ঘাঁটি। আসাদ তার স্বপ্নের বাস্তবরূপ দেখে যেতে পারেননি।

হায়দার আনোয়ার খান জুনো : বাম রাজনীতিক, সংস্কৃতি সংগঠক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App