×

মুক্তচিন্তা

প্লাস্টিক পণ্য বাজার অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৩৯ পিএম

সরকার দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে নানমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। এ জন্য প্রণোদনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় খেলনা শিল্পের উন্নয়নে প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা। খেলনা শিল্পের উদ্যোক্তা, প্রস্তুতকারীদের প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় ১৭-২০ জানুয়ারি চার দিনব্যাপী ১৪তম আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক পণ্যমেলা শেষ হয়েছে গতকাল। এবারের মেলায় ১৯টি দেশের প্লাস্টিক পণ্য খাত সংশ্লিষ্ট ৪৮০টি কোম্পানি ৭৮০টি স্টল ও বুথ নিয়ে অংশগ্রহণ করেছে। চার দিনব্যাপী এ মেলায় মেশিনারিজ, মোল্ড, কাঁচামাল উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে।

প্লাস্টিক শিল্পের সব ধরনের প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও নতুন পণ্য মেলায় প্রদর্শন করা হয়েছে। বর্তমানে প্লাস্টিক খাতে মোট ১২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। এ খাতকে আরো শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক এসোসিয়েশনের উদ্যোগে একটি ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি প্লাস্টিক শিল্পের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে প্লাস্টিক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্লাস্টিক রপ্তানি ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশ থেকে প্লাস্টিক পণ্য আমদানি বাড়িয়েছে। ফলে বাংলাদেশের প্লাস্টিক শিল্পের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল। বাংলাদেশের প্লাস্টিক পণ্যের বাজারের আকার ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ বাজার থেকে সরকার ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করছে।

রপ্তানি খাতে প্লাস্টিক পণ্যের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়। কারণ প্রতি বছর রপ্তানি বাড়ছে। বর্তমান ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে প্রায় রেজিস্টার্ড দেড় হাজার কারখানা রয়েছে প্লাস্টিকের। দেশে মাথাপিছু এখন ৫-৬ কেজি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে যার পরিমাণ হবে প্রায় ৩৪ কেজি। তাই সরকারের ভিশন ও এসডিজি বাস্তবায়নে এ খাত উন্নয়নে নীতি সহায়তা প্রয়োজন।

রপ্তানিতে এ খাতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যাদের বন্ড লাইসেন্স রয়েছে কিংবা ইপিজেডে কারখানা রয়েছে তারা এ সুবিধার বাইরে রয়েছেন। আগামীতে ছোট-বড় সবার জন্য এই সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বর্তমান ৫৭টি দেশে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। উদ্যোক্তারা রপ্তানির বিষয়টি মাথায় রেখে গ্রিন ফ্যাক্টরি ও কমপ্লায়েন্সে সর্বোচ্চ জোর দিচ্ছেন। এ ছাড়া চীনের পর এখন বাংলাদেশে খেলনা সামগ্রী উৎপাদনে বেশ এগিয়ে গেছে। এই অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হলে খেলনা ইন্ডাস্ট্রি সম্পূর্ণ ভ্যাটমুক্ত করতে হবে। আগামী বাজেটে এ বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি জোর দিবে বিপিজিএমইএ।

প্লাস্টিক কখনো বর্জ্য পণ্য হয় না। রিসাইক্লিন করে আবার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই সংগ্রহের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেন, তাদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তারা সচেতন হলে কালেকশনটি ভালো হবে।

বর্তমান দেশে ২৫ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। সরকারের কোষাগারে প্রতি বছর রাজস্ব যোগ হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর দেশ ও দেশের বাইরে প্রায় ২০ শতাংশ হারে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। সরকার এ খাত উন্নয়নে কেরানীগঞ্জ ও আড়াই হাজারে দুটি প্লাস্টিক শিল্পনগরী গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প-২১ এবং উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণে রূপকল্প-৪১ বাস্তবায়নের জন্য যে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের প্রয়োজন তা প্লাস্টিক শিল্প খাতে অনেকটা সম্ভব। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে দেশ এখন শিল্পনির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে বর্তমান প্রায় ৫ হাজার প্লাস্টিক শিল্পকারখানায় প্রতি বছর ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করছে।

রপ্তানি বাজার ধরে রাখতে কারখানা কমপ্লায়েন্স হওয়া জরুরি। এ লক্ষ্যে শিল্পের কারখানাগুলো কমপ্লায়েন্স করতে আলাদা প্লাস্টিক শিল্পনগরী চাওয়া হয়েছে। গার্মেন্টসের কারণে রপ্তানিতে জিএসপি হারিয়েছে প্লাস্টিক শিল্প খাত। এ কারণে কারখানা কমপ্লায়েন্সে এখন সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। এ শিল্প খাত উন্নয়ন এবং কাঁচামাল আহরণে রিসাইক্লিনটা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনকে উদ্যোগী হতে হবে। পুরান ঢাকায় ইতোমধ্যে বেশকিছু রিসাইক্লিন কারখানা গড়ে উঠেছে।

এদিকে গার্মেন্টসের জন্য জিএসপি স্থগিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের প্লাস্টিক শিল্প খাত। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কখনই পোশাক রপ্তানিতে জিএসপি সুবিধা ছিল না। কিন্তু এই সুবিধা স্থগিত হওয়ার ফলে সরাসরি আঘাত আসে প্লাস্টিক শিল্পের ওপরে। তবে আশার কথা হলো এত বাধার পরও ঘুরে দাঁড়িয়েছে এ শিল্প খাত। রপ্তানিতে জায়গা করে নেয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাচ্ছে শতভাগ। অভ্যন্তরীণ বাজারে শক্ত ভিত গড়ে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। বিশ্বের দাবি ব্র্যান্ড কোকাকোলাও বাংলাদেশি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করছে।

আমাদের এখানে কয়েক বছর আগেও কম মূল্যের প্লাস্টিকের খেলনার প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। কিন্তু গত কয়েক বছরে অবস্থা অনেকটা বদলেছে। বর্তমানে এ সব খেলনার বিরাট একটি অংশই তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প হিসেবে খেলনা তৈরির বিভিন্ন কারখানা গড়ে উঠছে পুরান ঢাকা এবং আশপাশের কিছু এলাকায়। মূলত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং ব্যস্ততম খেলনার বাজার পুরান ঢাকার চকবাজারে। কয়েক বছর আগেও প্লাস্টিকের খেলনার প্রায় পুরোটাই আসত চীন ও তাইওয়ান থেকে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে ভালো একটি জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশে তৈরি খেলনা সামগ্রী। দেশে বিভিন্ন ধরনের খেলনার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে এ শিল্পে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ। এখনো বাংলাদেশে খেলনার বাজার অনেকটাই আমদানিনির্ভর। তবে বাংলাদেশে ছোটদের জন্য খেলনা তৈরির মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। খেলনা প্রস্তুতকারী দেশীয় বিভিন্ন কারখানা এবং প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে এই শিল্প দ্রুত বিকশিত হয়ে বিরাট অবদান রাখতে পারে দেশীয় অর্থনীতিতে।

এক সময়ে বাংলাদেশে খেলনা সামগ্রী হিসেবে অনেক নিম্ন মানের পণ্য তৈরি হতো। যা ক্রেতাদের তেমনভাবে আকৃষ্ট করত না। ফলে বিদেশ থেকে খেলনা আমদানি করা হতো, যার বেশিরভাগই আমদানি হতো চীন থেকে। তবে বর্তমানে চীন থেকে আমদানিকৃত খেলনার সমমানের অনেক খেলনা আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে। দেশে উন্নত কারিগরি প্রযুক্তির অভাব থাকায় খেলনা শিল্প তেমন এগিয়ে যেতে পারছে না, বারবার হোঁচট খাচ্ছে।

দেশীয় লেদ কারখানা থেকে ম্যানুয়ালি মোল্ড তৈরি করতে হচ্ছে। অথচ বিদেশে কম্পিউটারাইজড মেশিনে এ ধরনের মোল্ড তৈরি করা হয় অত্যন্ত নিখুঁত এবং সুন্দরভাবে। আজকাল অনেক ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা চীন ও তাইওয়ান থেকে মোল্ড বা ডাইস করে নিয়ে আসছেন। ডাইস তৈরির কম্পিউটারাইজড মেশিন দেশে থাকলে বাংলাদেশেই অনেক সুন্দর, উন্নত এবং আধুনিক মানের খেলনা তৈরি সম্ভব।

এতে করে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ভালো ভালো খেলনা সামগ্রী তৈরি করে বাজারে ছাড়া সম্ভব হবে। সুলভে ডাইস তৈরি করা গেলে চীনা বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে তৈরি খেলনা আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন ভালো ডাইস ডিজাইনার। দক্ষ, আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন ডিজাইনারেরও অভাব রয়েছে এখানে। শুধুমাত্র ডাইস দিয়ে খেলনা তৈরি করলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না, এর সঙ্গে আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন রয়েছে।

এই শিল্প যদি দিনে দিনে উন্নতি লাভ করে তাহলে আরো অনেকেই আগ্রহী হবেন এ ব্যাপারে। এ ব্যবসায় উদ্যোক্তা বাড়তে থাকলে শিল্পটি আপনা আপনি বেশ জমজমাট হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। খেলনা তৈরির কাজটি মূলত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন ব্যাংক এসএমই ঋণের আওতায় খেলনা তৈরির কাজে নিয়মিত উদ্যোক্তাদের সহজশর্তে মূলধন জোগান দিতে পারে। কারণ অনেক উদ্যোক্তা পর্যাপ্ত পুঁজির অভাবে দারুণ সম্ভাবনাময় এই শিল্পটিকে এগিয়ে নিতে পারছেন না। পুঁজির জোগান পেলে খেলনা শিল্প চাঙা হয়ে উঠতে পারে খুব দ্রুতই।

এখনো বাংলাদেশের বাজারে চীনা ও তাইওয়ানের খেলনা সামগ্রীর বেশ ভালো দাপট বজায় রয়েছে। কিন্তু তারপরও অনেক উদ্যোক্তা সাহস নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। তারা ছোট ছোট খেলনা তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছেন নিজেদের বাসা বাড়িতেই। স্বল্প পুঁজি খাটিয়ে মোটামুটি উপার্জন করছেন। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রয়োজনীয় কারিগরি সহযোগিতা পেলে আন্তর্জাতিক মানের খেলনা সামগ্রী এ দেশেই তৈরি সম্ভব।

তখন খেলনা বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা যাবে। খেলনা শিল্পটিকে এসএমই খাতের আওতায় এনে প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণদানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকার দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে নানমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। এ জন্য প্রণোদনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় খেলনা শিল্পের উন্নয়নে প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতা। খেলনা শিল্পের উদ্যোক্তা, প্রস্তুতকারীদের প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

রেজাউল করিম খোকন : লেখক ও ব্যাংকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App