×

জাতীয়

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অগ্রগতি নেই ৭ কারণে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:০৬ এএম

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অগ্রগতি নেই ৭ কারণে
আন্তর্জাতিক বিশ্বের বিভক্তি, এনজিওগুলোর নেতিবাচক প্রচারণা, রাখাইনে বসবাসের ঝুঁকি, বাংলাদেশে বসবাস ও চলাচলে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, পরিচয় গোপন করে বিদেশ যাওয়ার সুযোগসহ প্রধান সাতটি কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগে অগ্রগতি নেই। সংশ্লিষ্ট একাধিক মাধ্যম এ খবর নিশ্চিত করেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় প্রথম দফায় ৫ হাজার রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। মিয়ানমারের প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্টরাও এই প্রস্তুতির কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। তবে এদের সবাইকে একসঙ্গে নেয়া হবে না। প্রতিদিন ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়া হবে। ৩০টি রোহিঙ্গা পরিবারের ১৫০ জন সদস্যকে প্রত্যাবাসন কমিশন মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য তালিকাভুক্ত করে। কিন্তু তাদের অনিচ্ছার কারণে বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তের ট্রানজিট ক্যাম্পে হাজির করা যায়নি। ফলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। সূত্র জানায়, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা ও রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছার মুখে পুরো প্রক্রিয়া থমকে যায়। বর্তমান নতুন সরকার দায়িত্ব লাভের পরে এখনো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো কথা বলেনি। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা কক্সবাজারে ১০ বছরের চুক্তিতে বড় আকারের বাড়ি ভাড়া নেয়ার জন্য অতি সম্প্রতি একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছে। এই বিজ্ঞাপন দেখে অনেকটাই আঁচ করা যায় যে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজেই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যদি সহজেই রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা নেয়াই হয়, তাহলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এই বিজ্ঞাপনের অর্থ কী? এই অবস্থায় সবারই প্রশ্ন ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কতদূর?’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা নিজ ভ‚মিতে ফিরে যেতে রাজি না হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। বিপুল হারে ত্রাণসামগ্রী পাওয়া, বাংলাদেশে বসবাস ও চলাচলে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, দেশি-বিদেশি এনজিওদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করা, রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া, পরিচয় গোপন রেখে দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ যাওয়ার সুবিধা থাকা অন্যতম কারণ। রাখাইন থেকে আসা রোহিঙ্গারা সহজেই এই সুবিধাগুলো হাতছাড়া করতে চায় না। তারা প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করে মিয়ানমারে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তাসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবি তুলে সব ধরনের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নস্যাৎ করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ইউএনএইচসিআর প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করছে। সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ইতিবাচক কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য মো. আবুল কালাম বলেন, গত নভেম্বরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া স্থগিত হওয়ার পর নতুন কোনো পদক্ষেপ এখনো নেয়া হয়নি। এটি রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক নীতির বিষয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করছে। নতুন সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আমরা এখন পর্যন্ত নতুন কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে কার্যক্রম থেমে নেই। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। সরকারের নির্দেশনা পেলেই আমরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করব। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, গত ১৫ নভেম্বরের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নির্বাচনের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। এখন নতুন সরকার এসেছে। আশা করা হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আলোচনা হবে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার কারণ হিসেবে কক্সবাজারের বিশিষ্টজনরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিওর নেতিবাচক প্রচারণাকে দায়ী করেছেন। এসব সংস্থার লোকজন রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করছে বলে তারা প্রকাশ্যেই অভিযোগ তুলছেন। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে এনজিওদের দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য বন্ধ হবে। রোহিঙ্গারা যতদিন থাকবে, ততদিনই তাদের রমরমা ব্যবসা চলবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্যানিটেশন, আবাসন, খাদ্যসামগ্রীর ত্রাণ, পানি সরবরাহসহ নানাবিধ কার্যক্রমের সঙ্গে এনজিওরা জড়িত। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজের সুবিধার্থে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আঁচ পাওয়া গেছে। কয়েক দিন আগে এই সংস্থাটি অফিস খোলার জন্য কক্সবাজারে ৭ হাজার স্কয়ার ফিটের বাড়ি ১০ বছরের জন্য ভাড়া চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। বাড়ির সামনে ১৫টি পাজেরো জিপ পার্কিংয়ের মতো খোলা জায়গাও থাকতে হবে। অন্যান্য এনজিও জনবল বাড়ানোর লক্ষ্যে ৩ থেকে ৪ বছরের চুক্তিতে নতুন কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। উখিয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, এনজিও ও দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা যুগের পর যুগ জিইয়ে রেখে ব্যবসা করতে চাইছে। নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত দেশি বিদেশি দাতা সংস্থা ও এনজিও প্রতিনিধিরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বানচালের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর দেখভালের জন্য দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এই বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতেই এনজিওরা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চায় না। কক্সবাজারের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিরা ভোরের কাগজকে জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা ও রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছা উপেক্ষা করে শুরু করা কঠিন। দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক এনজিওর কর্মীরা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন কাজ করেন। এই কর্মীরা নানাভাবে রোহিঙ্গাদের প্রলুব্ধ করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া জটিল করে ফেলেছেন। ফলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর ফিরে যেতে আগ্রহী থাকলেও এখন তারা মারমুখী অবস্থায় রয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে একে ‘অপরিপক্ব’ সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছে। গত নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচলেট উদ্বেগ প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করা উচিত। কারণ, মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করেছে। এই অবস্থায় রোহিঙ্গারা রাখাইনে নিরাপদ নয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার এই বিবৃতির প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সমর্থন জানিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App