×

মুক্তচিন্তা

কী বার্তা দিয়ে গেলেন সৈয়দ আশরাফ?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৩১ পিএম

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের কথা। আমি তখন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র। কলেজে যাওয়ার পথে দেখা পেতাম একটি নড়বড়ে টিনের বাড়ির। বাড়িটি প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এবং ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ জেলখানায় নিহত জাতীয় চার নেতার একজন সৈয়দ নজরুল ইসলামের। সৈয়দ নজরুল এক সময় আনন্দমোহন কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, পরে যোগ দেন আইন পেশায়।

সেটিও ঠিকঠাক মতন করা হয়ে উঠছিল না রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে। বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের লোক ছিলেন তিনি। অর্থ রোজগারের চাইতে ত্যাগের দীক্ষা বেশি থাকার কারণেই বোধহয় বাড়িটির ওই দৈন্যদশা ছিল। সেই বাড়ির সন্তান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। মৃত্যুর পর তার চারিত্রিক মাহাত্ম্য নিয়ে সমাজের সর্বত্র যে গুঞ্জরণ তার প্রবাহ অনেকটাই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।

সাম্প্রতিককালে যত রাজনীতিকের মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যু জনমনে সাড়া ফেলেছে ব্যাপক। মনে হচ্ছে যেন গোটা দেশ শোকে কাতর। বিভাজনের রাজনীতির চিরায়ত দৃশ্য এ ক্ষেত্রে ম্রিয়মাণ; দলমত নির্বিশেষে সচেতন সব মানুষের মুখে আফসোস-ধ্বনি। কফিন দেশে পৌঁছতে না পৌঁছতেই বিমানবন্দর, বেইলি রোডের সরকারি বাসা অগুনতি মানুষে ঠাঁসা। ঢাকায় সংসদ ভবনের জানাজায় বিপুল মানুষের উপস্থিতি।

কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ দেশের বৃহত্তর প্রান্তর। সেখানে অনুষ্ঠিত জানাজায় তিলধারণের ঠাঁই নেই। ময়মনসিংহের ঈদগাহ ময়দানের তৃতীয় জানাজায়ও লোকে লোকারণ্য। সৈয়দ আশরাফের প্রতি মানুষের ভালোবাসা যে কতটা গভীর ছিল তা এরপর আর বলে বোঝানোর দরকার নেই। কেন এই ভালোবাসা? দেলের নেতাকর্মীদের প্রতি সৈয়দ আশরাফের গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ ছিল, রাজনীতি করতে চাইলে দুর্নীতি ছাড়তে হবে আর দুর্নীতি করলে রাজনীতি ছাড়তে হবে- এর পুনরুল্লেখ করছিলেন কোনো কোনো নেতা জানাজা-পূর্ব আলোচনায়।

এই উপদেশের বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। তিন-তিনটি জানাজায় এত বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি অতীতে কেউ প্রত্যক্ষ করেছেন কিনা জানি না, আমি করিনি। তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা এর কারণ এ কথা সবাই বলবেন। আর সেই ভালোবাসার প্রধান উৎস হচ্ছে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি। মানুষ সৈয়দ আশরাফের নির্মোহ-নিরহঙ্কারী স্বভাব, সাদামাটা ও নির্বিরোধ জীবনযাপন এবং সততার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। তাই দলমত নির্বিশেষে হাজির থেকেছে জানাজায়।

দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি বিষয়ক দাবির সঙ্গে মানুষের তেমন দ্বিমত নেই। মানুষ এখন যা চায় তা হলো সুশাসন ও দুর্নীতির অপসারণ। সুশাসনের অর্থ হলো নিয়মনীতির শাসন। শাসন ব্যবস্থায় নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা করা গেলে দুর্নীতি আপনাতেই হ্রাস পাবে। আসলে দুর্নীতির সমূল বিনাশ অনেকটাই সাধ্যাতীত ব্যাপার, একে সহনীয় রাখতে পারলেই হলো; মানুষ তাতেই খুশি থাকবে।

শাসক দল আওয়ামী লীগ যে মানুষের মনের কথা জানে না, তা নয়। জানে আর জানে বলেই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নির্মূলের কথা, তথা দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছে। এখন তার বাস্তবায়ন দেখতে চায় মানুষ। এখানে সৈয়দ আশরাফ আদর্শের প্রতীক হয়ে সামনে আসতে পারেন। রাজনীতি থেকে দুর্নীতি বিদায় হলে সুফল আসতে দেরি হবে না।

তবে পাশাপাশি প্রয়োজন হবে সুচিন্তিত পদক্ষেপ, নতুন কর্মকৌশল উদ্ভাবন ও কার্যকর সিস্টেমের বেষ্টনী। মনে রাখতে হবে, অবৈধ উপায়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার মধ্যেই কেবল দুর্নীতি সীমাবদ্ধ নয়, নীতি-আদর্শের ব্যত্যয় ঘটানোও দুর্নীতির পর্যায়ভুক্ত। স্মরণ রাখা আবশ্যক যে সততার পাশাপাশি কর্মদক্ষতা বা বিচক্ষণতা না থাকলে সফলতা লাভ করা অসম্ভব। এটিও অর্জনের ব্যাপার।

সৈয়দ আশরাফ সম্পর্কে বলতে গেলে দুটি বিষয়ের অবতারণা না করলেই নয়, যদিও বিষয় দুটি গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে আলোচিত। একটি ২০০৭ সালের ঘটনা; সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন ক্ষমতায়, শেখ হাসিনা অন্তরীণ জেলে। জিল্লুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে সৈয়দ আশরাফ দলকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। দ্বিতীয়টি ২০১৩ সালের ঘটনা, হেফাজতে ইসলামের উগ্র সমাবেশে ঢাকা শহর প্রকম্পিত। সৈয়দ আশরাফের বলিষ্ঠ ভূমিকায় অবস্থান পণ্ড হয়। এই বিচক্ষণতা তিনি অর্জন করেছিলেন অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন দ্বারা।

লেখাটি শেষ করতে চাই একটি ঔদার্যের উদাহরণ দিয়ে। আমার এক বন্ধু সৈয়দ আশরাফের খুব ঘনিষ্ঠজন ছিল। দুরারোগ্য এক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে সে পেশাশূন্য হয়ে পড়ে। চিকিৎসার খরচ জোগানো তার পক্ষে দুরূহ হয়ে উঠেছিল। এ অবস্থায় সৈয়দ আশরাফের কাছে গেলে অসুস্থতার খোঁজখবর নেয়ার পর নিজে থেকেই অর্থকড়ি হাতে যা থাকতো তাকে দিয়ে দিতেন। বন্ধুটি একাধিকবার এ কথা আমাকে বলেছে। আমার সেই বন্ধুটি জীবিত নেই, জীবিত নেই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও। কিন্তু তার এই ঔদার্যের দৃষ্টান্তটি গেঁথে আছে আমার মনে। এরকম মনমানসিকতা আমাদের ক’জনার আছে?

মজিবর রহমান : প্রাবন্ধিক ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App