×

মুক্তচিন্তা

বিশাল বিজয়, বিরাট চ্যালেঞ্জ ভরসা শেখ হাসিনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:২৫ পিএম

সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সরকারের সামনে বড় সম্পদ হিসেবে আছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা এখন নিছক একজন দলীয় প্রধান নন, তিনি একাধারে সরকার প্রধান এবং বিশ্বদরবারে তিনি একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। কাজেই তার হাতে যখন দেশ পরিচালনা ভার অর্পিত হয় তখন নাগরিকরা কিছুটা নির্ভার থাকতেই পারেন। শেখ হাসিনা তিন মেয়াদে সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করে যেমন নিজের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনি নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষরও রেখেছেন।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিশাল জয় পেয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট। এই বিজয় ছিল কাক্সিক্ষত এবং প্রত্যাশিত। শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হবেন, আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে আসবে- এ নিয়ে দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকদের মধ্যে খুব একটা সন্দেহ-সংশয় ছিল বলে মনে হয় না।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও শেখ হাসিনার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল। ক্ষমতায় ফিরে আসা নিয়ে আওয়ামী লীগেরও আস্থা এবং আশাবাদ ছিল। ছিল রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি। পুঁজি ছিল দশ বছরের শাসনকালের ব্যাপক উন্নয়ন। অর্থনৈতিক-সামাজিক খাতের উন্নতি। শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে সাফল্য। ব

ছরের প্রথম দিন লাখ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই তুলে দেয়া। কয়েক লাখ অসহায়, দরিদ্র নারী-পুরুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে এসে তাদের জীবনে পরিবর্তন আনা- এসব কিছুই ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় ফিরে আসার নিয়ামক শক্তি। পদ্মা সেতুসহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে শেখ হাসিনা হয়ে উঠেছেন নতুন এক বাংলাদেশের রূপকার। কাজেই তিনি আবার নির্বাচিত হচ্ছেন এটা ছিল এক নিশ্চিত বিষয়।

তবে আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা প্রায় সব আসনে জিতবে, বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের এমন শোচনীয় পরাজয় হবে, তারা ছয়টি বিভাগ থেকে একেবারে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে সেটা কারো ধারণায় ছিল না।

নির্বাচনের আগে প্রথমদিকে শোনা গিয়েছিল, আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। তবে এবার সংসদে বিরোধী দলের শক্ত অবস্থান থাকবে। একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতিতে একটি প্রাণবন্ত সংসদ আমরা পেতে চলছি। বিরোধী দলের আসন একশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

তারপর শোনা গেল, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী হোমওয়ার্ক এতটাই ভালো যে তাদের পক্ষে অনায়াসে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব। চূড়ান্ত নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হলে দেখা গেল বিএনপি তার ফ্রন্ট-জোট নিয়ে সেভাবে নির্বাচনের মাঠে নেই। কিছুটা একতরফাভাবেই ভোটের মাঠ আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। বিএনপি ৫০টির বেশি আসন পায় কিনা তা নিয়ে পর্যবেক্ষক মহলে সংশয় তৈরি হলো।

এভাবেই শেষ পর্যন্ত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হলো এবং আওয়ামী লীগের মহাজোটের ঝুড়িতে ২৮৮ আসন। ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮ আসনের ফলাফলে মাত্র ৫+২ আসন পেয়ে বিএনপি প্রায় নিশ্চিহ্ন। বিএনপির এমন পরাজয়, এমন ভড়াডুবি কি প্রত্যাশিত ছিল? বিএনপির এমন শোচনীয় হারের কথা কেউ ভাবেনি। তারপরও এটা হলো এবং মানতে মন না চাইলেও এই ফল না মেনেও কারো কোনো উপায় নেই। বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। নতুন নির্বাচনের দাবি করেছে।

তবে এই দাবি আদায়যোগ্য বলে কেউ মনে করছে না। এই নির্বাচনী বিপর্যয় মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল নির্ধারণ করতে হবে বিএনপিকে। এখনই আওয়ামী লীগের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি-সামর্থ্য বিএনপির নেই। বিএনপি এখন নানামুখী সংকটে জর্জরিত। দল অগোছালো, এলোমেলো। দলের অভ্যন্তরে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট তীব্র।

খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের অনুপস্থিতি বিএনপিতে একদিকে যেমন নেতৃত্বের সংকট তৈরি করেছে, অন্যদিকে একটি সম্ভাবনার দিকও উন্মোচন করেছে। বিএনপি চাইলে একটি নতুন রোডম্যাপ তৈরি করে দল গোছানোর কাজে হাত দিতে পারে, আবার জোড়াতালি দিয়ে সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায়ও থাকতে পারে। বিএনপিকে প্রথমেই আত্মসমালোচনা করতে হবে। তাদের বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে হবে, বুঝতে হবে। কেবল সরকার তাদের বিজয় কেড়ে নিয়েছে, আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছে, এসব অভিযোগ করলেই হবে না।

আওয়ামী লীগ যদি ভোটে কোনো অনিয়ম করে থাকে তাহলে সেটা কীভাবে এত দক্ষতার সঙ্গে করতে পারল সেটাও বিএনপিকে বুঝতে হবে। রাজনীতিতে কৌশলের খেলায় বিএনপি কেন বারবার হারছে, আওয়ামী লীগ কীভাবে তাদের বারবার ঘোল খাওয়াতে পারছে, সেটাও বিএনপিকে বুঝতে হবে।

বিএনপি এত জনসমর্থন নিয়েও কেন শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারছে না- এই আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন না হয়ে বিএনপির কোনো উপায় নেই। বিএনপির রাজনীতির নীতিকৌশলেই ভুল আছে। অন্ধ আওয়ামী লীগবিরোধিতা, শেখ হাসিনা বিরোধিতা, ভারতবিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতাকে সম্বল করে রাজনীতিতে আর টিকে থাকা যাবে কিনা তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।

আওয়ামী লীগের বিপরীতে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর যে সম্ভাবনা বিএনপির ছিল তা ক্রমাগত ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বানচাল হতে চলেছে। বিএনপি দুর্বল হওয়া মানে আওয়ামী লীগ প্রতাপশালী হয়ে ওঠা।

এবার আওয়ামী লীগকে শক্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। টানা দশ বছর ক্ষমতায় থাকায় জনগণের একাংশের মধ্যে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষাও ছিল। কিন্তু বিএনপি জনপ্রিয়তার মেকি আস্থায় অতিরিক্ত আশাবাদী হয়ে কোনো সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারেনি। বিএনপি ধরে নিয়েছিল মানুষ তাদের ভুলভাল কথায় আস্থা রাখবে। মানুষের মনোজগতের পরিবর্তনের বিষয়গুলো বিএনপি নেতাদের রাডারে ধরা পড়েনি।

তবে এটা ঠিক যে, বিএনপি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে না পারলেও আওয়ামী লীগের সামনে কিন্তু বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। বিশেষ করে বিস্ময়কর বিজয় আওয়ামী লীগকেও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বড় জয় মানে বড় দায়িত্ব। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে যে ইশতেহার ঘোঘণা করেছে তার বাস্তবায়নে এখন মনোযোগী হতে হবে। কোনো কিছু হেলাফেলা করা চলবে না। পান থেকে চুন খসলেও মানুষ সমালোচনা করবে। মানুষের প্রত্যাশা এখন অনেক বেশি। আওয়ামী লীগ আমলে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়, এটা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় নেই। কিন্তু মানুষ শুধু উন্নয়ন চায় না। দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার মানুষের মধ্যে বিরূপতা তৈরি করে, করবে। সুশাসন চায়। তাই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এবার আওয়ামী লীগকে সুশাসন দিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। যে কোনো অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন থাকতে হবে।

বিপুল বিজয় যেন কোনোভাবেই আওয়ামী লীগকে বেপরোয়া না করে তোলে। আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী-সমর্থক আছেন যারা নিজেদের আখের গোছাতে গিয়ে দলকে বিপাকে ফেলেন, দলের নেত্রীর সুনামহানির কারণ ঘটান। ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। এমন কাউকে এবং এমন কিছু প্রশ্রয় দেয়া চলবে না, যার জন্য দল এবং দলনেত্রী বদনামের ভাগীদার হতে পারে।

পরের নির্বাচনের বিষয়টি যদি এখন থেকেই মাথায় রাখা যায় তাহলে হয়তো স্খলন-পতনের আশঙ্কা কম থাকবে। একবার, দুইবার, তিনবার। পরপর তিনবার যা, যেভাবে সহজ হয়েছে চারবারের বার তা সেভাবে নাও হতে পারে। আগামী নির্বাচনের আগে যেন দলনেত্রীকে সহকর্মীদের ভুলত্রুটির জন্য ভোটারদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হতে না হয়। এখন থেকেই সেদিকটিতে নজর রাখতে হবে।

দেশে যে বিরোধী দল এত দুর্বল সেজন্য আওয়ামী লীগের খুব উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। বিরোধী দল না থাকা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য তেমন স্বাস্থ্যকর নয়। দায়িত্বশীল বিরোধী দলের অনুপস্থিতি গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য মস্ত অন্তরায়। বিরোধী দলের প্রতি সহনশীলতা দেখাতে হবে। বিরোধী মত, যেটা জনস্বার্থের জন্য ক্ষতিকর নয়, প্রচারে বাধা দেয়া চলবে না। নারীর প্রতি সব প্রকার সহিংসতা দূর করতে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সরকারের সামনে বড় সম্পদ হিসেবে আছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা এখন নিছক একজন দলীয় প্রধান নন, তিনি একাধারে সরকার প্রধান এবং বিশ্বদরবারে তিনি একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। কাজেই তার হাতে যখন দেশ পরিচালনা ভার অর্পিত হয় তখন নাগরিকরা কিছুটা নির্ভার থাকতেই পারেন। শেখ হাসিনা তিন মেয়াদে সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করে যেমন নিজের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনি নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষরও রেখেছেন। তিনি সৎ এবং নির্ভীক। তিনি ঝুঁকি নিতে জানেন, স্বপ্ন দেখাতে জানেন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের কৌশলও তার অজানা নয়।

তবে তাকে একা করা চলবে না। একটি যোগ্য, চৌকস সহকর্মী দল শেখ হাসিনাকে অসাধ্য সাধনে সাহসী ও অনুপ্রাণিত করে তুলবে।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App