×

জাতীয়

‘নির্বাচনে ভরাডুবি সময়োচিত সিদ্ধান্তের অভাবে’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:৪১ পিএম

‘নির্বাচনে ভরাডুবি সময়োচিত সিদ্ধান্তের অভাবে’
সাংগঠনিক দুর্বলতা, কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্বহীনতা, একের পর এক কৌশলগত ভুল, অযোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া, নির্বাচনী প্রচারকালে বিরোধী পক্ষের হামলা-মামলার পরও নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত না নেয়া এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে; দল এখন খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে- এমনটাই মনে করছেন বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। বর্তমান চরম বিপর্যয়ের সময়েও কেন্দ্র থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা না থাকায় হতাশায় রয়েছেন তারা। বিএনপির তৃণমূলের মনোবল এখন শূন্যের কোটায়। এক দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটিকে আরো অন্তত পাঁচ বছর ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে থাকতে হবে, মোকাবেলা করতে হবে বৈরী পরিস্থিতি- এমনটা ভেবে রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার চিন্তাও করছেন কেউ কেউ। বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। বিএনপির তৃণমূল নেতারা মনে করেন, নির্বাচনে চরম পরাজয়ের পেছনে রয়েছে প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষমতাসীন দলের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং। তবে দলের নীতিনির্ধারকরাও এর দায় এড়াতে পারেন না। তাদের ভুল কৌশলকেও দায়ী করছেন অনেকে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন- এবারের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাব ছিল, প্রচারণা চলাকালে মাঠের নেতাদের ওপর যখন একের পর হামলা-মামলা হচ্ছিল কেন্দ্রীয় নেতারা তখন সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। সে সময় ভোট বর্জন বা সারা দেশের ৩০০ আসনের প্রার্থীদের তাৎক্ষণিক ঢাকায় ডেকে এনে নির্বাচন কমিশন ভবন ঘেরাও করলে কমিশন প্রধান চাপে থাকতেন। নির্বাচনটা এতটা যেন-তেনভাবে হতে পারত না। এ ছাড়াও তারা অভিযোগ করেন, ভোটের দিন জেলা সভাপতি ও সেক্রেটারিদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। গ্রেপ্তার আতঙ্কে তারা গা ঢাকা দিয়েছিলেন। অথচ পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র সুরক্ষা দেয়া, ভোটকেন্দ্র পাহারা দেয়া ও পরিস্থিতি বুঝে কেন্দ্র দখল করার নির্দেশনা ছিল তাদের ওপরই। এমনকি জোটসঙ্গীদের ওপর বিএনপির নীতিনির্ধারকদের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতাকে নির্বাচনে ভরাডুবির অন্যতম কারণ বলে মনে করেছন মাঠের নেতারা। খোঁজ নিয়ে নিয়ে জানা গেছে, একের পর এক হামলা-মামলার খড়গ মাথায় নিয়েও ক্ষমতায় যাওয়ায় স্বপ্ন দীর্ঘ ১০ বছরেরও বেশি সময় বিএনপির রাজনীতিকে টিকিয়ে রেখেছিল তৃণমূল নেতাকর্মীরা। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ভুল সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েও নিজেদের টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন তারা। এরপর গত বছর ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় কারাবরণ করেন দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এর ফলে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে দল। পরবর্তীতে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি। এর ফলে খানিকটা হলেও চাঙ্গা হয় দলটির সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। ক্ষমতায় যাওয়ার নতুন স্বপ্ন নিয়ে নিজেদের তৈরি করতে থাকেন তারা। যার প্রতিফল দেখা যায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর। সারা দেশ থেকে আসা মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ভিড় দেখা যায় বিএনপির নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয় ও গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে। ক্ষমতায় যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামেন দলটির নেতাকর্মীরা। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারি দলের একতরফা প্রচারণা ও বিএনপি কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় তাদের মনোবলে ভাটা পড়ে। সেই মুহূর্তে তারা ক্ষমতায় না গেলেও প্রধান বিরোধী দল হিসেবে সংসদে যাবেন বলে বিশ্বাস ছিল তৃণমূলের। কিন্তু ভোটের ফলাফলে বিপর্যয়ের ষোলকলা পূর্ণ। অথচ এখনো কেন্দ্রে নানা বিভেদ, মতভিন্নতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় অসাড় হয়ে আছে নীতিনির্ধারকরা। এ বিষয়ে দক্ষিণ পশ্চিমের জেলা যশোর-৪ আসনের প্রার্থী টি এস আইয়ুব বলেন, প্রচারকালে যে পরিমাণ হয়রানির শিকার আমরা হয়েছি, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম নির্বাচনের ফলাফল আসলে কেমন হবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করেছিলাম, এই নির্বাচনে দল ক্ষমতায় আসুক আর না আসুক, অন্তত প্রধান বিরোধীদল হিসেবে থাকবে। গণতান্ত্রিকভাবে রাজনীতি করতে পারব। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় পরিস্থিতি যা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে রাজনীতি ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর তো উপায় দেখছি না। এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয়ভাবে আন্দোলনের ডাক দিলে মাঠে নামবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই জেলে। এই অবস্থায় আন্দোলন করবে কারা? বরিশাল মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন শিকদার বলেন, নেতাকর্মীদের ওপর যেভাবে হামলা-মামলা হয়েছে, তাতে নির্বাচন আর কই হলো? তবে এখন সময় এসেছে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর। এই মুহূর্তে নয়, আন্দোলনের জন্য আরো সময় নেয়া দরকার। টঙ্গী থানা বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল মোমেন বলেন, নির্বাচনের ফলাফলে আপাতত হতাশা প্রকাশ ছাড়া আর কিই বা করার আছে? তিনি বলেন, প্রচারণা চলাকালে যেভাবে আমাদের উপরে হামলা হয়েছে ওই মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা এলে আজ এতটা লজ্জায় পড়তে হতো না। সরকারও এত যেন-তেনভাবে একটা নির্বাচন বাগিয়ে নিতে পারত না। নির্বাচনের পরও আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি, ঘরে ফিরতে পারছি না। এমন অবস্থায় আন্দোলন কীভাবে সম্ভব? তবে মাঠ গুছিয়ে ‘নেত্রীর’ মুক্তি দাবিতে মাঠে নামার ঘোষণা এলে অবশ্যই ঝাঁপিয়ে পড়ব। খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নুরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, এখনকার বিপর্যয় আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে বিএনপি একেবারে অগোছালো ছিল। বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা, সে বিষয়ে নেতাকর্মীরা ছিল অন্ধকারে। ভোটের কর্মীদের তৈরি করে মাঠে নামাতে হয়- সে ধরনের কোনো কিছু ছিল না। হঠাৎ করে নির্বাচনে যাওয়া। তারপরও দল যেহেতু নতুন একটা ফ্রন্ট করেছে, নেতাকর্মীরা তাদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। তারা মনে করেছেন, হয়ত জোটগতভাবে এগুতে পারবে এবং সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে। এর কোনোটাই না হওয়ায় নেতাকর্মীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় দলের ভবিষৎ কী- সেটা সত্যি ভাবার বিষয়। এদিকে ভোটে হেরে হতাশা থেকে ইতোমধ্যেই রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী শাহ সোলায়মান আলম ফকির। নির্বাচনে পরাজয়ের পর মঙ্গলবার তিনি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শারীরিক অসুস্থতা এবং ব্যক্তিগত পারিবারিক অসুবিধাকে অবসরের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। শাহ সোলায়মান আলম ফকির একাদশ সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৫ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৬৪ হাজার ১৪৭ ভোট পান। এ আসনে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের এইচ এন আশিকুর রহমান। অবসরের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, টানা ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিলাম। আরো ৫ বছর এত হামলা-মামলা মাথায় নিয়ে টিকে থাকা দায়। তবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ শীর্ষ নেতারা বলেন, দেশের সুশীল সমাজ ও বিদেশিরা নির্বাচনে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এ জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকা সত্তে¡ও তারা অংশ নেন। নির্বাচন পরবর্তী সার্বিক বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও। মাঝারি গোছের একপক্ষ বলছেন, নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই দল ভুল পথে হেঁটেছে। তারা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের পাতা ফাঁদে না চাইলেও পা দিয়েছে বিএনপি। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের সঙ্গে দুই দফা আলোচনার সময় কৌশলী হতে পারেনি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দরকষাকষিতে কোনো ফল আসেনি। তৃণমূল নেতাদের চাওয়া ছিল খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে নির্বাচনে যাওয়া। সেটি সম্ভব না হলে অন্তত নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনড় থাকা দরকার ছিল। পরিস্থিতি বুঝে ভোট থেকে সরে দাঁড়ালে আজকের এই দিন দেখতে হতো না। নির্বাচনের ভরাডুবির পর দলের বর্তমান অবস্থা যতই শোচনীয় হোক না কেনো কঠোর কোনো আন্দোলনের পথে পা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেবে না বিএনপির হাইকমান্ড। জোট ও ফ্রন্টকে নিজের জায়গায় রেখে তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা তাদের। নিজেদের মতো দল গুছিয়ে একটু একটু করে দলকে আগের অবস্থায় ফেরাতে চান তারা। তবে কোনো অবস্থাতেই মাঠ ছাড়বেন না। নতুন সরকার গঠনসহ পরবর্তী পরিস্থিতি আরো কয়েক দিন পর্যবেক্ষণ করবে বিএনপি। আন্দোলনের বদলে প্রচারণা বা গণসংযোগমূলক কর্মসূচি দেয়ার চিন্তা আছে। পাশাপাশি নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে- এমন অভিযোগ এনে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করারও চিন্তা রয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা-৮ আসনের ফলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশের নির্বাচনী প্রার্থীদের গুলশান কার্যালয়ে ডাকা হয়েছে। তাদের সঙ্গে সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে পরামর্শ নেবে বিএনপির হাইকমান্ড। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদ বলেন, পরবর্তী করণীয় কী হবে, তা নির্ধারণে সময় লাগবে। এত তাড়াহুড়া নেই। আগামীকালই মানুষ রাস্তায় নামবে, এমন নয়। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলে হাতাশা থাকাটা স্বাভাবিক। তারা মাঠে থেকে মার খেয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন। এখন সংগঠন গুছিয়ে মাঠে নামাটা জরুরি। এই মুহূর্তে রাগ-ক্ষোভ থাকলেও তাদের দলের পাশে থাকা উচিত। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে দলীয় কিছু ভুল থাকতে পারে। তবে আশা করি আমাদের সুদিন আসবেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App