×

আন্তর্জাতিক

পার হয়ে যাই ২০১৮

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৪:০৮ পিএম

পার হয়ে যাই ২০১৮
প্রতিবাদ, সংঘাত, সংকট আর শান্তির লক্ষ্যে সমন্বিত বিভিন্ন উদ্যোগ তথা সমন্বয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার হওয়া ২০১৮ সাল ছিল বিশ্ব রাজনীতির জন্য একটি কঠিন বছর। বছরভর বিশ্ব মুরব্বি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাশাপাশি এসব ইস্যু ঘিরে আবর্তিত খবরগুলোই প্রধান শিরোনাম হয়ে থেকেছে গণমাধ্যমে। বছরের শুরুর দিকে এপ্রিলের মাঝামাঝি চীনের সঙ্গে শুল্ক-পাল্টা শুল্ক আরোপ নিয়ে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও প্রক্রিয়াটি প্রথম শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই। মার্কিন পণ্যের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস লঙ্ঘন ও অন্যান্য অভিযোগে চীনা পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক ঘোষণা করেন ট্রাম্প। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে অনেকগুলো মার্কিন পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করে চীন। প্রায় একই সময়ে শক্তিমত্তার প্রদর্শনী করতে গিয়ে উত্তর কোরীয় নেতার সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। একে অপরের উদ্দেশে বিভিন্ন মাত্রার হুমকি-ধামকির পর জুন মাসে সিঙ্গাপুরের অবকাশ কেন্দ্রে ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হন উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন এবং মার্কিন নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। বহু প্রতীক্ষিত ওই সংলাপে কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা প্রশমনের ব্যাপারে একমত হন উভয় নেতা। এ লক্ষ্যে আগামী দিনেও সংলাপ এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেন তারা।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসেই পেন্টাগন তাদের জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি ঘোষণা করে জানিয়ে দেয়, সন্ত্রাস নয়, বৃহৎ শক্তির জন্য প্রতিযোগিতাই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিরক্ষানীতির মূল স্তম্ভ। এ বছর অক্টোবরে পুরনো নাফটা (নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি বাতিল করে মেক্সিকো এবং কানাডার সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তিতে উপনীত হয় যুক্তরাষ্ট্র। একই সময় রাশিয়ার সঙ্গে করা ১৯৮৭ সালের ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয় তারা। এ চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার স্বল্প এবং মাঝারি পাল্লার পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র তৎপরতা সীমিত রাখা হয়। ওয়াশিংটনের অভিযোগ, চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে রাশিয়া। তবে ট্রাম্পের জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত আসে নভেম্বরে। এ মাসে অনুষ্ঠিত মিডটার্ম নির্বাচনে প্রতিনিধি সভার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ডেমোক্রেট দলের হাতে। ফলে কংগ্রেস থেকে যে কোনো বিল পাস করিয়ে আনা এখন আরো কঠিন হয়ে দাঁড়াল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য। নভেম্বরে মধ্যমেয়াদি নির্বাচনে বড় প্রাপ্তিটা আসে ডেমোক্রেটদের ঘরে। তবে খালি হাতে ফিরতে হয়নি রিপাবলিকানদেরও। সিনেটে আরো দুটি সিট দখলের সুবাদে বিচার বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ গঠনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে চ‚ড়ান্ত রায় দেয়ার ক্ষমতাটি নিজেদের হাতে রাখতে সমর্থ হয় তারা। অন্যদিকে হাউসের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়ার পথে ৪০টি নতুন আসন দখল করে ডেমোক্রেটরা। ১৯৭৪ সালের ওয়াটারগেট পর্বের পর এখন অবধি এটাই মধ্যমেয়াদি নির্বাচনে তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। নির্বাচনে ৯ শতাংশ পয়েন্টে রিপাবলিকানদের হারিয়ে নতুন রেকর্ড গড়ে ডেমোক্রেটরা। ফলে দিনকয়েক পর আগামী বছর জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে যখন ১১৬তম কংগ্রেসের অধিবেশন শুরু হবে তখন সেখানে হাউস কমিটির নেতৃত্ব দেবে এবং আলোচনার এজেন্ডা ঠিক করবে ডেমোক্রেটরা। এখনো দেশের মধ্যে কিংবা বিদেশের ইস্যুতে সরাসরি ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বদলানোর ক্ষমতা নেই তাদের। এ ধরনের কিছু করতে চাইলে রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত সিনেটের সঙ্গে চুক্তি এবং ট্রাম্পে ভেটো অতিক্রম করতে হবে তাদের। তবে অন্যত্র ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ থাকছে ডেমোক্রেটদের। যেমন মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের অর্থ জোগানোর ক্ষেত্রে তাদের মতামত উপেক্ষা করার উপায় নেই ট্রাম্পের। পাশাপাশি, হোয়াইট হাউসের যে কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ এবং এ সূত্রে ট্রাম্পের ওপর জনগণের পক্ষ থেকে চাপ তৈরির সামর্থ্য নিশ্চিত হলো ডেমোক্রেটদের। মানবিক মহাসংকট ২০১৭ সালে শুরু হওয়া মানবিক সংকট পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে ২০১৮ সালে, বিশেষত, ভেনেজুয়েলা আর ইয়েমেনে। গত চার বছরে ভেনেজুয়েলা থেকে পালিয়ে গেছে কমপক্ষে ২৩ লাখ লোক। পালাতে না পেরে তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে আরো ১০ লাখের ওপর মানুষের। দেশটির দুর্দশার মূল কারণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের চরম ব্যর্থতা। প্রথমত তার ক্ষয় শুরু হয় হুগো শাভেজের হাতে, পরে তাতে পচন ধরান নিকোলাস মাদুরো। দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেন এ দুজন। মে মাসের নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে বিজয়ী হন মাদুরো। অনিয়মের ধারাবাহিকতায় আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি, পানি ও বিদ্যুৎ সংকট আর ভয়াবহ অপুষ্টি অব্যাহত থাকে দেশটিতে। অন্যদিকে ২০১৮ সালে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের চার বছর পূর্ণ হয়। কমপক্ষে ১৪ হাজার ইয়েমেনি নিহত হয়েছেন এ যুদ্ধে। লক্ষাধিক মারা গেছেন যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া দুর্ভিক্ষে। গণমাধ্যমে ছাপা হওয়া রুগ্ণ-শীর্ণ ইয়েমেনি শিশুর ছবি দেখে চমকে ওঠে বিশ্ব। কিন্তু তবু অস্ত্র সম্বরণ করানো সম্ভব হয়নি বিবদমান দুপক্ষের কাউকেই। পাশাপাশি মধ্য আফ্রিকা, কংগো, সিরিয়া আর দক্ষিণ সুদানে মানবিক সংকট অব্যাহত থাকে আগের মতোই। ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ায় শান্তি তবে অনেক ব্যর্থতার মধ্যে একটি সাফল্যের খবর, বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে এ বছরের জুন মাসে ১৮ বছর ধুলোর নিচে পড়ে থাকা ইরিত্রিয়ার শান্তি প্রস্তাব মেনে নিতে সম্মত আছেন বলে ঘোষণা দেন ইথিওপিয়ার আবি আহমেদ। এর আগে ২০০০ সালে শেষ হয় তাদের ১২ বছরের লড়াই। জুলাই মাসে ইরিত্রিয়ার প্রেসিডেন্ট ইসাইয়া আফরকির সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন আবি আহমেদ। দুই দেশের রাজধানীতে পরস্পরের দূতাবাস চালু হয় ফের, বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের সূচনা ঘটে, নিরস্ত্রীকরণ শুরু হয় যৌথ সীমান্তে। রাজবন্দি যারা ছিল কারাগারে, মুক্তি পান তারা। জরুরি অবস্থা তুলে নেয়া হয়। শান্তি চুক্তির সুবাদে ‘আফ্রিকার উত্তর কোরিয়া’ নামে কুখ্যাত ইরিত্রিয়ায় অফারকির স্বৈরশাসনের অবসান ঘটবে বলে আশাবাদ তৈরি হয় সব মহলে। পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসে। দুই দেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সীমান্ত সংঘাতের ইতি টেনে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয় সোমালিয়া আর জিবুতির সঙ্গে। এর পুরস্কার হিসেবে ইরিত্রিয়ায় অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। বিশ্ব সম্মেলনে মার্কিন  ‍ভূমিকা ছিল অসহযোগিতার ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালেই ট্রাম্প বলেছিলেন, পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন ধারার সূচনা ঘটাবেন। ২০১৮ সালে বিশ্বের বিভিন্ন শীর্ষ সম্মেলনে হাজিরা দিয়ে সেই নতুন নীতির সঙ্গে বিশ্বের পরিচয় ঘটান এবং নিজেকে এক কথার মানুষে হিসেবে প্রমাণ দেন তিনি। জুন মাসে কুইবেকে জি-সেভেন সামিটে অংশ নিয়ে মার্কিন পক্ষের জন্য বৈরী বাণিজ্য নীতির কারণে অন্য নেতাদের তুলোধুনো করেন। সামিট শেষ হওয়ার আগেই চলে আসেন আয়োজন ছেড়ে এবং প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত বিমান এয়ার ফোর্স ওয়ান থেকে টুইট করেন, চলে আসার আগে যে চুক্তি সই করবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন তা ফিরিয়ে নিচ্ছেন তিনি। এরপর সেখান থেকে তিনি চলে যান সিঙ্গাপুর। উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা বৈঠকের পর চারশ শব্দের ভাসা ভাসা ভাষায় তৈরি এক চুক্তিপত্রে সই করে ঘোষণা দেন, উত্তর কোরিয়ার দিক থেকে আর কোনো পারমাণবিক হামলার আশঙ্কা নেই। জুলাই মাসে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে গিয়ে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেলকে রাশিয়ার ‘অনুগত এবং তাদের হাতের পুতুল’ হিসেবে অভিযুক্ত করেন। ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ব্যয়ে সদস্য দেশগুলো যাতে আরো বেশি অর্থ বিনিয়োগ করে সেজন্য তাদের ওপর চাপ তৈরি করেন। অন্যরা যদি তার কথামতো চলতে রাজি না হয়, সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে জোট থেকে প্রত্যাহার করে নেবেন, বলেও হুমকি দেন। এর মাত্র কয়েক দিন পরই হেলসিঙ্কিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ‘মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ’ বিষয়ক তদন্তে নিজের দেশের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অস্বীকার করে পাল্টা পুতিনের পক্ষ নেন। নভেম্বর মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শতবর্ষ পূর্তিতে প্যারিসে বিশ্ব সম্মেলনে যোগদানের পথে টুইটারে তিনি চড়াও হন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রোর ওপর। এরপর সামান্য বৃষ্টির অজুহাতে মার্কিন সেনাদের সমাধিস্থলে হাজিরা দিতে অস্বীকার করেন এবং ফরাসি সরকার আয়োজিত শান্তি ফোরামের আমন্ত্রণকেও ‘না’ করে দেন। তবে এ জাতীয় কোনো অঘটন ছাড়াই উৎরে যায় বুয়েনস আয়ার্সে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলন। দুনিয়া কাঁপানো #মি টু এর আগে হলিউড প্রযোজক হার্ভে ওয়েনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী শুরু হয় ‘#মি টু’ আন্দোলন। তবে ২০১৮ সালে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। দুনিয়াজোড়া লাখ লাখ নারী সোচ্চার হয় তাদের নিপীড়কের বিরুদ্ধে। ইতালিতে এর নাম #কোয়েলাভোল্টাচে (সেই তখনকার কথা, যখন), স্পেনে এর নাম হয় #ইয়োতামবিয়েন, ফ্রান্সে #ব্যালান্সটনপর্ক (শুয়োরের বিরুদ্ধে সোচ্চার) এবং আরব দেশগুলোতে #আনাকামান। সার্চ ইঞ্জিন গুগল জানায়, বছরভর অনুসন্ধান তালিকার শীর্ষে থেকেছে #মি টু আন্দোলন। এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারও যৌথভাবে পান কঙ্গোর চিকিৎসক ডেনিস মুকওয়েগ এবং আইসিস জঙ্গিদের হাতে নিপীড়নের শিকার হওয়া নাদিয়া মুরাদ। যৌন সহিংসতাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন এ দুজন। তবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে #মি টু আন্দোলনের সাফল্যের মাত্রা বিশ্বের একেক জায়গায় ছিল একেক রকম। আন্দোলন তেমন সুবিধা করতে পারেনি চীন, রাশিয়া এবং সাব-সাহারার দেশগুলোতে। তবে অন্যান্য এলেকায় শক্তিশালী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জোরালো সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয় আন্দোলনরত নারীরা। এ মুহূর্তে কিছুটা ঢিমেতালে চলমান এ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কতদূর গড়ায় এখনো তা দেখার অপেক্ষা। সৌদি যুবরাজের নির্দেশে জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড বছর শেষের বিশ্ব অঙ্গনে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ছিল তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটের ভিতর সৌদি রাজশক্তির বিরুদ্ধ মতাবলম্বী এবং ওয়াশিংটন পোস্টের খ্যাতিমান কলামিস্ট জামাল খাসোগির নির্মম হত্যাকাণ্ড। অক্টোবরের ২ তারিখে বিয়ের কাগজপত্র পেতে কনস্যুলেটে গিয়ে ঢোকেন খাসোগি, কিন্তু বের হতে পারেননি সেখান থেকে। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ঘটনার নানাবিধ অপব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে সৌদি কর্তৃপক্ষ, কিন্তু তুরস্কের গোয়েন্দা তৎপরতায় দ্রুত ফাঁস হয়ে যায় সৌদি অপকর্ম। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান সকল ‘সত্য’ জানিয়ে দেন বিশ্বের শীর্ষ শক্তিগুলোকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এ কথা বলে যে, এটি আমেরিকার দেখার বিষয় নয়। কেননা, আমি ‘যতদূর জানি খাসোগি মার্কিন নাগরিক নয়’ কিন্তু তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে কংগ্রেস এবং খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ও আদেশদাতা হিসেবে ট্রাম্পের মিত্র সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে অভিযুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। ট্রাম্প তখন নতুন বিবৃতি দিয়ে বলেন, এমন হতেও পারে যে যুবরাজ সালমান এ বিয়োগান্তক ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, হয়তো, তিনি জানতেন কিংবা তিনি জানতেন না! প্রেসিডেন্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এক হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র কিনছে রিয়াদ। এখানে ব্যবসায়ীসুলভ মনোবৃত্তি বজায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বাস্তবে সে পরিমাণ কেনাকাটা আদৌ করছে কিনা সৌদি আরব সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকেরই। বিস্তর অভিযোগ আগে থেকেই রয়েছে সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে। রাজপরিবারের নিজের ভাইবেরাদরদের ধরে ধরে দুর্নীতির অভিযোগে জেলে পুরেছেন। ইয়েমেনে অমানবিক যুদ্ধ শুরু করেছেন। লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে আটকে রেখে সাময়িকভাবে পদত্যাগপত্রে সই করিয়েছেন। কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ জারি করেছেন। একটিমাত্র টুইটের কারণে কানাডার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। ইরান প্রতিরোধ সৌদি বন্ধুত্ব ধরে রাখতে যতটা ব্যগ্র ট্রাম্প, ততটাই উগ্র তিনি ইরান ইস্যুতে। এ বছরও ট্রাম্প এর নমুনা রাখেন দেশটির সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে। তার দাবি, এটি শুধু একপক্ষের স্বার্থ রক্ষাকারী একটি চুক্তি যা আদৌ স্বাক্ষর হওয়াই উচিত হয়নি। ব্রিটিশ, জার্মান আর ফরাসি নেতারা তখন উড়ে যান ওয়াশিংটনে ইরানের পক্ষে তদবির করতে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস মাতিস পর্যন্ত বলেন, সব দুর্বলতা থাকা সত্তে¡ও আমাদের উচিত হবে চুক্তির সঙ্গে থাকা। যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে সমর্থন দানে বিরত থাকে অন্য দেশগুলো। হোয়াইট হাউস সবাইকে জানিয়ে দেয়, ইরানের সঙ্গে অন্য যারা লেনদেন করবে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ট্রাম্প প্রশাসন এতদূর পর্যন্তও ঘোষণা করে, কেবল চুক্তি থেকে সরে আসা বা দেশটির পরমাণু কর্মসূচি প্রতিহত করা নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আসল লক্ষ্য দেশটিতে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ করা! জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রের একগুঁয়েমির মুখে সংকটে পড়ে যায় অন্য বড় শক্তিগুলো। বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে বিজ্ঞানীরা কড়া সতর্কবাণী শুনিয়ে এসেছেন আমাদের। প্রমাণ হাজির করেছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাপ ধারক গ্যাস উদগীরণের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে বিপজ্জনক গতিতে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী মাত্র ১২ বছরের ভেতর এমন এক বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছাবো আমরা, যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ খোলা থাকবে না সামনে। তবে জলবায়ু নিয়ে কোনো কাথাতেই বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। আমি এসব বিশ্বাস করি না, সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছেন তিনি বহু আগেই। বদলাচ্ছে ইউরোপ সব মিলিয়ে ঘটন-অঘটনের মধ্যে থাকা পশ্চিমা বিশ্বের জন্য খুব একটা স্বস্তির ছিল না ২০১৮ সাল। নিজের দেশেই ওলট-পালটের মধ্যে থাকায় বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দেয়ার জন্য সব সময় তার পাশে দাঁড়াতে পারেনি ইউরোপীয় মিত্ররা। ইউরোপের বড় ঘটনা ছিল ব্রেক্সিট। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বিচ্ছেদ নিয়ে টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে ব্রিটেনকে। বছরের শেষ নাগাদ দুই পক্ষ একটি চুক্তিতে উপনীত হতে পারলেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এখনো তার নিজের হাউস অব কমনসকেই রাজি করাতে পারেননি চুক্তির ব্যাপারে। দিনকয়েক পরই দেশটির পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হওয়ার কথা রয়েছে এ চুক্তির ওপর, তবে শেষ অবধি কঠিন ব্রেক্সিট, নরম ব্রেক্সিট নাকি ব্রেক্সিটশূন্য হাতে ফিরতে হয় ব্রিটেনকে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। অন্যদিকে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রোর দিনও কাটছে না তেমন আনন্দে। ইয়েলো ভেস্ট বিক্ষোভের ধাক্কায় তার জনপ্রিয়তা নেমে এসেছে তলানিতে। মুখ থুবড়ে পড়েছে ফরাসি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে তার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। এ ছাড়া ইইউর সঙ্গে এ মুহূর্তে সংঘাতমূলক অবস্থানে রয়েছে ইতালি। হাঙ্গেরিতে গণতন্ত্র টলিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান। স্থিতি নেই জার্মানিতেও। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রাজ্যে হেরে যাওয়ার পর সম্প্রতি ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল। এ ছাড়াও অন্যান্য ঘটনা পরম্পরা ২০১৭ সালেই ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন, আই ওয়ান্ট ট্যারিফ। ২০১৮ সালে নিজের খায়েশ পূর্ণ করেন তিনি। জানুয়ারি মাসে প্রথমে শুল্ক আরোপ করেন ওয়াশিং মেশিন আর সোলার প্যানেল আমদানির ওপর। মার্চে জাতীয় নিরাপত্তা ধুয়া তুলে আবারো শুল্ক আরোপ করেন শত্রুমিত্র নির্বিশেষ ইস্পাত আর অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর। পরবর্তীকালে চীনের ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করেন যা জুলাই মাসে উন্নীত করেন ২৫০ বিলিয়ন ডলারে। এরপর টুইট করেন, বাণিজ্য যুদ্ধ উত্তম, সহজে জয় পাওয়া যায়! কিন্তু এসব শুল্ক আরোপে বাস্তবে লাভের চেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে মার্কিন নাগরিকরা। স্টক মার্কেটে ধস নামে, বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পায়, বাণিজ্য সহযোগীরা পাল্টা শুল্ক আরোপ করে মার্কিন পণ্যের ওপর, ফলে বিদেশে বাজার খোয়ান মার্কিন কৃষকরা। চাকরি হারিয়ে বেকারত্ব বাড়ে। ফলে নতুন করে ভাবতে শুরু করে প্রশাসন। স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে ইইউর সঙ্গে নতুন শুল্ক আরোপ না করার বিষয়ে চুক্তি সই হয় জুলাই মাসে। নভেম্বরে ৯০ দিন মেয়াদি একটি শান্তিচুক্তি হয় চীনের সঙ্গেও। বছরভর এসবের বাইরে উল্লেখযোগ্য যেসব ঘটনা সংবাদ শিরোনাম হয়ে আসে তার মধ্যে রয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্যোগে ফেব্রুয়ারি মাসে চিওংচাংয়ে শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন যেখানে অংশ নেয় লৌহ যবনিকার ওপারে থাকা উত্তর কোরিয়া। এ ছাড়া মার্চে বিশ্বকে নিজের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ভাণ্ডারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মে মাসে মার্কিন দূতাবাস চালু হয় বিতর্কিত জেরুজালেমে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App