×

অর্থনীতি

বছরজুড়েই আলোচনার শীর্ষে কৌশলগত বিনিয়োগকারী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৩:৫৬ পিএম

বছরজুড়েই আলোচনার শীর্ষে কৌশলগত বিনিয়োগকারী
ক্যালেন্ডার থেকে আরো একটি বছরের বিদায়। দরজায় কড়া নাড়ছে-২০১৯। দেশের পুঁজিবাজারের একটি গুণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে-২০১৮। বছরজুড়েই দেশের পুঁজিবাজারে সবচেয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল কৌশলগত বিনিয়োগকারী। নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সবার সমর্থনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানার সঙ্গে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে নিয়োগ পায় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দুই স্টক এক্সচেঞ্জ চীনের শেনঝেন এবং সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত হয় দেশের পুঁজিবাজার। তবে বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে সূচক ও লেনদেনে নি¤œমুখিতা লক্ষ্য করা গেছে। বিদায়ী বছরের অর্জন সম্পর্কে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান জানিয়েছেন, কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে যুক্ত করা বাজারের জন্য ইতিবাচক। তাদের অন্তর্ভুক্তি বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে পরিচিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, নির্বাচনী বছরে বাজার কিছুটা মন্দা গেছে। পুঁজিবাজারে যে গতি অর্জন করার কথা ছিল তা না পারলেও দেশের পুঁজিবাজার এমন একটি মাত্রায় পৌঁছেছে, যার ফলে তেমন সংকট সৃষ্টি হয়নি। বছরজুড়ে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে আমরা যে চিত্র পাই তা নিম্নরূপ। পুঁজিবাজারের লেনদেন : ২০১৮ সালে মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩,৩৫৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা। যা গত বছরের চেয়ে ৮৩ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম। ২০১৮ সালে ২৪২ কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয় ৫৫২ কোটি ৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০১৭ সালে ২৪৮ কার্যদিবসে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২,১৬,৯৫৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং গড়ে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৮৭৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। ডিএসইর মূল্য সূচকসমূহ : ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (ডিএসইএক্স) আগের বছরের চেয়ে ৮৫৮ দশমিক ৮৮ পয়েন্ট বা ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৫৩৮৫ দশমিক ৬৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালে ডিএসইএক্স মূল্য সূচক সর্বোচ্চ ৬,৩১৮ দশমিক ২৭ পয়েন্টে উন্নীত হয় এবং সর্বনিম্ন ছিল ৫২০৪ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট। ডিএসই ৩০ সূচক (ডিএস৩০) ৪০২ দশমিক ৪ পয়েন্ট বা ১৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১৮৮০ দশমিক ৭৮ পয়েন্টে দাঁড়ায়। একই বছর ডিএসইএক্স শরিয়াহ সূচক (ডিএসইএস) ১৫৭ দশমিক ৮৫ পয়েন্ট বা ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১২৩২ দশমিক ৮২ পয়েন্টে উন্নীত হয়। বাজার মূলধন : সূচকের পাশাপাশি ডিএসইর বাজার মূলধনও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। ডিএসইর বাজার মূলধন আগের বছরের তুলনায় ৩৫,৫৯৯ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৩ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালে বাজার মূলধন সর্বোচ্চ ৪ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয় এবং সর্বনিম্ন ছিল ৩ লাখ ৭৪ হাজার কোটি। আইপিও : শিল্পোদ্যোক্তারা ২০১৮ সালে বাজার থেকে ১টি মিউচুয়াল ফান্ডসহ মোট ১৪টি সিকিউরিটিজ প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে ৬০১ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ২টি কোম্পানি প্রিমিয়াম বাবদ ২৩৩ কোটি ১২ লাখ টাকা মূলধন উত্তোলন করে। অন্যদিকে ২০১৭ সালে ২টি মিউচুয়াল ফান্ডসহ মোট ৮টি সিকিউরিটিজ প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে মোট ২৪৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। তালিকাভুক্তি : ২০১৮ সালে ১টি মিউচুয়াল ফান্ডসহ মোট ১২টি সিকিউরিটিজ ১২১২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হয়। অন্যদিকে ২০১৭ সালে ৩টি মিউচুয়াল ফান্ডসহ মোট ১০টি সিকিউরিটিজ ৮৩৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হয়। রাইট শেয়ার ইস্যু : ২০১৮ সালে ২টি কোম্পানি ১০ কোটি ৯৪ লাখ রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মোট ২৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা মূলধন সংগ্রহ করে। আগের বছর ৪টি কোম্পানি ৮৬ কোটি ৮০ লাখ রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করেছিল ১১১৪ কোটি ২ লাখ কোটি টাকা। বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন বাড়ানো : ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালে ব্যাংকিং খাতের ২০টি, আর্থিক খাতের ১২টি, প্রকৌশল খাতের ২৩টি, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের ৬টি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ৭টি, টেক্সটাইল খাতের ২৯টি, ওষুধ ও রসায়ন খাতের ১৪টি, সার্ভিস এন্ড রিয়েল এস্টেট খাতের ১টি, সিমেন্ট খাতের ২টি, আইটি খাতের ৪টি, ট্যানারি খাতের ২টি, সিরামিক খাতের ৩টি, ইন্স্যুরেন্স খাতের ২৪টি এবং বিবিধ খাতের ৭টিসহ মোট ১৫৪টি কোম্পানি ৩৫৫ কোটি ৭৬ লাখ বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৩৫৫৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা মূলধন বাড়িয়েছে। মার্কেট পিই : ২০১৮ সালের শেষ দিনে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজগুলোর মূল্য আয় অনুপাত বা মার্কেট পিই দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৯। অন্যদিকে ২০১৭ সালের শেষ দিনে মূল্য আয় অনুপাত বা মার্কেট পিই ছিল ১৪ দশমিক ২৯। মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন টু জিডিপির অনুপাত : ডিএসইতে ২০১৮ সালের শেষে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজগুলোর মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন টু জিডিপির অনুপাত দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ২১ শতাংশ, যা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের লেনদেন : ২০১৮ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯,৫৮৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১৮ সালে ক্রয়কৃত সিকিউরিটিজের পরিমাণ ছিল ৪,৪৯৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা এবং বিক্রয়কৃত সিকিউরিটিজের পরিমাণ ছিল ৫,০৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০১৭ সালে বৈদেশিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১১,৪৪৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। রাজস্ব : সরকারের রাজস্ব অর্জনের ক্ষেত্রে ডিএসইর ভূমিকা অপরিসীম। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড ২৩৭৪ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়। এর মধ্যে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ৫৩ বিবিবি ধারা অনুযায়ী ব্রোকারেজ কোম্পানি থেকে উৎসে কর ১৫৯০ দশমিক ২৬ মিলিয়ন টাকা, আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ৫৩এম ধারা অনুযায়ী স্পন্সর এবং প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডারের সিকিউরিটিজ বিক্রয় বাবদ ৭৪১ দশমিক ২০ মিলিয়ন টাকা এবং ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪ সেকশন ৫৩এন অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার বিক্রি বাবদ মূলধনী আয়ের ওপর ৪৩ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন টাকা। মোবাইল লেনদেন : আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে ডিএসই পুঁজিবাজারের লেনদেনকে করেছে সর্বাধুনিক ও সহজসাধ্য। ডিএসইতে মোবাইলের মাধ্যমে লেনদেন এই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের এক অনন্য উদাহরণ। দেশের পুঁজিবাজার বিকাশের ক্ষেত্রে গত ৯ মার্চ ২০১৬ তারিখে সংযোজন হয় ডিএসই-মোবাইল অ্যাপ। এই অ্যাপ চালুর পর ক্রমবর্ধমান হারে মোবাইলে লেনদেন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েই চলছে, যা ২০১৮ সালের শেষে দাঁড়ায় ৩৯,৩৪৩ জনে। ওটিসি মার্কেট : ২০১৮ সালে ওটিসি মার্কেটে শেয়ার লেনদেন আগের বছরের তুলনায় বেড়ে ৯৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। এ বছরে ওটিসি মার্কেটে মোট ২ কোটি ১৬ লাখ ৮৭ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়, যার মূল্য ৭০ কোটি ৩১ লাখ টাকা। নতুন বাজার সৃষ্টি : পুঁজিবাজারে স্বল্প মূলধনের প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন ও তালিকাভুক্তির জন্য ঝসধষষ ঈধঢ় ইড়ধৎফ গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এসএমই হলো অর্থনীতির বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অংশগ্রহণ : ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড জাতিসংঘের সাসটেইনেবল স্টক এক্সচেঞ্জের উদ্যোগে যুক্ত হতে একটি প্রতিশ্রুতি পত্রে স্বাক্ষর করেছে। এই উদ্যোগ বিশ্বের ৭৫টি স্টক এক্সচেঞ্জকে একত্রিত করেছে, যারা তথ্য আদান-প্রদান এবং পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও স্বচ্ছতার উন্নয়নে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পরিশেষে বলা যায়, একটি দেশের অর্থনীতির পূর্বশর্ত হচ্ছে শক্তিশালী পুঁজিবাজার। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নির্ধারণ করেছে, সেটি বাস্তবায়নে পুঁজিবাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানে পুঁজিবাজার ব্যাংক ঋণের তুলনায় ভালো উৎস। অর্থসংস্থানে পুঁজিবাজারের ভূমিকা শিল্পায়নের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। সবদিক বিবেচনায় দেশের পুঁজিবাজার এগিয়ে যাচ্ছে নতুনরূপে সুসংগঠিতভাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App