×

জাতীয়

সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে বর্জনের অঙ্গীকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:২৬ এএম

সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে বর্জনের অঙ্গীকার
সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে বর্জন ও এই অপশক্তি যেন আর কখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারে- এমন অঙ্গীকারে বিজয়ের ৪৮তম দিবস উদযাপন করল জাতি। এ লক্ষ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসর সব প্রার্থীকে বয়কটেরও আহবান জানানো হয়। গতকাল রবিবার রাজধানীসহ সারা দেশে এবং বিদেশের বিভিন্ন দূতাবাসেও নানা আয়োজনে উদযাপিত হয়েছে দিনটি। এ বছর বিজয়ের মাসেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নিজ নিজ দল ও প্রতীকের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় মুখর দেশের তিনশ নির্বাচনী আসন। গতকাল ছিল নির্বাচনী প্রচারণার ৭ম দিন। ফলে কিছুটা ভিন্নমাত্রায় সারা দেশেই পালিত হলো এ দিবসটি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ এই দিনটির তাৎপর্য তুলে ধরেছে তাদের নির্বাচনী প্রচারণায়। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিতর্কিত ভ‚মিকা সম্পর্কেও বিস্তারিত তুলে ধরা হয় ভোটারদের মধ্যে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ^ মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। দিবসটি প্রতি বছর বাংলাদেশে পালিত হয় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায়। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকায় গত এক দশক ধরে গোটা জাতি এক আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করতে পারে। জাতি পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করে একাত্তরের বীর সন্তানদের, যারা স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এদিকে দিবসটি পালনে বরাবরের মতো গতকালও সকালে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে কৃতজ্ঞ জাতি শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে সমবেত হয়। শোক আর রক্তের ঋণ শোধ করার গর্ব নিয়ে উজ্জীবিত জাতি দিবসটি উদযাপন করে। শীতের কুয়াশা ও ঠাণ্ডা বাতাস উপেক্ষা করে সর্বস্তরের মানুষ ভোর থেকেই স্মৃতিসৌধের বাইরে মহাসড়ক ও আশপাশের এলাকা এবং ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে সমবেত হতে থাকে। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই ফুল, মাথায় বিজয় দিবস লেখা ব্যান্ড, জাতীয় পতাকা নিয়ে স্মৃতিসৌধে জনতার ঢল নামে। বিনম্র চিত্তে সমগ্র জাতি ত্রিশ লাখ শহীদকে আরো একবার জানিয়ে দেয় ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিজয় দিবসের কর্মসূচি। ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে স্মৃতিসৌধে স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতে প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন তারা। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। পরে দলীয় প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বি এম মোজাম্মেল হক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও এ কে এম এনামুল হক শামীম, দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, উপদপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়–য়া প্রমুখ। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধস্থল ত্যাগ করার পর সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তা খুলে দেয়া হয়। এরপর ঢল নামে সাধারণ মানুষের। প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ক‚টনীতিক, রাজনীতিবিদ, শিল্পী-বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, পেশাজীবী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী আর সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফ‚র্ত শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে ভরে ওঠে স্মৃতিসৌধের মূল বেদি। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিজয় উল্লাসে জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বর মুখর ছিল বিভিন্ন বয়সী মানুষের পদচারণায়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ধ্বংসাত্মক, নৈরাজ্যকর কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে নানা স্লোগান, দেশাত্মবোধক গান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বেজে চলছিল বিরামহীনভাবে। স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনতার এই ঢল অব্যাহত থাকে বেলা ২টা পর্যন্ত। এদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয় স্মৃতিসৌধে। শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ১৪-দল, শহীদ পরিবারের সন্তান ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বিএনপি, গণফোরাম, যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির নেতারা। বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতিকে স্মরণ করেন তারা। শ্রদ্ধা জানায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতি লীগ, জাতীয় পার্টি (জেপি), ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ-’৭১, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জাকের পার্টি, জন পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদসহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। পরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দলীয় নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান তিনি। দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ সময় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নেতৃত্বে জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সকালে রাজারবাগ স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর পুলিশ সদস্যদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ পুলিশ। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. জাভেদ পাটোয়ারি ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া উপস্থিত ছিলেন। ডিএমপির একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার দিয়ে শহীদদের সম্মান জানায়। অন্যদিকে দিবসটি উপলক্ষে সব সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জার ব্যবস্থা হয়। রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও রং বেরংয়ের পতাকায় সাজানো হয়। শহীদদের আত্মার শান্তি, জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রতি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সব ধর্মের উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, শিশু পরিবার ও ভবঘুরে প্রতিষ্ঠানগুলোয় উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সকাল ১০টায় বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে পবিত্র কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী সব শহীদ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা : এদিকে বিজয় দিবসে গতকাল বিকেলে বঙ্গভবনে এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও তার সহধর্মিণী রাশিদা খানম। সংবর্ধনায় যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গভবনের সবুজ লনে আয়োজিত এ সংবর্ধনায় অংশ নেন কয়েক হাজার অতিথি। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের পর রাষ্ট্রপতি ও তার সহধর্মিণী এবং প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। বঙ্গভবনের এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এ কিউ এম বদরুদোজ্জা চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ, সংসদ সদস্যগণ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনাররা। এ ছাড়াও অংশ নেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ঐক্যফ্রন্ট নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, তিন বাহিনীর প্রধান, সিনিয়র রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সম্পাদক, সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ, বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার, শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের ৪৩ জন সদস্যও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ সময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বিজয় দিবসের কেক কাটেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তারা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারেও খোঁজ-খবর নেন। তাদের কল্যাণে সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দেন। পরে দেশের প্রখ্যাত শিল্পী রফিকুল ইসলাম, ফাহমিদা নবী, বাপ্পা মজুমদার, মেহেরিন ও মুনিয়া বাউলা গান পরিবেশন করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App