×

মুক্তচিন্তা

৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দিন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:৩৪ পিএম

বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দেয়ার অর্থই হলো বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্থান পেল। উল্লেখ্য, আফ্র এশিয়ার বহু দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। ভারতের স্বীকৃতির ফলে আমরা অনুধাবন করলাম যে পাকিস্তানের পরাজয় তথা বিতাড়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই সেই দিনের সেই অনুভূতি সে সময় যারা উপভোগ করেছিল সেটা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন।

১৯৭১ সালের এই দিনে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাঙালিরা অধীর আগ্রহে এই ক্ষণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। সে দিন বাঙালি জাতি মহোল্লাসে ফেটে পড়ে অনাবিল আনন্দে। এই স্বীকৃতি সম্পর্কে কিছু বলার আগে রাজনৈতিক পটভূমি এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু আলোচনা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, মুক্তিবাহিনীর ‘গাবুর’ মারের চোটে পাকবাহিনী দিশাহারা হয়ে ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারত আক্রমণ করে। অবশ্য তাদের স্বভাব অনুযায়ী ভারত প্রথম আক্রমণ করছে বলে জানায়। তবে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার পিআরও ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকীর বইটি পড়লে পরিষ্কার বোঝা যায় যে পাকিস্তান প্রথম আক্রমণ করে। ভারতের একটা অবস্থান দেখে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কেননা যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথমদিক থেকে ভারত আহ্বান জানাচ্ছিল যে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা হোক। কিন্তু পাকিস্তান বাংলাদেশের নামটি মুখে আনতে চায় না। তারা সমস্যাটাকে ভারতের সঙ্গে আখ্যায়িত করে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করতে চায়।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সামরিক শাসকরা জানালো যে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সংবিধান প্রণয়ন করবে। এ কথাও বলা হলো যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের ভেতর ১৬০টিতে জয়লাভ করল।

মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৭টি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা দাঁড়াল ১৬৭টিতে। পাকিস্তান পিপল পার্টি (পিপিপি) পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশে অধিক আসন পেল সংরক্ষিত আসনসহ পিপিপির মোট আসন সংখ্যা ৮৪। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা ৩১১। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী আখ্যায়িত করলেন। এরপর কি হলো তা সবার জানা। ভুট্টো ও পাকিস্তানের জেনারেলদের চক্রান্তে নির্বাচন, জাতীয় পরিষদ, সংবিধান প্রণয়ন সব ভেস্তে গেল। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের ওপর। শুরু হলো গণহত্যা। প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেয়া শুরু হলো যার সংখ্যা শেষ পর্যন্ত এক কোটিতে দাঁড়িয়েছিল।

উল্লেখ্য, তখন জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পর আক্রান্ত বাঙালির একটাই কথা ছিল ভারত স্বীকৃতি দিচ্ছে না কেন বাংলাদেশকে। সবার মতো আমিও একই কথা ভাবতাম বলতে বাধা নেই যে মনে মনে মু-পাত করেছি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর। কিন্তু যুদ্ধের শেষ দুই সপ্তাহে অর্থাৎ ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে জাতিসংঘে যে ঘটনাপ্রবাহ ঘটল তখন বোঝা গেল যে স্বীকৃতির বিষয়টি কত জটিল ছিল এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে কি পরিমাণ প্রজ্ঞা, ধৈর্য এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হয়েছিল। পাকিস্তানি জেনারেলরা ভেবেছিলেন যে ২৪ ঘণ্টার তারা বাঙালিকে ঠাণ্ডা করতে পারবে। তা হয়নি। চলতে থাকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ।

এ কথা অনস্বীকার্য সে সময়ে ভারত আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করেছে। গোটা বাঙালি জাতি গেরিলা যুদ্ধের পেছনে। আমাদের জনগণ শত নিপীড়ন, হত্যা ও অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণের মাঝে গেরিলা যুদ্ধকে সমর্থন জোগাতে থাকল। আর আমাদের এই সংগ্রাম ভারতে সব রকম সমর্থন রয়েছে, এটাও পরিষ্কার। তাই দিশাহারা হয়ে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করল। শুরু হলো পাক ভারত যুদ্ধ, আর আমরা তো মাঠে আছি। পূর্ব পাকিস্তান কেন, এখন পশ্চিম ফ্রন্টে ও পাকিস্তান প্রচুর মার খেতে লাগল।

এ সময় ত্রাণকর্তার ভূমিকায় এগিয়ে আসলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে আসছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে এল। কিন্তু প্রস্তাবটি হলো ভারত ও পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে। লড়াইয়ের মূল ইস্যু বাংলাদেশ। কিন্তু তার নাম নেই। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব পাস হলো ১০৪-১১ ভোটে।

কি ভয়াবহ অবস্থা, গত নয় মাস ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পত্র-পত্রিকার বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার অনেক খবর বেরিয়েছিল। কোনো সরকারের মন গলেনি। ভারত এবং সোভিয়েত জোটের কয়েক জনের ভোটের ফলে এই স্বল্প সংখ্যা অর্থাৎ ১১। শ্রীমতি ইন্দিরার বাবা জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে যে সব নেতা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সমর্থক ছিলেন তাদের দেশ ও ভোট দেয়নি ভারতের পক্ষে। নিরাপত্তা পরিষদের চিত্রও একই রকম ভয়াবহ। মার্কিনের পক্ষে ভোট ১১-২। এই মহাবিপর্যের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেল একাধিকবার তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোতে।

লক্ষণীয় যে যুদ্ধবিরতি চাওয়া হয়েছিল ভারত পাকিস্তানের ভেতর। বাংলাদেশে অনুপস্থিত। কেন, বিষয়টা পরিষ্কার। এটি কার্যকর হলে যারা মুজিবনগরের সরকার, গঠনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন, তাদের কাউকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হতো না। জামায়াত ও তার সংগঠন আলবদর, আলশামসের সহযোগিতায় সব প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করা হতো। যার কিছুটা নমুনা পাওয়া যায় বিজয়ের প্রাক্কালে যে বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হলো। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা হতো তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। বাংলাভাষার হরফ পরিবর্তন করা হতো। এটা তো তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির ফল হতো আরো কি ভয়াবহ হতো তা কল্পনা করতে ভয় লাগে। কিন্তু সোভিয়েত ভেটো সব ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়েছে।

১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট নয়াদিল্লিতে ভারত সোভিয়েত মৈন্ত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি হলো শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অসামান্য কূটনৈতিক সাফল্য। এই চুক্তির আরো একটি বড় অর্জন রয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালে চীনের কাছে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অত্যন্ত গ্লানিকর পরাজয় মেনে নিতে হয়েছিল। অতএব ১৯৭১-এ ভারতের চীন ভীতি ছিল বৈকি। যদিও ভুট্টো কোনো সরকারি পদে ছিলেন না, তবুও তার নেতৃত্বে একটি দল পাঠানো হয় চীনে তাদের সাপোর্টার জন্য। এই দলে ছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান রহিম খান এবং সেনাবাহিনীর চিফ অফ জেনারেল গুল হাসান খান। চীন সোজাসুজি বলে দিয়েছিল যে বিবাদটিকে যেন যুদ্ধে রূপ না দেয়। কেননা যেহেতু ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি হয়েছে, তাই তারা কোনো রকম যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। আর সে জন্য শেষ মুহূর্তে জেনারেল নিয়াজীর শত প্রত্যাশার পরও উত্তর দিকে থেকে পীতবর্ণের কেউ আসেনি। ভুট্টোর বন্ধু এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্য ব্যারিস্টার রফিরাজার বইতে ভুট্টোর এই ব্যর্থ চীন যাত্রার উল্লেখ রয়েছে।

পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে শুরুতে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে তা হতো একটা চরম হঠকারিতা। একটি মুসলিম রাষ্ট্রও কিন্তু বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেনি। এখন তারা এটিকে মুসলিম বিদ্বেষী কাজ বলে চিহ্নিত করত এবং কোনো সোভিয়েত ভেটো পাওয়া যেত না এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। যে কোনো মুক্তি সংগ্রামে প্রয়োজন রাষ্ট্রের নৈতিক, আর্থিক এমনকি সামরিক সাহায্যের। কেননা দখলদার বাহিনী খুব সহজে ক্ষমতা ছাড়তে হয় না, কলোনির সম্পদ ভোগ করার নেশায় এরা বুঁদ হয়ে থাকে। মার্চ মাসে পাকবাহিনী আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে তাদের আশ্রয় এবং সাহায্য নিতে হয় আমাদের। পাকিস্তানের দালালরা অবশ্য বলে থাকে যে ভারত উসকিয়ে দিয়েছে যার ফলে এই যুদ্ধি সংঘটিত হয়। এ কথা যারা বলে তারা জানে না অর্থাৎ মুখ।

১৯৭০-এর নির্বাচন থেকে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত ভারতের কোনোরকম ভূমিকা ছিল না। বরঞ্চ পাকিস্তানের কয়েকজন তৎকালীন জেনারেল লিখেছেন যে পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকদের একগুঁয়েমি এবং চক্রান্তের ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যার সুযোগ ভারত নিয়েছে। তারা এ কথা বলেছেন যে একমাত্র শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করে এ সমস্যার সমাধান করা যেত।

যা হোক এই স্বীকৃতি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয়ায় রাষ্ট্রের নিশ্চিত করে তোলে। কেননা ভারত স্বীকৃতি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক নিয়ে সমর্থন নিশ্চিত হয়ে ওঠে। সে সময় বিশ্বের দুই শিবিরের নেতৃত্বে ছিল যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন।

অতএব অস্তিত্বের টিকে থাকার জন্য দুই শিবিরের যে কোনো এক শিবিরের আশ্রয় নিতে হতো, তাই বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দেয়ার অর্থই হলো বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্থান পেল।

উল্লেখ্য, আফ্র এশিয়ার বহু দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। ভারতের স্বীকৃতির ফলে আমরা অনুধাবন করলাম যে পাকিস্তানের পরাজয় তথা বিতাড়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই সেই দিনের সেই অনুভূতি সে সময় যারা উপভোগ করেছিল সেটা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। সে জন্যই বলছি যে ৬ ডিসেম্বর দিবসটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জ্বলজ্বল করে জ্বলবে।

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক ইপিসিএস ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App