×

মুক্তচিন্তা

নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:৪৬ পিএম

যারা বিরোধী দলে থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে চান, তাদের জিজ্ঞেস করতে হয় আপনাদের আমলে কবে কখন গণতন্ত্র ছিল? কখনো ছিল না। ওরা ‘মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট’ ধরনের ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। আবার তারা সেটা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। অবশ্য পাশাপাশি এও বলি, দিন আসছে, গণতান্ত্রিক কার্যক্রম ও গণতন্ত্রের চর্চার ধারা অবারিত রাখতে হবে। মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে উল্লিখিত কথাগুলো বলা। ধন্যবাদ জানাই ঐক্যফ্রন্ট ও ফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনকে। নির্বাচন হবে কি হবে না সেটা অল্প কিছুদিনের মধ্যে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই চলমান মুহূর্ত পর্যন্ত যেটুকু অনুধাবন করা যায়, তাতে মনে হয় নির্বাচন হয়তো হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কে সেরা নেতা? দেশ শাসনে কে বেশি পারঙ্গম ও দক্ষ? দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা বিষয়ে কোন রাজনীতিকের একটা বাস্তবোচিত ও সুস্পষ্ট ভিশন বা স্বপ্ন দৃষ্টি আছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো অনেকে জেনেও বলতে চাইবেন না। বিশেষ করে এটা নির্বাচনের মাস। বিজয়ের মাসও বটে। তবে আমি মনে করি গত দশ বছরে বাংলাদেশের শোচনীয় দরিদ্র দশা থেকে প্রায় মধ্য আয়ের একটি দেশে পরিণত হওয়া দেখে উত্তরটা খুব সহজে অনুধাবন করা যায়।

বলা যায় বাংলাদেশে বিশাল উন্নয়নের যিনি রূপকার, দেশ শাসনে যিনি দক্ষ তার নাম শেখ হাসিনা। ড. কামাল হোসেন নন, খালেদা জিয়া নন, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একটা উচ্চ স্থান দিয়েছেন, শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ নন।

বলে রাখি সামনে সাধারণ নির্বাচন বলেই আগে খালেদা-হাসিনার তুলনা করলে বলা হতো উনিশ-বিশ। সত্যের খাতিরে বললে বলতে হয় তফাৎটা এখন আকাশ-পাতাল।

প্রতিপক্ষের রাজনীতিকরা উন্নয়নে উন্নয়নে বাংলাদেশকে বদলে দেয়া নিয়ে তেমন উচ্চ বাক্য করেন না। অর্থাৎ দেশের নানামুখী উন্নয়ন যে হয়েছে এবং হচ্ছে সেটার মান্যতা দেন। না দিয়ে গত্যন্তর নেই বলেই দেন। তবে দুর্নীতি ও গণতন্ত্র না থাকা নিয়ে তারা বড়ই সোচ্চার। তারা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চান। চান বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার।

সত্য বটে দেশে অর্থনৈতিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনীতিতে দুর্নীতির রাহু বিরাজ করছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা ও ক্রমপ্রতিষ্ঠা আগের যে কোনো সময়ের চাইতে বৃদ্ধি পেলেও দেশে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র পূর্ণতা পায়নি।

তবে যারা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে নির্বাচন জিতে দেশ শাসনের দায়িত্বে যেতে চান, যাদের সব মিলিয়ে ষোল বছরের শাসনামলে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার কোনো সুনির্দিষ্ট চেষ্টা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তাদের আমলে দুর্নীতি বরং নানাভাবে উৎসাহিত হয়েছে। পরিষ্কার অনুধাবন করা যায় দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার বিষয়ে তারা যা কিছু বলেন তা নেহাতই কথার কথা। নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় সরকারকে জনগণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করতে দুর্নীতিমুক্তির এই নির্বাচনী কৌশল নিয়েছেন প্রতিপক্ষ।

এর মানে অবশ্য এই নয় যে দেশে দুর্নীতি নেই। রাজনীতি, প্রশাসন, পুলিশ ও উন্নয়ন কার্যক্রমের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বিরাজমান। তবে বিএনপি-জামায়াত-ঐক্যফ্রন্ট দুর্নীতি দমনের যোগ্যতা রাখে না। সেটা বিএনপি-জামায়াত সব মিলিয়ে তাদের ১৬ বছরের শাসনামলে ভালোভাবেই প্রমাণ করেছে পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুর্নীতি ভেতরে ভেতরে বাড়ে বৈ কমে না। তার কারণ হতে পারে মূলত দুটো। এক. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়া। দুই. অর্থনৈতিক কার্যক্রমে জবাবদিহির অভাব। অনেকের মতো আমারও বিশ্বাস রাষ্ট্রীয় ও সংবিধানিক পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা শক্তিশালী না হওয়া পর্যন্ত দুর্নীতিকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভবপর হবে না। এবারে নির্বাচন জিতে যে দল বা জোটই ক্ষমতায় আসুক, দুর্নীতি দমনে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সব ক্ষেত্রে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন না করলে দুর্নীতি কথার কথা হয়েই থাকবে। গণতন্ত্র মানুষের অধিকার বুঝায়। কথা বলার অধিকার। চলাফেরা, মিটিং-মিছিল করার অধিকার। সংবাদপত্রে মতামত প্রকাশের অধিকার।

তবে বিশ্বের কোনো দেশেই জঙ্গিদের, সন্ত্রাসীদের, দেশের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতাবিরোধীদের, সংবিধান মান্য না করাদের, মতামত প্রকাশের নামে স্বেচ্ছাচারীদের কোনো গণতান্ত্রিক অধিকার থাকে না। সেদিন বড় একটি দৈনিকের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় এক নিবন্ধ লেখককে দেখলাম জাতির জনক শব্দটি ইনভার্টেড কমার মধ্যে রাখতে। সংবিধানে যাকে জাতির পিতা বলা হয়েছে তিনি তো মীমাংসিত, বিতর্কিত কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তি নন, তাহলে কেন এই ইনভার্টেড কমা? ইচ্ছে করে নাকি অজ্ঞতা?

যাহোক, আমি যা বলতে চাই, তা হলো গণতন্ত্রের চর্চা রাষ্ট্র ও সমাজ বিকাশের জন্য অপরিহার্য। তবে লোকজন কেন হরতাল পালন করল না সেই কারণে অগ্নি সন্ত্রাস এবং মানুষ হত্যা করার নাম গণতন্ত্র নয়। যা খুশি করলাম, রাষ্ট্র ও সংবিধানের বিরুদ্ধে বললাম, সেটা গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। অতীতে এবং বর্তমানে যারা এসব করেছে এবং করে চলেছে, তারা নির্বাচন জিতে ক্ষমতায় গেলে জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার পাবে কিনা এটা বলা সহজ নয়।

বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের বিষয়টি বুঝা খুব কঠিন। তারা পঁচাত্তর সালের পর থেকেই চাচ্ছে এমন একটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পত্তন ঘটাতে যার শুরু পঁচাত্তরের পর সমর নায়ক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। এই দেশে ১৯৫২ সাল নেই, ১৯৬২ সাল নেই, ১৯৬৬ বা ১৯৭৯-এর গণঅভ্যুত্থান নেই। এই দেশে শহীদ মিনার থাকবে না।

পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এমন এক বাংলাদেশ তৈরির চেষ্টা হতে থাকে যে দেশে রবীন্দ্র সঙ্গীতের চর্চা তীর্যক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছিল। কাজী নজরুলের শুধু ইসলামী গান ও কবিতা গৃহীত হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের শুরু করা সেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল ভারতবিরোধী।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ঘোষণা তারাই দেয়। দিচ্ছে। তাদের গণতন্ত্র তাদের একান্ত নিজস্ব। সেখানে গণতান্ত্রিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গণতন্ত্র নেই। তাদের গণতন্ত্রে যা আছে সেটা পাকিস্তানি গণতন্ত্রের সঙ্গে বর্ণে বর্ণে মেলে। এই গণতন্ত্র তারা পুনরুদ্ধার করতে চায়। পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় সরকারে গণতন্ত্রের চর্চা কতটা হয় সেটা বলার কিছু নেই।

শুধু এটুকু বলব, তার শাসনামলে চেষ্টা আছে। অন্তত স্বঘোষিত খুনিদের দায়মুক্তি দেয়ার আইন তার আমলে পার্লামেন্টে পাস হয়নি। যারা বিরোধী দলে থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে চান, তাদের জিজ্ঞেস করতে হয় আপনাদের আমলে কবে কখন গণতন্ত্র ছিল? কখনো ছিল না। ওরা ‘মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট’ ধরনের ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। আবার তারা সেটা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।

অবশ্য পাশাপাশি এও বলি, দিন আসছে, গণতান্ত্রিক কার্যক্রম ও গণতন্ত্রের চর্চার ধারা অবারিত রাখতে হবে। মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন।

সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে উল্লিখিত কথাগুলো বলা। ধন্যবাদ জানাই ঐক্যফ্রন্ট ও ফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনকে। নির্বাচন হবে কি হবে না সেটা অল্প কিছুদিনের মধ্যে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই চলমান মুহূর্ত পর্যন্ত যেটুকু অনুধাবন করা যায়, তাতে মনে হয় নির্বাচন হয়তো হয়ে যাবে। কামাল হোসেনের নেতৃত্ব গুণে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি সম্ভবত মেনে নিতে পারছে বিএনপির দলীয় প্রাধান্যে গড়া ঐক্যফ্রন্ট।

নির্বাচনে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের অনেকের অভিমত। দুই প্রধান জোটের রাজনীতিকদের অবশ্য ধারণা একটু ভিন্ন। বিরোধী পক্ষের কথা, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় জোট ৩০টির বেশি আসন পাবে না। সুষ্ঠু ভোট বলতে যদি বিএনপি-জামায়াতসহ ঐক্যফ্রন্টকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া বুঝায় তাহলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের নির্বাচনে ৩০টা আসনই বা পাওয়ার কি দরকার। দু-চার পাঁচটা সিট দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।

এদিকে আবার আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের বলেন যে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপির এমনই দৈন্যদশা যে দলটা তাদের ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে নির্বাচন ছেড়ে পালিয়ে না যায়।

রাজনীতিতে এর নাম গণতান্ত্রিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধ নির্বাচনী রাজনীতিরই অংশ। কাজেই পক্ষ-প্রতিপক্ষের এসব কথা শুনে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। বরং নির্বাচনী রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিষয়টি মেনে নিয়ে এই উপসংহারে উপনীত হওয়াই ভালো যে নির্বাচনে পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। একটা ভালো নির্বাচন সবাই চায়। ভালো নির্বাচন হবে, এই আশায় আমিও ৩০ ডিসেম্বরের দিকে তাকিয়ে।

রাহাত খান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App