×

মুক্তচিন্তা

তাঁর নিবিড় কোমল কবিসত্তা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:৪৬ পিএম

বাহান্নর ভাষা আন্দোলন নতুন সঞ্জীবনী, নতুন প্রাণশক্তি ও উদ্যমে সিক্ত প্রাণিত করেছিল আমাদের সাহিত্যকে। সে এক আশ্চর্য বাঁকবদল। পূর্ববাংলার শোষিত বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে পশ্চিমা শাসকরা নানা নিষ্পেষণে দমিত করে রাখতে নির্মম ও মরিয়া হয়ে উঠেছিল। প্রতিবাদী বাঙালি সেসব ষড়যন্ত্র ইস্পাতদৃঢ় প্রত্যয়ে রুখে দাঁড়ায়। স্বাধিকার আদায়ের সেই আন্দোলন ছিল আপসহীন। তরুণরা বুকের রক্ত ঢেলে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে।

পরবর্তীকালে এই ভাষা দিবস বিশ্ব ঐতিহ্যের অঙ্গীভূত হয়েছে। সেই বিপ্লবী, নমস্য ভাষাসংগ্রামীদের অন্যতম একজন কবি তোফাজ্জল হোসেন। তাঁর রচনায় সেই প্রতিবাদী চেতনার শাণিত শিল্পিত রূপায়ণ ও বিশ্বস্ত প্রতিফলন আমরা দেখি। সবিস্ময়ে লক্ষ করি, সেই দ্রোহের প্রাণরস তাঁর রচনাবলীতে জারিত হয়েছে নানা মাত্রিকতায়। আপন দ্যুতিতে, মহিমায়, বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর হয়ে উঠেছে।

কবি তোফাজ্জল হোসেনের একুশে কেন্দ্রিক রচনার সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। ভাষা আন্দোলনকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, সক্রিয় অংশী ছিলেন। মনন ও বোধের নানা দিক থেকে আলো ফেলে এই মহতী আন্দোলনকে তিনি দেখেছেন। সময়ে সময়ে বহুকৌণিক মাত্রা ও পর্যবেক্ষণে নিবিড় বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার প্রয়াস পেয়েছেন এই অত্যাশ্চর্য ঐতিহাসিক ঘটনার।

শুধু কবিতাই নয়, অনেক সুললিত আবেদনমণ্ডিত গান তিনি লিখেছেন একুশে নিয়ে। রচনা করেছেন প্রবন্ধ, গর্বিত সেই অধ্যায়ের একজন হিসেবে স্মৃতিচারণ করেছেন। এই ক্ষুদ্র আলোচনা সীমিত থাকছে শুধু তাঁর কবিসত্তা নিয়ে।

তোফাজ্জল হোসেনের কবিতাসমগ্র প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অন্তর্ভুক্ত কবিতাগ্রন্থসমূহের নাম- হৃদয় রক্তরাগে, একুশ ভুবনময়, দেশাত্মবোধক গান, পরিবেশের গান, বিবিধ গান, কবিতার গান, আবৃত্তির কবিতা, নতুন যুগের ভোরে, অগ্রন্থিত কবিতা, অনূদিত রুশ কবিতা এবং প্রগতিশীল উর্দু কবিতা অনুবাদ।

একুশে নিয়ে তিনি লিখেছেন গণসঙ্গীত, জাগরণী উদ্দীপনামূলক গীতিছন্দে উৎকীর্ণ রয়েছে তাঁর গভীর দেশপ্রেম, গীতলতার লালিত্য, ছন্দসুষমা। চিত্রকল্পে, উপমায়, আবহ নির্মাণে গানের অবয়ব কাঠামোর আড়ালে শাশ্বত চিরন্তন সোঁদামাটির বাংলাদেশকে আমরা সমুজ্জ্বল দেখতে পাই। আমাদের মননে কাঁপন জাগে, হৃদয় শিহরিত হয়।

অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আমরা উদ্বোধিত, আপ্লুত হওয়ার অবকাশ পাই। আজীবন নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ এই গীতিকার তাঁর জীবৎকালে যোগ্য সম্মান পাননি, মরণোত্তর কালে আরো নয়Ñ এই লজ্জা ও দৈন্য আমাদের সবার। দূরদর্শী এই মানুষটি ছিলেন এ দেশের অন্যতম অগ্রণী পরিবেশচিন্তক, প্রকৃতিপ্রেম ছিল তাঁর জীবনযাপনের একান্ত ও অনিবার্য অনুষঙ্গ। সেই কোন কালে তিনি পরিবেশ নিয়ে এন্তার লেখালেখি করেছেন, মানুষকে পরিবেশ সচেতন করে তুলতে চেষ্টা করে গেছেন প্রাণপণ। এই ঋণ আমাদের স্বীকার করতেই হবে।

আগেই বলেছি, একুশের প্রেরণায় তাঁর লেখক সত্তার স্ফুরণ, বিকাশ ও ক্রমপরিণতি। অতলগভীর দেশব্রতে নিবেদিত তাঁর মনপ্রাণ, রক্তরঞ্জিত মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের অহঙ্কৃত অভ্যুদয় তাঁকে আনন্দিত উদ্ভাসিত করে তোলে। দেশ, মা, মাটির কাছে সেই অপরিমেয় ঋণ তিনি গর্বিতচিত্তে, অকুণ্ঠ আয়াসে স্বীকার করেন, মাতৃভূমির বহুল আকাক্সিক্ষত মুক্তির আনন্দে তাঁর হৃদয়ে জাগে স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসের ঘুমভাঙানিয়া হৃদয়কাঁপানো হিল্লোল। আরেকটি গানে আমরা পাই সেই ছন্দদ্যুতির আলোছায়ার ঝিলিক- শ্যাম ছায়া ঘোরা রূপসী বাংলা রক্তের দামে কেনা জানা ও অজানা শহীদের কাছে এ মাটির বহু দেনা। এদেশে ঘটেছে যুগে যুগে বহু হায়েনার আগমন দেশের মাটিতে এদেশবাসীর হয়েছে বন্দিপণ; থরে থরে যত সম্পদরাজি অঢেল করেছে লুট সাধু বেশে এসে জাঁকিয়ে বসেছে স্বরূপ যায়নি চেনা॥ লুটেরাদের এই কালিমা মলিন বাংলার ইতিহাস এদেশবাসীরা বিদেশি শাসনে হয়েছে রুদ্ধশ্বাস যাদের শাসন-ত্রাসন-পীড়ন শক্তির জাঁতাকলে এদেশের ধন মাটি ও মানুষ হয়ে গেছে বেচাকেনা॥

এই কবি ছিলেন বিশ্বনাগরিক। কবিতায় তো বটেই, ছড়ার আদলেও তিনি নিপুণ দক্ষতায় এঁকেছেন ভূম-লে পরিভ্রমণের আনন্দস্মৃতি। অঙ্গীকার করেছেন বিশ্বসংসারের সাবলীল ও প্রত্যাশিত ঐক্য, মানবিকতা, সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছেন অনাবিল, নির্মল আনন্দ। এই সহজিয়া অন্বেষণের সারল্যই তো কবির কাছে আমাদের আকাক্সিক্ষত, যার অন্বেষা সুন্দর সত্য ও কল্যাণ। কবির মননে জাগ্রত যে মানবে মানবে সম্মিলন, মিথষ্ক্রিয়ার সত্যসিক্ত কল্যাণ ও শুভবোধ, তা পাঠকমনে খুব সহজেই সঞ্চালিত হয়, তাকে রোমাঞ্চিত, তরঙ্গায়িত করে অনায়াসে। ‘অলিম্পিক’ শিরোনামের কবিতা বা পদ্যে তিনি লেখেন, এত দেরি করে কেন আসে অলিম্পিক চার বছর পরে আসা নয় মোটেই ঠিক আমরা প্রতি দুবছরে অলিম্পিক চাই অলিম্পিকের আনন্দ তো আর কিছুতে নাই সারাবিশ্বের ক্রীড়াবিশ্বের ক্রীড়ার আসর বিশ্ববাসীর কাছে এ এক বিরাট খবর

তোফাজ্জল হোসেনের কবিতাসমগ্র-এর ফ্ল্যাপে তাঁর কবিসত্তার মূল্যায়নের প্রয়াস পেয়েছেন মনস্বী কবি লেখক বেলাল চৌধুরী। ‘আত্মপরিচয়ে ঋদ্ধ বাংলা ও বাঙালি’ শিরোনামের ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে-

“ফুল দিয়ে গাঁথা একটি তোড়ার মধ্যে যেমন রয়েছে ‘হৃদয় রক্তরাগে’ রঞ্জিত বহুবর্ণের দ্যুতি; তেমনই রয়েছে স্বদেশ, সমকাল, সতীর্থদের নিয়ে এক সহৃদয়সম্বাদী সমুজ্জ্বল সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন। অতীতচারণা নয় বরং মর্মে মর্মে সহমর্মিতা তার দীপ্তি ছড়িয়ে চলেছে চতুর্দিকে। অমর একুশের সাক্ষ্যবহ, উচ্ছ্বাসে দুর্মর, প্রাণোচ্ছল প্রতিটি পঙ্ক্তিমালাতে অগ্নিকণার বিচ্ছুরণ।...”

আজ কবি-লেখক-সাংবাদিক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক তোফাজ্জল হোসেনের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

হাসান হাফিজ : কবি ও সাংবাদিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App