×

মুক্তচিন্তা

নাইকো দুুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০১৮, ০৯:০৩ পিএম

চুক্তিটি সম্পাদনের সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অনুমোদনও গ্রহণ করা হয়নি। সে ক্ষেত্রে একটি অস্পষ্ট অবিশ্বাস্য মৌখিক নির্দেশনার বরাত দেয়া হয়েছে। এসবের মাধ্যমে বিষয়টির স্বচ্ছতার মান একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। একটি বিতর্কিত পদ্ধতি প্রবর্তন এবং কার্যক্ষেত্রে সেটাকেও লঙ্ঘনের দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ অব্যবস্থাপনায় এক ধরনের মারাত্মক অবিমৃশ্যকারিতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। বিপুল মজুদ সত্ত্বেও ছাতক ও অন্যান্য গ্যাসক্ষেত্রকে প্রান্তিক ঘোষণা করে দেশকে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক ধরনের স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন করা হয়। এই বিশ্লেষণ থেকে পাঠকরা পরিষ্কার যে, নাইকো দুর্নীতি মামলায় স্পষ্টত খালেদা জিয়া জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

সম্প্রতি আদালতে খালেদা জিয়া অভিযোগ তুলেছেন, ‘নাইকো দুর্নীতি মামলা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে না চললে তার বিরুদ্ধে চলছে কেন?’ উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ২০১০ সালের মার্চে হাইকোর্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলা বাতিল করে দেন। রায়ে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই মামলাটি করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬-২০০১ সালে নাইকোর সঙ্গে দর কষাকষি করেছে, শেষ পর্যন্ত চুক্তি করেনি কারণ নাইকোর একটি শর্ত বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে ছিল। বাংলাদেশবিরোধী শর্ত মেনে না নেয়ায় তখন নাইকোর সঙ্গে কোনো চুক্তিই সই হয়নি। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই নাইকোর সঙ্গে তাদের সব শর্ত মেনে চুক্তি সই করে ফেলে। ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর নাইকো-বাপেক্স ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’ (জেভিএ) সই হয়। পরবর্তী সময় কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয় যে, নাইকো বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার আমলে ঘুষ দিয়ে কাজ পায়। হাওয়া ভবনের গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ঘুষ নেন এবং খালেদা জিয়ার তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনকে ১ লাখ ৯০ হাজার কানাডিয়ান ডলার দামের একটি গাড়ি ও বিদেশ সফরের জন্য পাঁচ হাজার ডলার ঘুষ দেয়ার অভিযোগ ওঠে নাইকোর বিরুদ্ধে। দুর্নীতির মাধ্যমে নাইকোর সঙ্গে বাপেক্সের চুক্তি সম্পাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত হিসেবে তৎকালীন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদসহ ২৬ জনের নাম আন্তর্জাতিক আদালতে (ইকসিড) উপস্থাপন করা হয়। এ মামলার অভিযোগে বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডার কোম্পানি নাইকোর হাতে তুলে দেয়ার মাধ্যমে খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য আসামি রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন। ক্ষতি করার অভিযোগে ২০০৭ সালে ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করে ‘দুদক’। শেখ হাসিনা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে নাইকোর সঙ্গে কোনো চুক্তিই করেননি। কাজেই তার বিরুদ্ধে নাইকো সংক্রান্ত মামলার হিসাব খুবই সহজ। শেখ হাসিনা চুক্তিই করেননি, কাজেই মামলা খারিজ হয়েছে। আর খালেদা জিয়া দেশবিরোধী চুক্তি করেছিলেন দুর্নীতির মাধ্যমে, কাজেই খালেদা জিয়া এবার শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন।

খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির একাধিক মামলা লড়ে যেতে হচ্ছে। এ মামলাগুলোর মধ্যে ‘নাইকো মামলা’, ‘গ্যাটকো মামলা’, ‘বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি মামলা’- এই তিনটি দায়ের করা হয় ২০০৭-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। তার সাজা হয়েছে কেবল ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা’য় (২০০৯ সালে মামলা হয়)। তবে দুর্নীতির পাঁচটি মামলা ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরো ৩১টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মামলা নাশকতার। সেই সঙ্গে রয়েছে মানহানি এবং রাষ্ট্রদ্রোহের বেশকিছু মামলা। ১৫ আগস্টে তার জন্মদিনটি ভুয়া- এই অভিযোগেও একটি মামলা রয়েছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় নাইকো দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০০৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদক এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয়। ২০০৮ সালের ৫ মে থেকে এ মামলায় চার্জ শুনানি শুরু হয় তা আজো শেষ হয়নি। বলা হচ্ছে, মওদুদ আহমদ সাহেবের জন্যই শুনানি ঝুলে আছে। এ মামলায় এ পর্যন্ত এজাহার, চার্জশিট ও প্রসিডিংসহ অনেক বিষয়ই তারা চ্যালেঞ্জ করেছেন। কিন্তু কোনো আদেশ আনতে পারেননি। তবে নানা অজুহাতের পর এখন আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। নাইকো মামলায় ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর আদালতে খালেদা জিয়া আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেছিলেন।

‘নাইকো’ মামলার অভিযোগসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় খালেদা জিয়া এবং অন্যরা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন রাষ্ট্রবিরোধী ওই কর্মকাণ্ডে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনের মতামত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তারা অন্যদের সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশে নিজেরা লাভবান হয়েও নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেডকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে লিখিত নির্দেশ না দিয়ে একটি অপকৌশলের মাধ্যমে মৌখিকভাবে ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’ চূড়ান্তকরণের নির্দেশ প্রদান করেন। তৎপ্রেক্ষিতে ‘কামতা’ গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসের মজুদ ও উত্তোলনযোগ্য পরিমাণ কম থাকায় নাইকো রিসোর্সেস লি.-এর অনীহার কারণে ‘কামতা’ গ্যাসক্ষেত্র ব্যতীত ছাতক ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’ সম্পন্ন করা হয়। যার ফলে ছাতক ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের এ রকম ক্ষতিসাধন করা হয়- ছাতক পূর্বাংশ গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ গ্যাসের পরিমাণ ১৯০০ বিসিএফ আর উত্তোলনের যোগ্য গ্যাসের পরিমাণ দেখানো হয় ১১৪০ বিসিএফ। ছাতক পশ্চিমাংশ ৬৭৭ বিসিএফের বিপরীতে ৪৭৪ বিসিএফ, ফেনীতে ১৮৫ এর বিপরীতে ১৩০ বিসিএফ দেখানো হয়। অর্থাৎ উত্তোলনযোগ্য ১৭৪৪ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলনের অবৈধ সুবিধাপ্রাপ্ত হয় নাইকো। তন্মধ্যে শর্তানুযায়ী নাইকো রিসোর্সেস (বাংলাদেশ) লি. ন্যূনতম ১০ হাজার কোটি টাকার মূল্যমানের সুবিধাপ্রাপ্তির অবৈধ সুযোগ লাভ করে। আমরা জানি ‘গ্যাস’ বাংলাদেশের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। সমগ্র বাংলাদেশকে ২৩টি বøকে ভাগ করে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। আর এই ২৩টি ব্লকের মধ্যে ১৫টি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। বাকি ৮টি বøকে এ পর্যন্ত মোট ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র বা ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে; রয়েছে ৬২টি ক‚প। গ্যাস উত্তোলন করা ওই ১৯টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ছাতক ও কামতা গ্যাসক্ষেত্র বাদে ১৭টি ক্ষেত্রের গ্যাস উত্তোলন বর্তমানে চালু আছে। সরকারের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এবং এর অধীনে পেট্রোবাংলা প্রধানত এসব গ্যাসক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করে। পেট্রোবাংলার অধীনে আবার ১১টি কোম্পানি রয়েছে। যার মধ্যে বাপেক্স, সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লি. এবং বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস লি. ‘নাইকো’ মামলা সংশ্লিষ্ট ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’-এর সঙ্গে সম্পর্কিত।

নাইকো দুর্নীতি মামলার সামগ্রিক দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ছাতক ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্র দুটি প্রান্তিক বা পরিত্যক্ত ঘোষণা, বাপেক্সের সঙ্গে প্রস্তাবক কোম্পানি নাইকোর ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’ সম্পাদনা এবং ওই ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’-এর আওতায় গ্যাসক্ষেত্র দুটিকে উৎপাদন উপযোগী করার ক্ষেত্রে চাতুর্যের আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। ‘যৌথ সহযোগিতা চুক্তি’ সম্পাদনের মাধ্যমে প্রযুক্তি হস্তান্তরের লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি। চুক্তিটি সম্পাদনের সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অনুমোদনও গ্রহণ করা হয়নি। সে ক্ষেত্রে একটি অস্পষ্ট অবিশ্বাস্য মৌখিক নির্দেশনার বরাত দেয়া হয়েছে। এসবের মাধ্যমে বিষয়টির স্বচ্ছতার মান একেবারে শূন্যের কোটায় নেমে আসে। একটি বিতর্কিত পদ্ধতি প্রবর্তন এবং কার্যক্ষেত্রে সেটাকেও লঙ্ঘনের দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ অব্যবস্থাপনায় এক ধরনের মারাত্মক অবিমৃশ্যকারিতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। বিপুল মজুদ সত্ত্বেও ছাতক ও অন্যান্য গ্যাসক্ষেত্রকে প্রান্তিক ঘোষণা করে দেশকে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক ধরনের স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন করা হয়। এই বিশ্লেষণ থেকে পাঠকরা পরিষ্কার যে, নাইকো দুর্নীতি মামলায় স্পষ্টত খালেদা জিয়া জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

ড. মিল্টন বিশ্বাস :  অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App