×

জাতীয়

স্থানীয়দের আর সহানুভূতি নেই রোহিঙ্গাদের প্রতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০১৮, ০৪:৪৮ পিএম

স্থানীয়দের আর সহানুভূতি  নেই রোহিঙ্গাদের প্রতি
এক বছর আগে মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দিকে মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন উখিয়া ও টেকনাফবাসী। কিন্তু এখন আর সেই সহানুভ‚তির অবশিষ্টটুকু নেই বললেই চলে। উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন দ্বিগুণেরও বেশি। ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয়দের জীবন ও জীবিকা আজ হুমকির মুখে। কেবল উখিয়া-টেকনাফের মানুষ নয়; রোহিঙ্গাদের কারণে পুরো কক্সবাজারের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়েছে বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য। স্থানীয়দের অভিযোগ : রোহিঙ্গাদের কারণে এলাকায় একবছর ধরে চাষাবাদ বন্ধ, জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। ধ্বংস হয়েছে পাহাড় ও বনভ‚মি। নষ্ট হয়েছে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, স্থানীয়দের শ্রমবাজার ও এলাকার উন্নয়ন অবকাঠামো। শুধু তাই নয় বেড়েছে বিভিন্ন সংঘাতও। যেসব এনজিও স্থানীয় জনগণের জন্য কাজ করত তারা এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করছে। সরকারি হিসেবে উখিয়া ও টেকনাফে মোট ৩০টি রেজিস্টার্ড ক্যাম্প রয়েছে। মূল সড়ক ধরে উখিয়া থেকে টেকনাফের যাবার সময় চোখে পড়ে বন বিভাগের জমি, সরকারি খাস জমি ও সাধারণ মানুষজনের জায়গায় ও পাহাড়ের গায়ে রোহিঙ্গাদের অসংখ্য খুপরি ঘর। পাহাড়ে কোনো গাছ নেই। শুধু ছোট ছোট ঘরের চালা। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী; গত বছরের ২৫ আগস্টের আগে গেজেটভুক্ত ৬৭৫ একর বনভ‚মিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছিল। নতুন করে রোহিঙ্গা আসা শুরু হলে স্থানীয় প্রশাসন উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গেজেটভুক্ত বনভ‚মিতে পাহাড় ও বন কেটে অস্থায়ী বসতি নির্মাণ করে। এ দফায় ৪ হাজার ৩১৮ একর বনভূমিতে রোহিঙ্গা বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এক হাজার ২০০ একর সামাজিক বনায়ন ও দুই হাজার ৩১৮ দশমিক ৬০ একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়। এতে সামাজিক বনায়নের সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ২১৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকারও বেশি। আর প্রাকৃতিক বনের গাছ, লতাগুল্ম, উলুফুল, বাঁশ, বেত, ঔষধি গাছ ও অনান্য উদ্ভিদের ক্ষতি হয়েছে ১৯৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার বেশি। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা বসতির কারণে বনজ সম্পদের ক্ষতি হয়েছে ৪১১ কোটি ২৮ লাখ টাকার বেশি। সম্প্রতি, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের কুতুপালং ও বালুখালীর এক হাজার ৫০২ হেক্টর প্রাকৃতিক বনভ‚মির মধ্যে ৭৯৩ হেক্টরই রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। এ ছাড়া টেকনাফ, উখিয়া ও হিমছড়ির এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৬০০ হেক্টর এলাকার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে বসানো হয়েছে কয়েক হাজার গভীর নলকূপ, যার প্রভাবে ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর কমার পাশাপাশি ভ‚মিধসের ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। উখিয়া সহকারী বন সংরক্ষক কাজী তারিকুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, ‘বন উজার হওয়ায় অনেক দুর্লভ প্রজাতির প্রাণীও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে।’ জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ক্যাম্পের মাটি ও পানি পরীক্ষা করা হয়েছে। দেখা গেছে, মাটির উর্বরতা অনেক কমেছে এবং পানিতে জীবাণুর পরিমাণও বেড়েছে। এসব বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। বিষয়টি বিবেচনাধীন আছে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নতুন করে ভাবছেন স্থানীয়দের জন্য। রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দকৃত অনুদানের ২৫ শতাংশ স্থানীয়দের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে উখিয়া টেকনাফে প্রায় ৫ লাখ স্থানীয়দের বিপরীতে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা হওয়ায় উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। স্থানীয়দের বিষয়টিও সরকার গুরুত্বসহকারে দেখছে।’ রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, ‘স্থানীয়রাই এখন বাঁচতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় দিনমজুরদের বাজার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় দিনমজুর যেখানে দৈনিক পাঁচশ টাকার চুক্তিতে কাজ করত সেখানে রোহিঙ্গারা তিনশ টাকায় কাজ করে। মজুরি কমের কারণে রোহিঙ্গাদের কদর বাড়ায় স্থানীয় শ্রমিকদের বাজার মন্দা। রোহিঙ্গাদের ইস্যু করে গত এক বছর ধরে কক্সবাজারে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। এনজিওগুলোর সব অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা এখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক। এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য কত টাকা আনছে, কত টাকা কোন খাতে ব্যয় করছে সেই হিসাব কে রাখছে?’ ৫ নং পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মানবিকতা দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। আমরাও তাদের সাদরে বরণ করেছি। আমাদের জায়গা জমিতে তাদের থাকতে দিয়েছি। কিন্তু দিন দিন এই পরিস্থিতি ভিন্ন হচ্ছে। সামাজিক বনায়নের জায়গায় গাছ কেটে, স্থানীয়দের কৃষি জমিতেও তারা ঘর করছে। এসব কাজে মদদ জোগাচ্ছে এনজিওরা। তারা আমাদের বসত বাড়িটিও কেড়ে নিতে চাইছে। রোহিঙ্গাদের তত্ত্বাধানের জন্য সরকারি যে কর্মকর্তা রাখা হয়েছে তারাও এনজিওর সঙ্গে তাল মিলাচ্ছে। আমি নিশ্চিত এসব কথা প্রধানমন্ত্রীর কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। স্থানীয়দের জমি দখল করে সরকারি অফিস করে সেগুলো এনজিওদের কাছে বেশি টাকায় ভাড়া দিচ্ছে। এনজিও এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আমাদের বোঝা’। ‘পরিকল্পিত উখিয়া চাই’ আন্দোলনের আহবায়ক এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব নূর মোহাম্মদ শিকদার বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে এসে বসবাস করার ইতিহাস দীর্ঘ। তবে ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের যে স্রোত এসেছে তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। রোহিঙ্গারা সাহায্য সহযোগিতা পেলেও স্থানীয়দের জন্য দৃশ্যমান কোনো কিছু এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। আমাদের এলাকায় এতদিন কোন যানজট ছিল না। এখন সড়কে দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে স্থানীয়দের। রোহিঙ্গারা আসার পর এখানে নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজ বেড়ে গেছে।’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App