×

অর্থনীতি

অনিয়ম প্রমাণে মরিয়া ছিলেন গোয়েন্দারা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০১৮, ১১:২৪ এএম

অনিয়ম প্রমাণে মরিয়া ছিলেন গোয়েন্দারা
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা স্বর্ণ অনিয়মের ঘটনায় বেরিয়ে এসেছে নতুন রহস্য। এদিকে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদন গভর্নরের কাছে জমা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, ভল্টের স্বর্ণ পরীক্ষার পাশাপাশি এর ব্যবস্থাপনায় নতুন দিক নির্দেশনা দিয়েছে কমিটি। বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপন জুয়েলার্সের জব্দকৃত স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা নিয়ে প্রথমে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া, আরো কিছু বিষয় নিয়ে দ্ব›দ্ব দেখা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে কিছুটা আগ্রাসী মনোভাব নিয়েই ভল্ট পরিদর্শনে নামেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। ছয় স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তায় সুরক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট। সুতরাং সেখান থেকে স্বর্ণ চুরি বা এদিক-ওদিক করার সুযোগ নেই বললেই চলে। এরপরও যে করেই হোক ওই ভল্টের স্বর্ণ নিয়ে অনিয়ম প্রমাণ করাই ছিল শুল্ক গোয়েন্দাদের লক্ষ্য। এদিকে ভল্টের স্বর্ণালঙ্কারের ক্যারেট ও ওজনে হেরফেরের ফলে আর্থিক ক্ষতির যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে, তা আদৌ বাস্তবসম্মত নয় বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত জুলাইয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের পর নিজেদের তদন্তের ফলাফলে অনড় থাকে শুল্ক গোয়েন্দা, বাংলাদেশ ব্যাংকও দাবি করে ভল্টের স্বর্ণে অনিয়মের সুযোগ নেই। সংকট কাটাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে কোনো অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে স্থায়ী এবং অস্থায়ী স্বর্ণ রাখার ক্ষেত্রে কিছু নতুন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর আগে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বিষয়টি সম্পর্কে বলেছেন, ভল্টে রক্ষিত স্বর্ণ কমবেশি হয়নি। পদ্ধতিগত জটিলতায় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। জটিলতা ও বিতর্ক এড়াতে স্বর্ণ পরিমাপ পদ্ধতি আধুনিকায়নের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দার তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অস্থায়ী ভল্টে জমা আছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কেজি স্বর্ণ। তবে, ভল্টের যে চাকতি ও রিং নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে সেই চাকতি জমাকারী শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা গত ৮ মে লিখিতভাবে জানান, ‘তিনি ভল্টে যেভাবে চাকতি ও রিংটি রেখেছিলেন সেভাবেই আছে।’ মূলত, শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা এবং শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে একরকম মনোমালিন্য চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। দুপক্ষের মধ্যে নানা বিষয়ে বিরোধের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। শুল্ক গোয়েন্দারা বিভিন্ন সময়ে যে অবৈধ স্বর্ণ উদ্ধার করেন তা আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে মজুদ রাখা হয়। বৈধ দাবিদার পেলে তা ফেরত দেয়া হয়। মালিকানা প্রমাণ করতে না পারলে আইন মোতাবেক সেই স্বর্ণ নিলামে তোলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে থাকা ৯৬৩ কেজি ৪০৪ গ্রাম স্বর্ণের ওপর শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের একটি তদন্ত প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড থেকে ভাড়া করা মেশিনে স্বর্ণের মান যাচাইয়ের পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, স্বর্ণের সঠিকতা যাচাইয়ে আণবিক শক্তি কমিশনের দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ শুল্ক গোয়েন্দারা উপেক্ষা করেন। তারা জুয়েলারি দোকান থেকে ভাড়া করা মেশিন দিয়ে সেই কাজ সারেন। এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তদন্তকালীন শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা ড. মইনুল খানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। শুধু বলেছেন, আমি ওখান (শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর) থেকে চলে এসেছি। প্রতিবেদনে কী আছে, না আছে এখন আমার মনে নেই। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট মোট ২০ কর্মদিবস পরিদর্শন করেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তদন্তে এসে বিভিন্ন সময়ে শুল্ক কর্মকর্তারা অত্যন্ত কট‚ক্তি করে বলেছেন, ‘আপনারা রিজার্ভ চুরি করেছেন। স্বর্ণও চুরি করেছেন।’ যে চাকতি ও রিং নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা আপত্তি তুলেছেন সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা করা হয় ২০১৫ সালের ২৩ আগস্ট। তিন কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের এ চাকতি ও রিং জমা দেন ঢাকা কাস্টম হাউসের গুদাম কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ। গত ৮ মে হারুন অর রশিদ বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে যথার্থতা যাচাইশেষে এ মর্মে প্রত্যয়ন করেন, ‘জমা করা গোলাকার কালো প্রলেপযুক্ত স্বর্ণের চাকতি এবং কালো প্রলেপযুক্ত স্বর্ণের রিং যথাযথ আছে।’ জানা গেছে, আপন জুয়েলার্সের জব্দকৃত স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা নিয়ে প্রথমে দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ৮টি ট্রাঙ্কে ১৫ মণ স্বর্ণ নিরাপত্তা হেফাজতে রাখতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তারা মরিয়া হয়ে গেলেন স্বর্ণগুলো ভল্টে রাখার জন্য। এ নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাদানুবাদ হয়। এমনকি কোর্টের অনুমতি না নিয়েই স্বর্ণ রাখতে বলায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই তা রাজি হচ্ছিলেন না। এতে করে শুল্ক গোয়েন্দা বাহিনীর লোকজন ‘দেখে নেয়ার’ ও হুমকি দেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানা যায়। এ ছাড়া, শুল্ক গোয়েন্দারা তাদের ব্যানার টানিয়ে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ভল্টে রাখা স্বর্ণের সঠিকতা যাচাই কার্যক্রম শুরু করতে চেয়েছিলেন। তবে আইন অনুযায়ী ভল্টে সব ধরনের ব্যক্তির প্রবেশাধিকার না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে রাজি হয়নি। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে না দেয়ার বিষয়টি তখন ভালোভাবে নেননি শুল্ক গোয়েন্দার কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, চোরাই স্বর্ণ আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখা হয়। ব্যাগে ভরে ভল্টের মধ্যে বিশেষ বাক্সে রাখা হয়। পরে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে সে জন্য কাস্টমস কর্মকর্তার উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোনীত স্বর্ণকারের মাধ্যমে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে স্বর্ণের মান যাচাই ও পরিমাপ করা হয়। জমার সময় মনোনীত স্বর্ণকার চাকতির ৪০ শতাংশ বিশুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তা ভুলবশত ৮০ শতাংশ হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন। বাংলা ৪০ ও ইংরেজি ৮০ একই রকম দেখতে বলে এ ভুল হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক একে করণিক ভুল হিসেবে উল্লেখ করেছে। আবার শুল্ক গোয়েন্দা যিনি জমা দিয়েছেন তিনি জানিয়েছেন, যে চাকতি জমা দিয়েছিলেন সেটিই আছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা : বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের যে স্থানে স্বর্ণ রাখা হয় তা ৬ স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টার জন্য সেখানে পুলিশের বিশেষ বাহিনী সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করে। ৪০টি সিসিটিভি রয়েছে সেখানে। ভল্টে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিবার প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় তিন জায়গায় শরীর তল্লাশি করা হয়। ফলে কেউ চাইলেও ভল্ট থেকে স্বর্ণ বের করে নিয়ে যাওয়া বা পরিবর্তন করে অন্য স্বর্ণ রাখা অসম্ভব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App