×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:২৫ পিএম

 

ঢালাওভাবে সব সেক্টরকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত না করে এবং সবাইকে একই সহায়তা ও সুযোগ না দিয়ে দেশীয় শিল্পে উদ্যোক্তাদের টেকসই ও সহনশীল উন্নয়নের স্বার্থে সময়ে সময়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনার ভিত্তিতে শুধু নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ আহ্বান করা উচিত এবং খাতওয়ারি অগ্রগতি যাচাই করে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের শর্তগুলোও পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

দেশের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের জন্য পুঁজির অপ্রতুলতা থাকায়, বিপুল শ্রমিক শক্তির জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, দেশীয় কাঁচামালের কার্যকর ব্যবহারকল্পে উপযুক্ত প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি আমদানির দ্বারা উৎপাদন কৌশল জানা, আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানিমুখী শিল্প উদ্যোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও রূপান্তরে বাংলাদেশ বরাবরই বিদেশি পুঁজিপ্রত্যাশী।

সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনকালে প্রাইভেট সেক্টরের ওপর পাবলিক সেক্টরের প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ বলবত ছিল, দ্বিতীয়ার্ধে শিল্প উদ্যোগে পাবলিক সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ শিথিল এবং আধিপত্য হ্রাস পেতে থাকে। ১৯৮০-৮১ সালে সরকার প্রাইভেট সেক্টরের উন্নয়ন লক্ষ্যে নয়া শিল্পনীতিতে কিছু মৌল পরিবর্তন আনেন।

উল্লেখ্য, এ সময় ১৯৮০ সালেই ফরেন ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এন্ড প্রটেকশন এ্যাক্ট জারি হয়। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনস অথরিটি (বেপজা) এ্যাক্টও পাস হয় একই সময়। এতদসত্ত্বেও পুরো আশির দশকে বিদেশি বিনিয়োগ তেমন আসেনি বাংলাদেশে। পুরো দশকে ইপিজেডের বাইরে বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয় মাত্র ৪০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সত্তর ও আশির দশকে অর্থনৈতিক সাহায্য হিসেবে বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ ও অনুদান এসেছে মূলত পাবলিক সেক্টরের জন্য। প্রাইভেট সেক্টরের পুঁজির প্রয়োজনীয়তা ও তার চাহিদা সৃষ্টি হয় আশির দশকের শেষ ভাগে। প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশ শুরু হলে এবং বিদেশি পুঁজি প্রবেশের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সুযোগ-সুবিধার সমাহার ঘটানোর নীতিমালা ঘোষিত হলে, বিনিয়োগ বোর্ড এ্যাক্ট, ১৯৮৯ বলে প্রতিষ্ঠিত পোষক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ বোর্ডের (বর্তমানের বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি- সংক্ষেপে বিডা) কার্যক্রম শুরু হলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ও বাজার অর্থনীতির অবগাহনে বাংলাদেশ সিক্ত হলে, এশীয় উন্নয়ন দেশগুলো বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব ও দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর উন্নয়নের নতুন ধারা সূচিত হলে (যা এশিয়ান মিরাকল নামে খ্যাত) বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ গন্তব্য বা ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিভাত হয়।

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে নীতিমালা ঘোষিত হয় তাতে বলা হয় (১) বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো হবে ওই সব খাতে বা ক্ষেত্রে যেসব শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই অথচ যা বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয়, (২) বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করা হবে বাংলাদেশে বিদ্যমান ওই জাতীয় শিল্পে উৎপাদন ব্যবস্থার অধিকতর বিকাশ ঘটানোর জন্য যা সামাজিক প্রয়োজন ও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বিদ্যমান এবং (৩) বিদেশি বিনিয়োগে সেই শিল্প প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ ও সহায়তা প্রদান করা হবে যা অবদান রাখতে সক্ষম : দেশে পুঁজি, প্রযুক্তি এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা বৃদ্ধিতে, প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান, জরিপ ও আহরণে, ব্যালান্স সব পেমেন্ট পরিস্থিতির উন্নয়নে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে এবং অন্য যে কোনো উপায়ে দেশের অর্থনীতির সার্বিক বিকাশ সাধনে।

নীতিমালায় বলা হয়, দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তা বা উৎপাদন উদ্যোগে যেসব সুুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিধান দেয়ার ব্যবস্থা অনুসরণ করা হবে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একই সুুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার বিধান থাকবে এবং এ ব্যাপারে কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব ও বৈষ্যম্যমূলক আচরণ করা হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকে অধিকতর আকর্ষণের লক্ষ্যে ইক্যুইটি শেয়ারের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার মাত্রা বেঁধে না দেয়া এবং লভ্যাংশসহ পুরো পুঁজি প্রত্যাবাসনের অবাধ সুযোগ ঘোষিত হয়। মাত্র ৫টি খাত বাদে সব খাতে দেশি-বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার সুযোগও ঘোষিত হয়। বিদেশি প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায় বিদেশি বিশেষজ্ঞ কর্মীদের জন্য কর রেয়াতসহ সহজ শর্তে ওয়ার্ক পারমিট প্রদানের সুযোগ রাখা হয়। রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মেশিনারি ও কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক মওকুফের ব্যবস্থা ঘোষিত হয়।

দেখা যায় প্রতিবেশী দেশসমূহের তুলনায় বেসরকারি খাতে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ঘোষিত সুযোগ-সুবিধাদি বেশি এবং অধিকতর উদার। বিদেশি বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য শুল্ক মওকুফসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাদির অধিক সমাহারের ফলে একই পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য তা তীব্র প্রতিযোগিতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ব্যবসাবাণিজ্য বিনিয়োগে তারা ফেয়ার পেলে গ্রাউন্ড প্রতিষ্ঠার দাবি করেছেন পরবর্তীকালে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রদত্ত সুবিধা প্রত্যাহার করা যেমন জটিল হয়ে দাঁড়ায়, স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সব সুবিধা নতুন করে প্রদানেও নানাবিধ সমস্যার উদ্রেক করে।

বিদেশি বিনিয়োগের দ্বারা রপ্তানি বৃদ্ধি তথা ব্যালান্স অব পেমেন্ট পরিস্থিতির উন্নতির শুমারি করলে দেখা যায় ইপিজেডে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি বিনিয়োগ প্রকল্প থেকে রপ্তানি আয় স্বাভাবিক ও সহজভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তবে সে মাত্রা আমদানি (কাঁচামাল) বাদ দিয়ে ভ্যালু এডিশনের ক্ষেত্রে খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। ১০০% রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর শুল্ক রেয়াত বাবদ রাজস্ব আয় ভর্তুকি দিয়ে প্রকৃত প্রাপ্তির হিসাব আরো নাজুক অবস্থায় দাঁড়ায়। ইপিজেডে প্রতিষ্ঠিত শিল্প কারখানাসমূহের শতকরা ৮৭ ভাগের উৎপাদনে কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রপাতি আমদানিনির্ভর। ইপিজেড শিল্পসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্প। ইপিজেড এ দেশীয় কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য শিল্প এবং যা আরএমজির মতো মৌসুমি অস্থিরতা ও বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিজনিত হুমকির সম্মুখীন নয়, এমন শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্থনীতির জন্য লাভজনক হতে পারে।

উল্লেখ্য, সে জাতীয় শিল্পের সংখ্যা সীমিত। ইতোমধ্যে আরো ৫টি নতুন আঞ্চলিক ইপিজেড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় কাঁচামাল ও শিল্প উদ্যোক্তাদের রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী করে তোলা সম্ভবপর হলে ভালো হতে পারত।

বিডায় নিবন্ধিত বিদেশি বিনিয়োগে রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানাসমূহের সিংহভাগই হলো রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টরে। হালে আইটি সেক্টরে বিদেশি বিনিয়োগ সংবলিত কিছু শিল্প নিবন্ধিত হয়েছে কিন্তু তাদের রপ্তানির হিসাব সাধারণত দৃশ্যগোচর নয়। বাংলাদেশে বাকি বড় বড় বিদেশি বিনিয়োগ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সেক্টরে। আহরিত গ্যাসের প্রধান ক্রেতা বাংলাদেশ নিজে আর উৎপাদিত বিদ্যুতের ব্যবহারকারীও বাংলাদেশ। রপ্তানির আপাতত সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার মতো শিল্প এ সব ক্ষেত্রে নেই। সিমেন্ট শিল্পে (রসায়ন খাত) ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগ হলেও তা দেশীয় বাজার দখলকে কেন্দ্র করে। অধিকন্তু সিমেন্ট শিল্পে ভ্যালু এডিশন নেই বললে চলে। কাঁচামাল আমদানি উত্তর গুণগত মান বজায় রেখে সিমেন্ট বিদেশে রপ্তানি করার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত মনে হতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগের দ্বারা বাংলাদেশের বাজারে বিদেশি পুঁজি প্রবেশের পাঁজি পুঁথি ঘাঁটলে টেকনোলজি ট্রান্সফারের প্রকৃত অবস্থার শুমার করলে এবং স্থানীয় শ্রমিকের কর্মসংস্থানের জরিপ ফলাফলের দিকে তাকালে বোঝা যাবে মিশ্র ফললাভ ঘটেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। বিদেশি পুঁজির নগদ প্রবাহ অতি সামান্য। বিনিয়োগকৃত সিংহভাগ পুঁজি দেশি-বিদেশি ব্যাংকের ঋণ যা চড়া সুদ ও শর্তের। বেসরকারি খাতে প্রদত্ত বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এ বাণিজ্যিক ঋণের দায় দায়িত্ব বহনের ঝুঁকি থাকছে বাংলাদেশ অর্থনীতির। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বিদেশি ঋণ প্রবাহিত হয়েছে কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন যথাযথ সময়ে শুরু করা সম্ভব না হওয়ায় ওই ঋণ রীতিমতো ঝুঁকিতে পরিণত হতে চলেছে। এমন কেসের সংখ্যা বাড়ছে। জয়েন্ট ভেঞ্চারের কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটাও দেখা গেছে স্থানীয় অংশীদারের বিদেশি ঋণের দায় বেড়েছে। সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট প্রকৃতির সরবরাহসমূহে সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতির মূল্য বেশি ধরা হয়েছে- যন্ত্রপাতির স্থায়িত্ব ও গুণগত মান পূর্বাহ্নে যথাযথ যাচাই সম্ভব না হওয়ায় পরবর্তী সময় এগুলো বোঝার ওপর শাকের আঁটি প্রতীয়মান হয়েছে।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যে ক’টি বড় অঙ্কের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে তন্মধ্যে গুটি কয়েক ব্যতীত সব ক্ষেত্রে নানান বিবাদ বিসংবাদ উপস্থিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগ স্বার্থ উপেক্ষিত রয়ে গেছে। যৌথ বিনিয়োগে টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে একটি প্রকল্প বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সহজ টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক সৃষ্টিতে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে, উৎকর্ষ ব্যবস্থাপনায় সেবা ঈর্ষণীয় পর্যায়ে গেছে এবং পাবলিক সেক্টরের তুলনায় এ খাতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য অর্জিত হলেও সুকৌশলে বিদেশি শেয়ার হোল্ডার ক্রমান্বয়ে সিংহভাগ শেয়ার করায়ত্বের সুযোগে দেশীয় লোগো পরিবর্তন থেকে শুরু করে স্থানীয় নিয়োগপ্রাপ্ত মেধাবী নির্বাহীদের ক্রমান্বয়ে বিতাড়নও করে চলেছে। বাংলাদেশ অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে এ প্রকল্প সরাসরি কোনো অবদান না রাখতে পারলেও জনজীবন যাত্রায় একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে এবং এ সার্ভিস সেক্টরে সরকারি রাজস্ব আয়ও বেড়েছে।

তবে অর্থনীতির অন্যান্য উৎপাদন খাতে সমপর্যায়ের অগ্রগতি অর্জিত না হওয়ায় টেলিযোগাযোগ খাতের এ আকস্মিক বিবর্তন এবং এ সেবা খাতের থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় টেকসই কোনো অগ্রগতি বলে বিবেচ্য নয়। যৌথ বিনিয়োগে আসা বিদেশি শিপিং কোম্পানিগুলো অস্বচ্ছতার আশ্রয় নিয়ে দেশি শেয়ার হোল্ডারদের হটিয়ে দিয়ে দেশি নাবিক ও কর্মীর স্থলে বিদেশি নাবিক ও কর্মীদের পুনর্বাসিত করেছে।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশ কর্তৃক ঘোষিত সুযোগ-সুবিধাগুলো প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেকাংশে সহজ ও লোভনীয়। আর সুচতুরতার সঙ্গে এসব সদ্ব্যবহার করেছে সুযোগ সন্ধানী অনেক বহুজাতিক কোম্পানি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ওয়ার্ক পারমিট প্রদান প্রথাকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশে অদক্ষ বহু বিদেশি শ্রমিক টেকনিশয়ান ছদ্মবেশে কর্মরত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

অভিযোগ রয়েছে তাদের বেতন যথাযথভাবে ঘোষণা করা হয় না এবং তাদের অর্জিত আয় বৈদেশিক মুদ্রায় পাচার হয় দেশীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণ অপারগতায়, অনীহায় কিংবা কখনো কখনো যোগসাজশে।

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে বস্তুগত অগ্রগতি, সার্বিক বিবেচনায়, পরিলক্ষিত হয় ইপিজেডগুলোতে। এখনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের শিল্প ইউনিট গড়ে উঠেছে- বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং জাতীয় রপ্তানিতে আয় সংযুক্ত হয়েছে (যদিও ভ্যালু এডিশন কম)। বাংলাদেশে ওই বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন ও আরাধ্য যা এ দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে, আমদানি ব্যয় হ্রাসকারী প্রতিস্থাপনীয় পণ্য উৎপাদনে, শ্রমশক্তির জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সক্ষম প্রযুক্তি হস্তান্তরমূলক টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

আর ঢালাওভাবে সব সেক্টরকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত না করে এবং সবাইকে একই সহায়তা ও সুযোগ না দিয়ে দেশীয় শিল্পে উদ্যোক্তাদের টেকসই ও সহনশীল উন্নয়নের স্বার্থে সময়ে সময়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনার ভিত্তিতে শুধু নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ আহ্বান করা উচিত এবং খাতওয়ারি অগ্রগতি যাচাই করে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের শর্তগুলোও পুনর্বিবেচনা করা উচিত। আর সার্বিকভাবে বিবেচনায় আনা উচিত নিচের বিষয়গুলো যা বিদেশি গবেষক ও বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন-

(ক) যদিও বাংলাদেশে শ্রমের মজুরি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম তবুও শ্রমিকদের অপর্যাপ্ত উৎপাদন ক্ষমতা (উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রায়োগিক প্রশিক্ষণের অভাবজনিত অদক্ষতা, পুষ্টিহীনতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অপর্যাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অপ্রতুল যন্ত্রপাতি) এবং ঘন ঘন কর্মবিরতির কারণে সার্বিকভাবে উৎপাদন মাত্রা যথাযথ নয়।

(খ) নিকট-প্রতিবেশী দেশসমূহ থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। বরং দেখা যায় প্রতিবেশী দেশসমূহ বিনিয়োগ আকর্ষণের ব্যাপারে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। একই অর্থনৈতিক অবকাঠামো ও ভৌগোলিক অবস্থানে থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে বিদেশি বিনিয়োগের আকর্ষণ বাড়ে।

(গ) বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধির একটি ন্যূনতম অংশ কেবল অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ হয়ে থাকে। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের নিম্ন মাত্রা বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে একটি ঋণাত্মক দিক। উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা দাবি করে থাকেন সরকারি-বেসরকারি মিলে জিডিপির ২০% ভাগ অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় হওয়া উচিত। একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রশ্ন করতে পারেন যে দেশে লোকেরা নিজেরাই নিজ দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী নয় সে দেশে আমি কেন টাকা বিনিয়োগ করতে যাই। সুদের হার বেশি হলে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়ে থাকে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App