×

জাতীয়

দ্বন্দ্ব-কোন্দলের সুযোগ নিচ্ছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০১৮, ১১:১৪ এএম

গৃহবিবাদ, দ্বন্দ্ব ও কোন্দলে জর্জরিত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ। যার প্রভাবে উপজেলা ও পৌরসভা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছেন নেতাকর্মীরা। সবকটি উপজেলায় হয় নেতাদের মধ্যে দুই বা ততোধিক গ্রুপিং, নয়তো জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের বিরোধ রয়েছে। আর সুযোগটি ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে জামায়াত-শিবির ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে জামায়াত-শিবিরসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তির শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। গত নির্বাচনের আগে ও পরে এবং যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে বাঁশখালী, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া, চন্দনাইশসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বেশ কিছু এলাকায় ব্যাপক তান্ডব চালায় বিএনপি-জামায়াত। এরপরও সাংগঠনিক শক্ত অবস্থান গড়ে তোলায় মনোযোগ নেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের। বরং দ্ব›দ্ব-কোন্দল এবং সংঘাত-সংঘর্ষে ব্যস্ত রয়েছেন তারা। আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই বিরোধ নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন নিয়ে ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এবং দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মুখোমুখি অবস্থানে ছিলেন। ওই সময় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে ভাঙচুর, সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। সে সময় ভূমি প্রতিমন্ত্রী জাবেদের পক্ষের নেতাকর্মীরা দক্ষিণ জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বহিষ্কারও দাবি করেন। জানা যায়, আনোয়ারা-কর্ণফুলী থানা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১৩ আসনের সংসদ সদস্য ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের সঙ্গে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমেদের বিরোধ দীর্ঘদিনের। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকান্ড নিয়ে তাদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ চলে আসছিল। তাদের এ বিরোধের প্রকাশ্য বিস্ফোরণ ঘটে গত ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করে। জেলা সভাপতির বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্য করে আওয়ামী রাজনীতিকে ‘কলঙ্কিত’ করার অভিযোগ আনেন প্রতিমন্ত্রী জাবেদ। চট্টগ্রামের পটিয়া, আনোয়ারা, বোয়ালখালী, বাঁশখালী, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলা এবং নগরীর কর্ণফুলী থানা নিয়ে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা গঠিত। দক্ষিণ জেলার আনোয়ারা উপজেলা ও নগরীর কর্ণফুলী থানা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১৩ আসনের এমপি ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও দক্ষিণ জেলার দীর্ঘদিনের সভাপতি প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর পুত্র। রাজনীতির চেয়ে ব্যবসা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকা জাবেদ পিতার মৃত্যুর পর আনোয়ারায় এসে উপনির্বাচনে বিজয়ী হন। বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও তিনি একই আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে ভূমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মৃত্যুর পর দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে সভাপতি করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক সংগঠন জামায়াত-শিবিরের অন্যতম বড় ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া। স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের রয়েছে যোজন-যোজন দূরত্ব। সংসদ সদস্য আবু রেজা নদভীর বিরুদ্ধে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে উপজেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দফায় দফায় আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নিয়ে আবু রেজা নদভী এমপি হওয়ার পর থেকে তিনি দলের মূলধারার নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলেন। উন্নয়ন কর্মকান্ড ও দলের কর্মসূচির চেয়ে নিজের ফয়জুল্লাহ ফাউন্ডেশন নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন তিনি। একই অভিযোগ লোহাগাড়ার আওয়ামী লীগ নেতাদের। দলের কোন্দল ও গ্রুপিংয়ের কারণে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এই আসনে বর্তমান এমপি ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন। চট্টগ্রামে বাঁশখালীতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং দীর্ঘদিনের। এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিরোধ চরমে। জামায়াত-হেফাজতের শক্তি ঘাঁটি বাঁশখালীতে আওয়ামী লীগের এমপি ও স্থানীয় নেতৃত্বের বিরোধ আগামী নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এই আসনে বর্তমান এমপি ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক মুজিবুর রহমান সিআইপি, আব্দুল্লাহ কবির লিটন প্রমুখ। এ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সিটি মেয়র মাহামুদুল ইসলাম চৌধুরী, হেফাজতে ইসলামের নেতা মুফতি ইজহারুল ইসলাম। চট্টগ্রাম পটিয়া আসনের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী পরপর দুইবার নির্বাচিত হলেও তার সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের দূরত্ব রয়েই গেছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র হারুনুর রশিদের সঙ্গে তার দ্ব›দ্ব যেন দিন দিন বাড়ছেই। এর আগের কমিটির সঙ্গেও সাংসদের দূরত্ব ছিল দীর্ঘদিন। জানা যায়, বিগত ইউপি নির্বাচনে স্থানীয় বড়লিয়া ও শোভনদন্ডি ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করেই মূলত তাদের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। বর্তমানে দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং চরম আকার ধারণ করেছে। চন্দনাইশ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী। গত নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় তিনি সহজে বিজয়ী হন। এ আসনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে তার বিরোধ রয়েছে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দলে জামায়াত-বিএনপির লোকজন ঢুকে পড়েছে। তাদেরই কদর বেড়েছে। জেলা নেতৃত্বে সঙ্গে এই আসনের সংসদ সদস্যের দ্ব›দ্ব রয়েছে। এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে তিনি ছাড়াও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানও রয়েছেন। বোয়ালখালীর বর্তমান সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন খান বাদল। তিনি জাসদ একাংশের কার্যকরী সভাপতি। গত দুই নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেয়নি। সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সবাই এক সুরে বলেন, তিনি উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেননি। যে কারণে বোয়ালখালী পিছিয়ে পড়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে এমপির দূরত্ব প্রকাশ্যে। এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ। ভূমি প্রতিমন্ত্রী জাবেদ ও জেলা সভাপতি মোছলেম উদ্দিনের বিরোধের প্রভাব পড়েছে দক্ষিণের মহিলা আওয়ামী লীগেও। নেত্রীরা বিভক্ত হয়ে আছেন দুই ভাগে। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান কায়সারের মেয়ে সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খান, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুনের মেয়ে দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শামীমা হারুন লুবনা, দীপিকা বড়–য়া, ববিতা বড়–য়া, এডভোকেট পাপড়ি সুলতানা ও জীবন আরাসহ একটি অংশ আছেন মোছলেম উদ্দিনের সঙ্গে। আর দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য হাসিনা মান্নান, চেমন আরা তৈয়বসহ আরেকটি অংশ সাম্প্রতিক রাজনীতিতে মোছলেম উদ্দিনের বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। তারা ভূমি প্রতিমন্ত্রী জাবেদের সমর্থন পাচ্ছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App