×

বিনোদন

সত্যজিৎ ও উত্তম জুটি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০১৮, ০২:০৯ পিএম

সত্যজিৎ ও উত্তম জুটি
সময়টা ১৯২৬ সাল, ব্রিটিশ ভারতের কলকাতার আহিরীটোলায় জন্ম হয় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের মহানায়ক উত্তম কুমারের। জন্মের সময় তার নাম ছিল অরুণ কুমার চ্যাটার্জি। মধ্যবিত্ত পরিবারের তিন সন্তানের মধ্যে তিনিই বড়। অভাবের সংসার সামলাতে গিয়ে পড়াশোনার কথা না ভেবে ক্যালকাটা পোর্টের সামান্য কেরানির চাকরিতে ঢুকতে হয় তাকে। চাকরির ব্যস্ততায় গ্র্যাজুশেনটাও শেষ করতে পারেননি। অভিনয় ছিল তার রক্তে রক্তে, শিরায় শিরায়! তাইতো মঞ্চ নাটকে তাকে দেখা যেত নিয়মিত। প্রথম ছবি ‘দৃষ্টিদান’ দিয়ে চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ার শুরু করলেও নজরে আসেন তিনি ‘বসু পরিবার’ চলচ্চিত্র দিয়ে। মধ্যবিত্তের পরিবারের ছেলে অরুণ থেকে মহানায়ক উত্তম কুমার হয়ে ওঠার গল্পটা মোটেই সহজ ছিল না। সে সময়টায় দুর্গাদাস ব্যানার্জি, প্রমথেশ বড়ুয়া, সায়গল, ধীরাজ ভট্টাচার্যের রাজত্ব ছিল। উত্তমকে তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যেতে হয়েছে। উত্তম কুমারকে নিয়ে চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় কাজ করেছিলেন দুটো ছবিতে। উত্তমকে যখন সত্যজিৎ রায় প্রথম বড়পর্দায় দেখেন তখন উত্তম কুমার ইতোমধ্যেই মহানায়ক, কিন্তু সত্যজিৎ তার পরিচালনার খাতা খুলতে পারেননি। সত্যজিতের সবচেয়ে চোখে পড়েছিল নির্মল দে এর পরিচালনায় উত্তম কুমারের বসু পরিবার ছবিটি। মঞ্চ অভিনেতা হওয়া সত্তে¡ও তার সিনেমার অভিনয়ে ছিল না মঞ্চের কোনো ছাপ। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে রোমান্টিক জুটি হয়ে সারা বাংলা কাপালেও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তার কাজ করা হয়েছিল ব্যতিক্রমী দুটি ছবিতে যার নাম ‘নায়ক’ ও ‘চিড়িয়াখানা’। নায়ক ছবিতে পাড়ার অভিনেতা থেকে সুপারস্টার অভিনেতা হওয়ার গল্প নিয়ে নির্মিত ছবিতে উত্তম কুমার খুঁজে পেয়েছিলেন যেন নিজেকে। ওদিকে চিড়িয়াখানায় তিনি হয়েছিলেন শরদিন্দুর পোড় খাওয়া গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সী। নায়ক (১৯৬৬) ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে সত্যজিৎ বেছে নিয়েছিলেন বিভ‚তিভ‚ষণ, তারাশংকর, রবিঠাকুর কিংবা পরশুরামের বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসকে। তবে ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নায়ক গল্পের রচয়িতা সত্যজিৎ নিজেই। ছবির গল্পে চোখ বুলানোর আগে একটা নির্মাণের পেছনের গল্পে ঘুরে আসা দরকার। নির্মাতা হিসেবে নিজের চাহিদা থেকে একচুল সরানো যেত না সত্যজিৎকে। লোকমুখে জানা যায়, এই কিংবদন্তি পরিচালকের সঙ্গে সর্বাধিক কাজ করা অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এসে একদিন সত্যজিৎকে জিজ্ঞাসা করলেন, নায়ক সিনেমাতে আমাকে নিলেন না কেন? সত্যজিৎ সৌমিত্রের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলেন তুমি কি উত্তম! সত্যজিৎপুত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা সন্দীপ রায় আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে একবার জানিয়েছিলেন, বাবা তো উত্তম কুমারকে মাথায় রেখেই ‘নায়ক’ লেখেন। অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট। কোনো গল্প থেকে নেয়া নয়। ওকে বাদ দিয়ে কোনো বিকল্পও ভাবেননি... ভাবা যাবে না বলেই ভাবেননি নিশ্চয়ই। নায়ক ছবির প্রধান চরিত্র বাংলা চলচ্চিত্রের সুপারস্টার অরিন্দম মুখোপাধ্যায় কিনা একটি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তির পর তা গ্রহণের জন্য রেলপথে কলকাতা থেকে দিল্লির উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। ট্রেনের রেস্তোরাঁ কারে অরিন্দমের সঙ্গে অদিতি সেনগুপ্ত (শর্মিলা ঠাকুর) নামের এক নারী সাংবাদিকের পরিচয় হয় যিনি আধুনিকা নামে মেয়েদর একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। অদিতির কাছে অরিন্দমের ক্যারিয়ারের আগে ও পরের জীবনের গল্পগুলো জানানোর মাধ্যমে ছবির গল্প এগোয়। ছবিতে সাতটি ফ্ল্যাশব্যাক এবং দুটি স্বপ্নের দৃশ্য দিয়ে অরিন্দমের জীবনের গল্পগুলো একে একে তুলে ধরা হয়। ব্যক্তি অদিতি এর আগে ফিল্মস্টারডের বিশেষ অপছন্দ করতেন। কিন্তু অরিন্দমের কথা শুনে তিনি অনুভব করেন তার খ্যাতির আড়ালে কোথাও গিয়ে লোকটি বড্ড একা যে অদিতির মনে অরিন্দমের প্রতি সহানুভ‚তি জাগায়। তাই গল্প শোনার ছলে অরিন্দমের ইন্টারভিউ নিয়েও সেটি ছিঁড়ে ফেলেন ছবির শেষে। ‘উত্তম, তোমার কোনো মেকাপ হবে না।’ নায়কের শুটিং স্পটে সত্যজিতের কথাটি শুনে উত্তম খুবই ধাক্কা খেয়েছিলেন এটা শুনে! মাত্র কিছুদিন আগে জলবসন্ত থেকে ওঠা অপরদিকে মহানায়ক খ্যাতি পাওয়া রোমান্টিক হিরো উত্তম কুমারের কাছে মেকাপ ছাড়া শট দেয়া রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো বিষয়। কিন্তু শুট শেষ ফুটেজ দেখে প্রচন্ড খুশি হয়ে উত্তম জানিয়েছিলেন, তা হলে আমি এত মেকাপ করি কেন? কারিগরি দিক দিয়ে নায়ক যেন একটি সুনির্মিত সিনেমা। এই ছবির জন্য ছবির শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত আলাদা করে ট্রেনের কামরা বানিয়েছিলেন। যেটি বানানোর আগে রেল ইয়ার্ডে গিয়ে বংশী দেখে এসেছিলেন কীভাবে করে কারিগরিভাবে ট্রেনের কামরার বিভিন্ন অংশ তৈরি হয়। নিয়ে এসেছিলেন দরজা, জানালা, বাঙ্ক এর মাপ। সব সেট বানিয়েছিলেন এক মাসে। ওদিকে দৃশ্যধারণের সময় চলন্ত ট্রেনের অনুভ‚তি আনার জন্য কামরার সেটের নিচে বড় বড় স্প্রিং লাগিয়েছিলেন। তাইতো ছবি দেখে কে ধরবে, এটি আসল নাকি নকল ট্রেন! নায়ক মুক্তির দিনের মজার একটি গল্প জানিয়েছিলেন উত্তমের স্ত্রী সুপ্রিয়া দেবী। ভবানিপুরের ইন্দিরা সিনেমাতে ছিল সিনেমাটির প্রিমিয়ার শো। তিনি আর উত্তম কুমার মধ্যপথের মোড়ে পৌঁছে দেখেন হাজার হাজার মানুষের মাথা। অনেক কষ্টে শোতে ঢোকেন তারা। শো শেষ করে তারা যখন বের হচ্ছিল, জনতা ‘গুরু, গুরু’ বলে এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর এতে উত্তমের শার্টের একটা হাতা ছিঁড়ে বেরিয়েই গেল। ওদিকে ছিঁড়ে গেল সুপ্রিয়া দেবীর শাড়ির আঁচলটা! কোনোমতে ওই অবস্থায় গাড়িতে উঠে তারা সোজা গ্র্যান্ড হোটেলে এসে বাঁচলেন। ওদিকে নায়ক ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্য, উত্তম কুমার টাকার পাহাড়ে ডুবে যাচ্ছেন। দৃশ্যটির জন্য প্রচুর নকল নোট ছাপানো হয়েছিল যা ব্যবস্থা করেছিল প্রোডাকশনের লোকেরাই। কিন্তু এখন দেখা গেল, রিজার্ভ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া নোট ছাপানো হয়েছে বলে প্রযোজকের নামে এসেছিল অভিযোগ। নায়কের একটি দৃশ্যে পকেট থেকে কলম বের করে লিখবেন অরিন্দম। ওদিকে ফুরিয়ে গেল কলমের কালি। সত্যজিৎ যেই কাট বলতে যাবেন, তার আগেই হালকা ঝাঁকি দিয়ে আবার সই করার চেষ্টা করলেন উত্তম। তাতেও বিফল হয়ে সামনে থাকা গ্লাসের পানিতে কলম চুবিয়ে সাইন করলেন। প্রচন্ড খুশি হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় উত্তমের এই ইমপ্রোভাইজেশনটা দেখে। অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের নায়কোচিত এই অভিনয় উত্তম কুমার ছাড়া আর কেইবা করতে পারতেন? চিড়িয়াখানা (১৯৬৭) শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সী। ডিটেকটিভ কথা শুনতে ভালো নয়, গোয়েন্দা শব্দটা আরো খারাপ, তাই নিজেই নিজের খেতাব দিয়েছেন সত্যান্বেষী। নায়ক ছবিতে সুপারস্টারের পর সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ আবারো বড় পর্দায় হাজির হলেন সত্যজিত-উত্তম জুটি। ছবির মুক্তির সাল ১৯৬৭। সেরা পরিচালক হিসেবে সত্যজিৎ রায় এবং অভিনেতা হিসেবে উত্তম কুমার জাতীয় পুরস্কার ঘরে তুলেছিলেন ছবিটি দিয়ে। প্রৌঢ় বয়সে নিশিনাথ নামের একজন সাবেক বিচারপতি দ্বারস্থ হন ব্যোমকেশের। চাকরির সময়টাতে অনেক আসামিকেই নিশিনাথ ফাঁসির কাস্টে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন। অবসরের পরে ব্যাপারটা নিয়ে তার এক ধরনের অনুশোচনার সৃষ্টি হয় নিশিনাথের যে কারণে অপরাধীদের অনেকটা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা স্বরূপ একটি ব্যবস্থা করেন। নির্মাণ করেন গোলাপ কলোনি নামের একটি আবাসের, যেটিকে বাইরের লোক ডাকেন চিড়িয়াখানা হিসেবে! কোনদিন হঠাৎ নিশিনাথের একটি বিষয় নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক অতঃপর সেটি উদঘাটনে নেমে পড়েন ব্যোমকেশ বক্সী, সঙ্গে নেন তার ডেপুটি অজিতকে। অজিত চরিত্রে ছবিতে সাবলীল অভিনয় করেন শৈলেন মুখোপাধ্যায়। ওদিকে শুটিং যখন শেষ হল চিড়িয়াখানার, মিউজিক রেকর্ডিংয়ের জন্য আর কোনো টাকাই বাকি নেই। কেবলমাত্র ছবির ক্লু ভালোবাসার তুমি কী জানো গানটা শুধু আগে থেকে রেকর্ড হয়েছিল। বাড়িতে যা ছিল, কিছু পারকাশন, জাইলোফোন, সুরমমন্ডল এগুলো বাক্সে ভরে আর উহের রেকর্ডারটা নিয়ে সত্যজিৎ এক দিনের জন্য গ্র্যান্ড হোটেলে রুম ভাড়া নিয়ে চলে গেলেন। সারা দিন ধরে স্রেফ একা সব যন্ত্রগুলো একে একে বাজিয়ে রেকর্ড করে ফেললেন উহের রেকর্ডারে। পিয়ানোটা না নিয়ে যাওয়ায়, ওটা পরে বাড়িতেই রেকর্ড করলেন। এই আশ্চর্য অসাধ্যসাধন কেবলমাত্র সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের পক্ষেই সম্ভব! ওদিকে শুটিংয়ের সময় একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল উত্তম কুমারের। ‘মানিকদাকে (সত্যজিৎ রায়) বলিস রে! চাকরের রোল দিলেও আমি করব। এইসব কাজ আর ভাল লাগছে না!’ ম্যারম্যারে রোমান্টিক গল্প করে হাঁপিয়ে ওঠা উত্তম কুমার একবার সত্যজিৎ রায়ের এক সহকারীকে এভাবেই তার সঙ্গে কাজ করার আর্জি জানিয়েছিলেন। তবে নায়ক আর চিড়িয়াখানায় কাজ করার পর সত্যজিৎ-উত্তম জুটিকে দর্শকরা আর একসঙ্গে দেখেনি বড়পর্দায়...

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App